প্রকৃতিতে প্রাণের স্পন্দন বাড়ুক

এস এম মুকুল

প্রকাশ : ০৮ জুন ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

প্রকৃতিতে প্রাণের স্পন্দন তখন স্পন্দিত হবে, যখন প্রকৃতিকে তার মতো করে থাকতে দিই আমরা। প্রকৃতির বন্ধনে নিজেকে আবদ্ধ করতে হলে অবশ্যই এসব প্রাণের স্পন্দনকে বাঁচাতে হবে, বিকশিত করার উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য প্রয়োজন প্রকৃতির আলিঙ্গনে নিজেকে সমর্পণ করা। আমরা মানুষ প্রকৃতির সন্তান, প্রকৃতির কোল থেকেই আমরা বেড়ে উঠি এবং বর্তমান সময়ের সভ্যমানুষ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছি। কিন্তু সেই প্রকৃতি থেকে দিন দিন আমরা দূরে চলে যাচ্ছি। আমরা যারা শহরে থাকি- প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের প্রত্যক্ষ যোগাযোগই নেই। আর যারা গ্রামে বাস করি, তারাও প্রকৃতি থেকে দূরে সরে দাঁড়াচ্ছি। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় জানা গেছে, ৫০ বছর বয়স্ক একটি ফল গাছ তার সারা জীবেন মানুষের যে উপকার করে তার আর্থিক মূল্য ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা। আবার পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে, সুস্বাস্থ্যের জন্য একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের প্রতিদন ১১৫ গ্রাম ফল খাওয়া দরকার। কিন্তু প্রয়োজন ও প্রাপ্তি ব্যবধানের কারণে আমরা মাত্র ৪০-৪৫ গ্রাম ফল খেতে পারছি। অপরপক্ষে যদি ফলজ বৃক্ষরোপণ করে আমরা সমৃদ্ধ ফলবাগান গড়ে তুলতে পারি, তাহলে আমরা দেশীয় ফল থেকে পুষ্টি চাহিদা পূরণ করতে পারব। এ জন্য আমাদের বেশি বেশি ফলের গাছ লাগাতে হবে।

ফলদ বৃক্ষ পরিবেশ রক্ষা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আবার ওষুধ তৈরির জন্য ভেষজ গাছের প্রয়োজন। তাই বনজ ও ফলদ গাছের পাশাপাশি ভেষজ গাছও লাগাতে হবে। পরিবেশকে শুদ্ধ, নির্মল ও সুস্থ রাখার জন্য শুধু গাছ লাগালে চলবে না।

গাছ ছাড়াও অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদানকে ভালো রাখার উদ্যোগ নিতে হবে। প্রকৃতিতে একটি ঘাস, একটি গুলা, একটি ছোট প্রাণী, একটি বহৎ প্রাণীকে ভালো রাখার উদ্যোগ নিতে হয় মানুষকে। পরিবেশকে ভালো ও নির্মল রাখতে হলে মানুষ যেমন তার মতো মানুষের প্রতি যত্নবান হতে হবে, ঠিক তেমনি প্রকৃতির প্রতিটির সৃষ্টিকেও আপন করে নিতে হবে। কারণ পরিবেশের প্রতিটি উপাদানই পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। তবে প্রকৃতির উদ্ভিদ, প্রাণী এবং মানুষ পরস্পরের ওপর তখন বেশি নির্ভরশীল হবে, যখন প্রকৃতিতে বৈচিত্র্য থাকবে সমৃদ্ধ। দেশের মানুষের মধ্যে বৃক্ষরোপণ প্রবণতা বাড়ছে। পরিবার পর্যায়ে যত গাছপালা রোপণ করা হয়, এর মধ্যে শুধু বসতবাড়ির আশপাশেই অর্ধেকের বেশি অর্থাৎ ৫৪ শতাংশ গাছ লাগানো হয়। মানুষের গাছ লাগানোর জন্য উৎসাহকে পুঁজি করে শত-সহস্র নার্সারি গড়ে উঠেছে। অনেক পরিবারের জন্য শুধু নার্সারি আয়ই জীবিকার প্রধান উৎস। তবে পারিবারিক বৃক্ষরোপণের পুরো সম্ভাবনাকে এখনো কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছে না। জানা গেছে, প্রায় সাড়ে ২০ লাখ পরিবার বৃক্ষরোপণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। গড়ে একটি পরিবারের পাঁচ সদস্য ধরা হলে মাত্র সোয়া কোটির মতো মানুষ বৃক্ষরোপণ করে। দেশের জনসংখ্যার তুলনায় এই সংখ্যা খুবই কম। তবে বৃক্ষরোপণে সরকারের প্রচেষ্টার প্রতিফলন যথেষ্ট না হলেও লক্ষণীয়। সরকার শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৃক্ষরোপণের প্রবণতা সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছে। এই চেষ্টা আরো জোড়দার হওয়া দরকার। প্রতি শিক্ষাবর্ষে বৃক্ষরোপণের ওপর শিক্ষার্থীদের নম্বর দেওয়া যেতে পারে। ক্যাম্পেইন প্রয়োজন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে। শিক্ষার্থীদের জন্য নামমাত্র মূল্যে গাছের চারা বিতরণ করা যেতে পারে। বছরে তিনটি করে গাছ লাগালে শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষাজীবনেই এর সুফল ভোগ করবে। এই গাছ লাগানো তাদের শুধু ব্যক্তিগতভাবে লাভবান করবে না- পরিবেশ বাঁচাবে, প্রকৃতিপ্রেমী হয়ে উঠবে তারা। এক্ষেত্রে চীনের উদ্যোগটি অনুসরণীয় হতে পারে। গ্রামীণ জীবন সম্পর্কে ধারণা নিতে এবং জীবনযাত্রার পার্থক্য অনুধাবনের জন্য চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় চংকিং শহর কর্তৃপক্ষ শহরের শিক্ষার্থীদের গ্রামে পাঠায়। গ্রামে অবস্থানের সময় প্রায় সাড়ে ৭ লাখ শিক্ষার্থীর প্রত্যেককেই ১০০টি করে চারা গাছ রোপণ করতে হয়। তাদের ধারণা- এসব শিক্ষার্থীদের জীবনবোধ হবে মানবীয়, প্রজন্মগত ও ভৌগলিক দূরত্ব কমানো সম্ভব হবে। গাছ মানুষের এত উপকার করার পরও অকাতরে চলছে বৃক্ষনিধন।

নগরায়ন, শিল্পায়ন, আসবাবপত্র তৈরি, শিল্পের কাঁচামাল তৈরি, জ্বালানি কাঠের সরবরাহ এইসব অজুহাতে গাছ কেটে বনভূমি উজাড় করছি আমরা। আর এরফলে প্রকৃতির ভারসাম্য হুমিকর মুখে পড়েছে। কার্বন-ডাই অক্সাইড, কার্বন-মনো অক্সাইড, লিথেনসহ ক্ষতিকর গ্যাসের প্রভাবে বায়ুমণ্ডল দূষিত হচ্ছে। তবে আশার খবরটি হচ্ছে- সবুজ বনভূমি ও বৃক্ষরোপণের গুরুত্ব সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেনতা, আগ্রহ এবং বৃক্ষরোপণ প্রবণতা বাড়ছে। জুন, জুলাই ও আগস্ট মাস গাছ লাগানোর উপযুক্ত সময়। আগামী প্রজন্মের কথা চিন্তা করে নিকটস্ত জেলা ও উপজেলার নার্সারি বা বৃক্ষমেলা পথকে চারা সংগ্রহ করে আপনিও গাছ লাগাতে পারেন। ফলদ ও ঔষধি গাছের চারা লাগানো বিষয়ে প্রচারণা চালাচ্ছে- বন বিভাগ, পরিবেশ অধিদপ্তর এবং পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো। সারাদেশে এখন চলছে বৃক্ষরোপণ অভিযান এবং বৃক্ষমেলা। এসব বৃক্ষমেলায় জনগণের ভিড় প্রমাণ করে দেশের মানুষের মধ্যে বৃক্ষপ্রীতি বাড়ছে।

এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, গ্রামের মানুষ এখন গাছকে তার ‘সামাজিক বিমা’ হিসেবে দেখতে শুরু করেছে। তাই গাছের ফল, জ্বালানি, পরিবেশগত সুবিধা এবং গাছের আর্থিক অবদান জন্য বৃক্ষরোপণের প্রতি মানুষ উৎসাহিত হচ্ছে। সামগ্রিকভাবে যার ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে পরিবেশের ওপর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নগরায়নের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশ সুরক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করে নতুন প্রকল্প গ্রহণকালে প্রাকৃতিক জলাধার সৃষ্টি ও তা সংরক্ষণ এবং অধিকহারে বৃক্ষরোপণের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের এটিও লক্ষ্য রাখতে হবে, যে কোনো প্রকল্পের সঙ্গে বৃক্ষরোপণ করতেই হবে এবং জলাধার সৃষ্টি এবং জলাধার সংরক্ষণ করতে হবে।’ একই সঙ্গে তিনি দেশের নাগরিকদের প্রত্যেককে কর্মস্থলে ও বাসস্থানে গাছ লাগানোর আহ্বান জানিয়ে সন্তানদেরও এই পরিবেশবাদী কাজ শেখানোর পরামর্শ দিয়েছেন। বিশ্ব পরিবেশ দিবস ও পরিবেশ মেলা ২০১৯ এবং জাতীয় বৃক্ষরোপণ অভিযান ও বৃক্ষমেলা ২০১৯ উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী এসব বলেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বন বিভাগ উপকূলে নতুন জেগে ওঠা চরসহ ফাঁকা জমিতে গাছ লাগানোর বিষয়টিকে দেশে জনপ্রিয় করে তুলতে অনেকটাই সক্ষম হয়েছে। যার ফলে বনের বাইরেও গ্রামের মানুষ বাড়ির চারপাশে, পতিত জমিতে, পুকুর ও নদীর পাড়ে, ফসলের জমির আইলে বৃক্ষরোপণ করছে। বিশেষত ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাণিজ্যিকভাবে ফলবাগান করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। একইসঙ্গে বন বিভাগ ও গ্রামীণ জনগণের যৌথ উদ্যোগে সামাজিক বনায়নের পরিধিও বাড়ছে। বন বিভাগ, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠনের প্রচেষ্টায় বৃক্ষের প্রতি মানুষের দরদ লক্ষ্যণীয়ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে বৃক্ষমেলার আয়োজন তারই প্রতিফলন। আবার সারাদেশের শহরাঞ্চলে বাড়ির ছাদে, বারান্দা, করিডোর এমনকি জানালার কার্নিশে ফল, ফুল, ভেষজ গাছ লাগানোর পরিমাণ বেড়েছে। আরো আশাবাদের বিষয় হলো- শহরের মানুষ সৌখিনতায় হলেও ঘরের ভেতরে ছায়া উপযোগী বৃক্ষের শোভায় গৃহসজ্জায়ন করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন- এই প্রবণতার সুফল মানুষই ভোগ করবে। তবে আশার কথা হচ্ছে- দেশে প্রাকৃতিক বনভূমি যখন সংকুচিত হয়ে আসছে, তখন এর বিপরীত প্রবণতায় বনের বাইরে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণও ক্রমেই বাড়ছে। পরিবেশবিদদের মতে বৃক্ষের পরিবেশ ও অর্থনৈতিক মূল্য, কমিউনিটি উদ্যোগ এবং সরকারের সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির ফলে লোকালয়ে গাছের সংখ্যা বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও বন বিভাগের একটি যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০০ সাল থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে বনের বাইরে নতুন করে ২ লাখ ১৯ হাজার ৩০০ হেক্টর বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা বেড়েছে। সামাজিক বনায়নের প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ বাড়ার ফলে সবুজায়নের পরিধি বিস্তৃত হচ্ছে। পরিবেশ সুরক্ষায় এটি অবশ্যই আশাবাদের সঞ্চার করে।

উল্লেখ্য, ‘বাংলাদেশের বনের বাইরে ও ভেতরে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকার সমন্বিত মূল্যায়ন : ২০০০ থেকে ২০১৪’ শীর্ষক ওই গবেষণাটির একটি সারসংক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের আইওপি সায়েন্স নামের একটি জার্নালে প্রকাশিত হয়।

লেখক : আহ্বায়ক, বইকেন্দ্রিক সামাজিকতার জাগরণে প্রচারাভিযান কর্মসূচি (বইসাজ), বিশ্লেষক ও কলাম লেখক।