ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

পরিবেশ দূষণের মহোৎসব

বাড়াতে হবে আইনের কঠোর প্রয়োগ
পরিবেশ দূষণের মহোৎসব

রাজধানীসহ সারা দেশে চলছে পরিবেশ দূষণের মহোৎসব। তবে যেভাবে দূষণ চলছে সেইভাবে আইনি সহায়তা কামনা করার সংখ্যা বাড়ছে না। ঢাকার পরিবেশ আদালতে মামলা দায়েরের সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। বর্তমানে ঢাকার পরিবেশ আদালতে পরিবেশ সংক্রান্ত ১১৫টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। পরিবেশ দূষণ রোধে ব্যর্থ দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান এখনও তলানিতে। এনভায়রনমেন্টাল পারফরমেন্স ইনডেক্স (ইপিআই) ২০২৪ অনুসারে ২৩ দশমিক ১০ পয়েন্ট নিয়ে বাংলাদেশ রয়েছে নিচ থেকে চতুর্থ স্থানে (১৭৭)। ১১টি ইস্যুতে ৫৮টি পারফরমেন্স ইনডিকেটরের তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবছর মার্কিন ইয়েল ইউনিভার্সিটি এই র‍্যাংকিং প্রকাশ করে। এমন পরিস্থিতিতে গতকাল সারা বিশ্বে ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ পালন করা হলো। আদালতের রেজিস্ট্রারের হিসাব অনুযায়ী গত ২১ বছরে মোট মামলা হয়েছে ৫৮৭টি। যার মধ্যে ৪৭২টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। অধিকাংশ মামলার আসামিরা দণ্ডিত হয়েছেন। পরিবেশ আদালতে মামলার সংখ্যা কম হওয়ার কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে ১৯৯৫ সালের ‘পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে’ শুধু বিশেষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনও ব্যক্তি বা পরিবেশ অধিদফতরেই মামলা করার অধিকার ছিল। সে কারণে মামলার সংখ্যা কম ছিল। তবে ২০১০ সালে এই আইন সংশোধনের পর যে কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান মামলা করার সুযোগ পাচ্ছে। তারপরও মামলার সংখ্যা বাড়ছে না। আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের এই আইন সম্পর্কে খুব একটা ধারণা নেই। সে কারণে এই আইনে মামলা হচ্ছে না। এছাড়া মানুষ পরিবেশ দূষণ বিষয়ে এখনও সেভাবে সচেতন হয়ে ওঠেনি। এসব কারণে আদালতে মামলা কম হচ্ছে। এছাড়াও কেউ দূষণ করলে পরিবেশ অধিদফতর সরাসরি দণ্ড প্রদান করতে পারেন। এই ক্ষেত্রেই বিষয়টি আর আদালত পর্যন্ত গড়ায় না। পরিবেশ আদালতে যে কয়টি মামলা হয় তাদের মধ্যে অধিকাংশ মামলায় কারাদণ্ড ও জরিমানা করা হয়ে থাকে। দণ্ডের মাধ্যমে আদালত আসামিদের পরিবেশ দূষণে নিরুৎসাহিত করা যেতে পারে। পরিবেশ বিপর্যয় ও পরিবেশদূষণের কারণে ঘটছে জলবায়ুর পরিবর্তন। এই জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবে শঙ্কিত পুরো বিশ্ব। পরিবেশের চারটি উপাদানের মধ্যে তিনটি মাটি, পানি, বায়ু মানবসৃষ্ট দূষণের শিকার। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শব্দদূষণ। মানুষের মৌলিক চাহিদা খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের জন্য যেসব বস্তুর প্রয়োজন হয়, তার সবগুলোরই উৎস মাটি। মাটির দূষণ হচ্ছে মাটির প্রয়োজনীয় উপাদান হ্রাস ও অবাঞ্ছিত পদার্থসমূহের সঞ্চয়। ভূমিক্ষয়, রাসায়নিক দ্রব্য ও বর্জ্যরে স্তূপ, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, অনিয়ন্ত্রিত বৃক্ষনিধন, অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ, অনিয়ন্ত্রিত কৃষিকাজ, পলিথিন বর্জ্য, পারমাণবিক বর্জ্য, রাসায়নিক মিশ্রণ, মেডিকেল বর্জ্য, ই-বর্জ্য মাটি দূষণের অন্যতম কারণ। এছাড়া নগরায়ণ ও জনসংখ্যা বৃদ্ধিও মাটি দূষণের কারণ। দূষণের কারণে মাটি হারাচ্ছে উর্বরতা আর বাড়ছে উৎপাদনে ঘাটতি। ফলে বিশ্বব্যাপী দেখা দিচ্ছে খাদ্যের সংকট। বাড়ছে খাদ্যপণ্যের দাম। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে, মাটিদূষণ একটি বিশ্বব্যাপী হুমকি। এই দূষণ বিশ্বের মাটির এক-তৃতীয়াংশকে প্রভাবিত করছে। মাটির অবক্ষয়ের কারণে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ক্ষতি বিশ্বের বার্ষিক জিডিপির ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। শুধু মাটিদূষণের কারণে পৃথিবীর প্রায় ২৫ বিলিয়ন টন উপরিভাগের মূল্যবান মাটি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মাটিদূষণের কারণে ভয়ংকর লিউকিমিয়া রোগ থেকে ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। মাটিদূষণে যেমন জমির উবর্রতা নষ্ট হচ্ছে, কমছে নাইট্রোজেন ফিক্সেশন, হারিয়ে যাচ্ছে মাটির উপকারী অণুজীব, তেমনি কমছে ব্যবহার্য জমির পরিমাণ। ফলে অণুজীব, জমির পুষ্টি গুণাগুণ এবং খাদ্যশস্যের যে প্রাকৃতিক খাদ্যশৃঙ্খল রয়েছে, তা-ও নষ্ট ও ধ্বংস হচ্ছে। মাটির মতোই দূষণের শিকার পানি। পানির ব্যবহার ব্যাপক ও সর্বত্র। পৃথিবীর শতকরা প্রায় ৯৭ ভাগ পানিই লবণাক্ত সাগরের পানি। বাকি মাত্র তিন ভাগ মিঠাপানি। আবার এই তিন ভাগের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ মানুষের আওতাধীন, বাকিটা মেরু-অঞ্চল ও হিমবাহের বরফে রূপান্তরিত। এই পরিমাণ মিঠাপানি পৃথিবীর সব মানুষের প্রয়োজন মেটাতে যথেষ্ট। কিন্তু অসম নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ও পানিদূষণের কারণে মানুষ তার প্রাপ্য পানি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। পানিদূষণের বিভিন্ন কারণের মধ্যে গৃহস্থালির বর্জ্য এবং কলকারখানা থেকে নির্গত বর্জ্যই উল্লেখযোগ্য। বিভিন্ন রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু দ্বারা দূষিত পানি ব্যবহারের কারণে মানুষের কলেরা, টাইফয়েড, ডাইরিয়া, আমাশয়, পরিপাকতন্ত্রে প্রদাহ, যকৃতে প্রদাহসহ বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি হয়। প্রতি বছর প্রায় ১৮ লাখ মানুষ পানিদূষণজনিত রোগে ভুগে মারা যায়। কর্মক্ষেত্রে দূষণ ৮ লাখ মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী। বাংলাদেশে পানিদূষণের অন্যতম প্রধান কারণ আর্সেনিক। দেশের প্রায় ৫ কোটি ৭০ লাখ মানুষ যে পানি ব্যবহার করে, সেখানে আর্সেনিকের মাত্রা প্রতি লিটারে ৫০ মাইক্রোগ্রাম। যেখানে ডব্লিউএইচও নির্ধারিত সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রা প্রতি লিটারে ১০ মাইক্রোগ্রাম। জীবজগতের প্রায় ৯৯ শতাংশ জীব বায়ুজীবী। পারমাণবিক বিস্ফোরণসহ দুর্ঘটনাজনিত তেজস্ক্রিয় নির্গমণ, কলকারখানা নির্গত বিষাক্ত ধোঁয়া, যানবাহন নির্গত ধোঁয়া, অস্বাস্থ্যকর প্রক্রিয়ায় পৌর ও গৃহস্থালির আবর্জনা জমানো ও অপসারণ, যথেচ্ছ বৃক্ষনিধন, ব্যাপক কয়লা ও কাঠ পোড়ানো, অতিরিক্ত অ্যারোসল ও অন্যান্য স্প্রে ব্যবহার এবং কৃষিকাজ ও মশা-মাছি নিধনে ব্যবহৃত রাসায়নিক কীটনাশক ইত্যাদি কারণে বায়ুদূষণ ঘটছে। বায়ুদূষণের প্রধান কারণ জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো। বায়ু, পানি, সিসা ও কর্মক্ষেত্রে দূষণের শিকার হয়ে বাংলাদেশে মারা গেছে ২ লাখ ১৫ হাজার ৮২৪ জন। শব্দ মানুষের ভাব বিনিময়ের প্রধান মাধ্যম হলেও শব্দদূষণ মানুষের মানসিক ও শারীরিক অসুবিধারও কারণ। শব্দের তীক্ষèতার ওপর নির্ভর করে শব্দদূষণ নির্ণয় করা হয়। মানুষের স্বাভাবিক শ্রবণমাত্রা ৬০-৭৫ ডেসিবেল মাত্রার শব্দ। শব্দের মাত্রা ৭৫ ডেসিবেল অতিক্রম করলেই সেটা শব্দদূষণ। যানবাহনের চলাচল ও জোরালো হর্ন, কলকারখানার নির্গত শব্দ, বিভিন্ন নির্মাণকাজের শব্দ, অনিয়ন্ত্রিত লাউড স্পিকার ব্যবহার, উড়োজাহাজের শব্দ, আবাসিক এলাকায় কলকারখানার অবস্থান, প্রচণ্ড জনকোলাহল ইত্যাদি শব্দদূষণের মূল কারণ। শব্দদূষণকে বলা হয় নীরব ঘাতক। ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ১ দশমিক ১ বিলিয়ন মানুষ অত্যধিক শব্দযুক্ত বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে শ্রবণশক্তি হ্রাস হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।’ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে সারা বিশ্বে ৫ শতাংশ মানুষ শব্দদূষণের শিকার। শব্দদূষণ এমনকি মায়ের গর্ভের শিশুর শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধিকেও প্রভাবিত করে। সারা পৃথিবীতে পরিবেশের সংকট ক্রমেই ঘনিয়ে আসছে। সচেতন মানবসমাজ বায়ু, পানি ও মাটিদূষণ, গ্রিনহাউজ প্রতিক্রিয়া, ওজোন স্তরের ক্ষয়, অ্যাসিড-বৃষ্টি ইত্যাদি ঘটনা নিয়ে বেশ শঙ্কিত। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনমতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর যত মানুষের মৃত্যু হয়, তার ২ শতাংশই মারা যায় পরিবেশদূষণজনিত অসুখ-বিসুখের কারণে। কিন্তু সারা বিশ্বে এ ধরনের মৃত্যুর গড় মাত্র ১৬ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের ২০১৫ সালের পরিসংখ্যানমতে, শহরাঞ্চলে দূষণের মাত্রা উদ্বেগজনক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। দূষণের কারণে ২০১৫ সালে বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে ৮০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। পরিবেশ রক্ষা করা গেলে মানুষের জীবনও রক্ষা পাবে। সে কারণে পরিবেশ দূষণ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে বাড়াতে হবে আইনের প্রতিকার।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত