ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

শহরকেন্দ্রিক বায়ুদূষণ ও আমাদের করণীয়

অ্যাডভোকেট মো. রায়হান আলী
শহরকেন্দ্রিক বায়ুদূষণ ও আমাদের করণীয়

ক্রমাগত বেড়েই চলছে দেশের বড় বড় শহরগুলোতে বায়ুদূষণ। গ্রাম ছেড়ে শহরে মানুষের জীবন-জীবিকার চাপ বৃদ্ধির কারণে নগরায়নের উন্নয়নমূলক কাজ বিভিন্ন পর্যায়ে চলমান। সার্বিকভাবে শহরমুখী মানুষের জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা হুমকিতে রয়েছে। নানাভাবে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। বায়ুদূষণ সংক্রান্ত স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণে শহরগুলো ধীরে ধীরে বসবাসের জন্য অনেকটা অযোগ্য হয়ে উঠছে।

বায়ুদূষণ হলো বর্তমান শহরের প্রধান সমস্যাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে অন্যতম। বায়ুদূষণ সাধারণত ঘনবসতিপূর্ণ মেট্রোপলিটান এলাকায় অধিক হয়, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যেখানে শহরগুলো দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং পরিবেশগত বিধিমালা তুলনামূলকভাবে শিথিল বা একেবারেই নেই। নগরায়ণের ফলে দ্রুত বর্ধনশীল গ্রীষ্মমণ্ডলীয় শহরগুলোতে মানবসৃষ্ট বায়ুদূষণের কারণে অকাল মৃত্যুহার দ্রুত বৃদ্ধি পায়। উন্নত দেশের জনবহুল এলাকাগুলোও অস্বাস্থ্যকর মাত্রায় দূষণের পরিমাণ লক্ষ্য করা গেছে, লস অ্যাঞ্জেলেস এবং রোম এরকম দুটি উদাহরণ। আমাদের দেশের প্রধান প্রধান শহরগুলোতে পরিবেশদূষণ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ধীরে ধীরে বসবাসের অযোগ্য হয় উঠছে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার বায়ুদূষণ জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তথ্য বলছে- বিগত আট বছরের মধ্যে ঢাকায় ২০২৩ সাল ছিল সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণের বছর। ২০১৬ সালের পর গত আট বছরে ২০২৩ সালে ঢাকার বায়ুমান সবচেয়ে খারাপ ছিল। নতুন বছরের শুরুতে দূষণের মাত্রা কিছুটা কমলেও প্রথম ১৩ দিনের সাত দিনই শীর্ষে ছিল ঢাকার অবস্থান। লাগামহীন ঢাকার বায়ুদূষণ। দিনের পর দিন যেন বেড়েই চলছে দূষণের মাত্রা।

আন্তর্জাতিক বায়ুমান প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের মানদ- অনুযায়ী, কোনো শহরের নম্বর ৫০ বা তার কম হলে বায়ুর মান ভালো বলে ধরা হয়। ৫১ থেকে ১০০ হলে তাকে মাঝারি বা গ্রহণযোগ্য, ১০১ থেকে ১৫০ নম্বরকে সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর ও ১৫১ থেকে ২০০ হলে অস্বাস্থ্যকর, ২০১ থেকে ৩০০ হলে খুবই অস্বাস্থ্যকর বায়ুর শহর হিসেবে ধরা হয়। নম্বর ৩০১-এর বেশি হলে বায়ুর মানকে দুর্যোগপূর্ণ বা ঝুঁকিপূর্ণ ধরা হয়।

স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৬ সাল থেকে ২০২০ পর্যন্ত সংবেদনশীল গোষ্ঠীর যেমন শিশু ও প্রবীণ জনগোষ্ঠীর জন্য ঢাকার বাতাস অস্বাস্থ্যকর পর্যায়ে ছিল। সবশেষ তিন বছরসহ বাকি পাঁচ বছর ছিল অস্বাস্থ্যকর পর্যায়ে। ২০২৩ সালে যা আট বছরের সর্বোচ্চ ১৭১। চলতি বছরের শুরুর দিন বাদ দিলে বাকি সময়টা বায়ুর মানের কিছুটা উন্নতি হলেও তা সন্তোসজনক নয়। বছরের শুরুর প্রথম ১৩ দিনের মধ্যে সাত দিনই বায়ুদূষণের শীর্ষে ছিল ঢাকা। এই সময়ে ২৮৪ পর্যন্ত উঠেছে। বিভিন্ন কারণে ঢাকার বায়ুদূষণ হয়ে থাকে তন্মেধ্যে প্রধান ৫টি কারণ সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়, যথা- নির্মাণকাজ, ইটভাটা ও শিল্প কারখানা, যানবাহন, বর্জ্য পোড়ানো, ট্রান্স-বাউন্ডারি এয়ার পলিউশন। এগুলোর পরিবেশগত প্রভাবে ঢাকার বায়ুদূষণ রোধ করা অনেকটা কঠিন হয়ে পড়েছে।

ইহা ছাড়াও অনেকে অনেক কারণের কথাও বলছে। এ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলমান বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে বাজেট বরাদ্দ থাকালেও দূষণের বিরুদ্ধে নেয়া হয় না কোনো ব্যবস্থা। তাই চলমান শৈত্যপ্রবাহের হাড়কাঁপানো শীতে কুয়াশাকে ধূলার মিশ্রণ অর্থাৎ ধোঁয়াশা বলছেন গবেষকরা। আইন বাস্তবায়নে এখনই কঠোর না হলে আরও চড়া মূল্য দেয়ার শঙ্কা পরিবেশবিদদের। পরিবেশবিদ অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ঢাকার বায়ুদূষণ গত বছরের তুলনায় কমলেও ৮ বছরের তুলনায় খুব বেশি কমেনি। এটি আমাদের পরিবেশ অধিদপ্তরের জাতীয় যে মানমাত্রা রয়েছে, সেই মানমাত্রার চেয়ে এখনও তিনগুণ বেশি বায়ুদূষণ বিরাজ করছে। তাই আমাদের আত্মতুষ্টিতে ভোগার সুযোগ নেই।

এ ছাড়াও, পরিবেশ ও জলবায়ু বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল বলেন, উন্নয়ন কাজের সময় যে চুক্তি হয়, সেখানে বলা থাকে যে, কীভাবে পরিবেশ এবং উন্নয়ন সমান্তরালে করা হবে। কিন্তু সেগুলো আমাদের এখানে মানা হয় না। সংস্থাগুলো এ বিষয়ে তৎপর হলে বায়ুদূষণ কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।

রাজধানী ঢাকায় মানুষের বসবাস ক্রমাগত বেড়েই চলছে। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষা কন্ট্রোলে আনা অনেকটা কঠিন হয়ে পড়ে। ভৌগোলিকভাবে ঢাকা একটি অতিমহানগরী বা মেগাসিটি; ঢাকা মহানগরীর মোট জনসংখ্যা ৪ কোটি ৪২ লাখ ১৫ হাজার ১০৭ জন, যা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১১ ভাগ। তাই এই জনবসতিপূর্ণ এলাকার বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ সময়ের একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন সুধিজনরা।

শীতকাল আগমনের পর থেকে বিপজ্জনক অবস্থায় উপনীত হয়েছে ঢাকার বাতাসের দূষণমাত্রা। সহনীয় মাত্রার চেয়ে কখনো কখনো সাড়ে ছয়গুণ পর্যন্ত ছাড়িয়ে যাচ্ছে দূষণ। চীনের উহান বা ভারতের নয়াদিল্লিকে পেছনে ফেলেছে ঢাকা। বৈশ্বিক র‍্যাংকিংয়ে কখনো প্রথম, কখনো দ্বিতীয় কখনো-বা তৃতীয় অবস্থানের মধ্যে আবর্তিত হচ্ছে ঢাকার মানদ-। এই দূষিত বায়ুতে শ্বাস নেওয়ার ফলে গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পতিত হচ্ছেন রাজধানীর বাসিন্দাগণ। হৃদরোগ, দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসযন্ত্রের রোগ, ফুসফুসের সংক্রমণ ও ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে বিভিন্ন বয়সের ও শ্রেণি-পেশার মানুষ।

বায়ুদূষণ নিয়ে বিশ্ব ব্যাংকের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর বায়ুদূষণে ৮০ হাজার মানুষ মারা যায়। মানুষের গড় আয়ু তিন বছর কমছে। দূষণের কারণে বাড়ছে মানুষের বিষণ্ণতা, মরণব্যাধি করোনাসহ বিভিন্ন প্রকার রোগবালাই। যার অর্থনৈতিক ক্ষতি জিডিপির ৪ ভাগেরও বেশি।

২০২৩ সালে বায়ুদূষণ রোধে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি ১৪ দফা সুপারিশ করেছিল ক্যাপসের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার। সুপারিশগুলোর মধ্যে অবৈধ ইটভাটাগুলো বন্ধ করে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার, আগুনে পোড়ানো ইটের বিকল্প হিসেবে সেন্ড ব্লকের ব্যবহার বৃদ্ধি; ব্যক্তিগত গাড়ি এবং ফিটনেসবিহীন গাড়ির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা, নির্মাণকাজের সময় নির্মাণ স্থান ঘেরাও দিয়ে রাখা, রাস্তায় ধুলা সংগ্রহের জন্য সাকশন ট্রাকের ব্যবহার করা, সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে প্রচুর পরিমাণে গাছ লাগানো অন্যতম। প্রতিনিয়ত বায়ুদূষণের নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। অতি দ্রুত বায়ুদূষণ কমাতে পদক্ষেপ না নিলে জনজীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। নানা উন্নয়ন প্রকল্পসহ দূষণের উৎসগুলো নিয়ন্ত্রণে কর্তৃপক্ষের এখনই ব্যবস্থা না নিলে চড়া মূল্য দিতে হতে পারে। মৌলিক অধিকারগুলোর মধ্যে চিকিৎসা অন্যতম তাই জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধনে সমন্বিত পরিকল্পনা জরুরি বিষয়। জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার স্বার্থে ঢাকার বায়ুদূষণ রোধকল্পে জনসচেতনতা বৃদ্ধি, সরকারি-বেসরকারি পদক্ষেপকে আরো তরান্বিতকরণে এখনই পদক্ষেপ নেয়া দরকার।

লেখক : আইনজীবী ও কলামিস্ট,

জজকোর্ট, খুলনা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত