ক্ষমতায় মোদি : তবে চ্যালেঞ্জও আছে

অলোক আচার্য

প্রকাশ : ০৯ জুন ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ইতিহাসের দীর্ঘসময় ধরে চলা ভারতের ১৮তম লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে এবার কোনো দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। তবে সর্বাধিক আসন পেয়ে আবারও তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করছে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। সরকার গঠন করলেও পরিস্থিতি গত দুইবারের থেকে ভিন্ন। আশানুরূপ আসন পায়নি বিজেপি। ফলে সরকার গঠনে জোট নেতাদের উপর নির্ভর করতে হয়েছে ব্যাপকভাবে। এবারের নির্বাচনে দেখার বিষয় ছিল মোদি ম্যাজিক কতটা কাজে লাগে? যখন গত দুই নির্বাচন বিশেষত গত নির্বাচনে মোদি ম্যাজিকেই বিজেপি এককভাবেই সরকার গঠনের ক্ষমতা অর্জন করেছিল। সে কারণেই এই ম্যাজিক ম্যানের উপর দলটির অগাধ আস্থা ছিল। তবে আসন সংখ্যা কমেছে। প্রশ্ন উঠেছে, তবে কি মোদি ম্যাজিক কমতে শুরু করেছে? আরো একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় ছিল যে, বহুদিনের খরা কাটিয়ে ভারতের সবচেয়ে পুরাতন রাজনৈতিক দল কংগ্রেস কেমন ফলাফল করে। সেখানে কংগ্রেস আগের থেকে অনেক ভালো অবস্থানে রয়েছে। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে মাত্র ৪৪টি আসন পেয়েছিল কংগ্রেস, ২০১৯ সালের নির্বাচনে ৫২টি আসন পেয়েছিল ঐতিহ্যবাহী দলটি। এবারের লোকসভা নির্বাচনে ১০০ আসনে একাই জয় পেয়েছে বারবার ভারত শাসন করা কংগ্রেস। শেষবার কংগ্রেস ভোটের নিরিখে তিন সংখ্যা পার করেছিল ২০০৯ সালে। সেই বছর ২০৬ আসনে জয়ী হয়েছিল কংগ্রেস। দ্বিতীয়বারের জন্য তৈরি হয়েছিল মনমোহন সিংয়ের সরকার। এরপরই পথ হারায় দলটি। নানা চড়াই-উৎড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে এবার ইন্ডিয়া জোট গঠন করে আবার ফিরে এসেছে। এটি পুরোপুরি চমকপ্রদ না হলেও কিছুটা তাক তো লেগেছেই। সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে ৯৬ কোটি ৯০ লাখ ভারতীয় নাগরিকের অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে লোকসভা নির্বাচনের জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়েছে। যদিও ভোট পরেছে রেকর্ড পরিমাণ। সাত ধাপের নির্বাচনে দেশটির নাগরিকরা ১৯ এপ্রিল থেকে ১ জুনের মধ্যে ভোটে অংশ নেয় এবং ৪ জুন ফলাফল ঘোষণা মধ্যে দিয়ে শেষ হয় নির্বাচনের আনুষ্ঠিকতা।

যদিও বুথ ফেরত জরিপ অন্য ইঙ্গিত দিচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত সত্যি হয়নি বুথ ফেরত জরিপের আভাস। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় এককভাবে সরকার পরিচালনা করে আসছিলেন মোদি সরকার। মোদির সিদ্ধান্তই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ২০১৪ সালে ভারতের ক্ষমতায় আসার পর বলা চলে তিনি প্রায় এককভাবে দেশের সকল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সেসব সিদ্ধান্ত বিরোধী দলের সমালোচনার মুখে পড়লেও কাজও হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় ২০১৬ সালে নরেন্দ্র মোদি মুদ্রা নিষেধাজ্ঞার মতো বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আবার ২০১৯ সালে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার করার মতো মেরুকরণমূলক পদক্ষেপও গ্রহণ করেছেন। কিন্তু এবার একক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বাধা আসছে। কারণ জোট সরকারে অন্যদের সিদ্ধান্ত অথবা আপত্তি এড়িয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। গণমাধ্যম বিশ্লেষণ বলছে, জোট সরকারের ক্ষেত্রে এ সকল বিষয়গুলো একচেটিয়া জনপ্রিয়তাকে ক্ষুণ্ণ করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ কথা সত্যি যে নরেন্দ্র মোদি ভারতকে একটি শক্ত অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছেন। ফের মোদি সরকার ক্ষমতায় আসায় চলমান কাজগুলো দ্রুত শেষ হবে। বৈদেশিক সম্পর্ক উন্নয়ন বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট ও পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক আরো শক্তিশালী হবে। ভারতের রয়েছে রাশিয়ার সঙ্গেও সুসম্পর্ক। নরেন্দ্র মোদি হবেন ভারতের ইতিহাসে তৃতীয় সর্বোচ্চ মেয়াদের সরকারপ্রধান। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু প্রায় ১৬ বছর ৯ মাস দেশ শাসন করেন। আর তার কন্যা ইন্দিরা গান্ধী দেশ শাসন করেন ১৫ বছর ১১ মাস। ১৯৯৬ সালে অটল বিহারী বাজপেয়ির নেতৃত্বে ভারতে বিজেপি ক্ষমতায় আসে। তারপর ২০০৪ সালের নির্বাচনে বিজেপির পক্ষে জয়ের ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা সত্তেও তারা পরাজিত হয়। প্রধানমন্ত্রী মোদির দিকে অভিযোগের মূল লক্ষ্য দেশের অর্থনীতি। বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ঘিরে গড়ে ওঠা অর্থনীতি।

১৯৮৪ সালের পরে আর কোনো দল এককভাবে ৩৭০টি আসন জয় লাভ করতে পারেনি। ওই বছরের নির্বাচনে কংগ্রেস দল এই অসাধ্য সাধন করেছিল। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকাণ্ডের পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে কংগ্রেস পার্টি এককভাবে ৪১৪টি আসন পায়। মোদির ব্যক্তি ইমেজ ভারতের রাজনীতিতে অত্যন্ত শক্তিশালী। তাই ব্যাপক বেকারত্ব ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর অসন্তোষের কারণে এবারের নির্বাচনে বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠতা কম হলেও মোদির বিপরীতে ভারতীয়রা কাকে বেছে নেবেন বা কার ওপর তাদের ভবিষ্যৎ দায়িত্ব অর্পণ করতে পারে, তা আর কিছুদিনের মধ্যেই জানা যাবে। তবে মোদি বিরোধীদলীয় নেতার চেয়ে এগিয়ে আছেন তা এর আগের বিভিন্ন জরিপে উঠে এসেছে। এ নির্বাচনেও জোটটি মোদিকে ফোকাস করেই নির্বাচনি বৈতরণী পার হতে চাইছে। সব সমস্যার সমাধান হিসেবে মোদিকেই বেছে নিচ্ছে দলটি। বিজেপির শাসনামলে বৈশি^ক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও তারা মোটামুটি সফল বলা যায়। চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে প্রথম মহাকাশযান প্রেরণ করে রীতিমত বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেওয়া মোদি যে তরুণ সমাজকে বিশেষত একটি বড় অংশের মনোযোগ টানতে সক্ষম হয়েছেন, সেটি বলা যায়। তারপরেই আবার রয়েছে সূর্যে অভিযান। সেক্ষেত্রে বলা যায়, মহাকাশসহ প্রযুক্তি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে। সামরিক ক্ষেত্রেও ভারত যথেষ্ট শক্তিশালী। বেকারত্বের সমস্যা ভারতীয় অর্থনীতির জন্য একটি বড় সমস্যা। ভারতে বেকারত্ব ৪৫ বছরের সর্বোচ্চ। ২০২২ সালের বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, ভারতের যুব বেকারত্বের হার ২৩.২ শতাংশ এ গিয়ে দাঁড়িয়েছে। যেখানে জাতীয় বেকারত্ব প্রায় ৭ শতাংশ ছিল। ভারতের বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য বেকারত্ব দূর করা হবে উভয় জোটের জন্যই একটি বড় চ্যালেঞ্জ। দলগুলোর নির্বাচনি ইশতেহারে এবং রাজনৈতিক আক্রমণেও বেকারত্ব একটি বড় ইস্যু হয়ে এসেছে। এ কথাও সত্য যে, বিশ্ব অর্থনীতি যখন যুদ্ধ এবং জলবায়ু ও অন্যান্য কারণে টালমাটাল অবস্থানে ছিল, সেই সময় ভারত তার অবস্থান যথেষ্ট শক্ত অবস্থানে ধরে রাখতে পেরেছিল।

বিশ্বের বড় অর্থনৈতিক দেশগুলোর তালিকায় ক্রমেই ভারত উপরের দিকে উঠে আসছে। তবে দারিদ্র্যতা দেশটির বড় একটি চলতি সমস্যা হিসেবে রয়েই গেছে। বেসরকারি থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি অনুসারে, ভারতে বেকারত্বের হার চলতি বছরের এপ্রিলে বেড়ে ৮ দশমিক ১ শতাংশ হয়েছে। যা মার্চ মাসে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ ছিল। কোভিড-১৯ মহামারির আগে এটি ৬ শতাংশের কাছাকাছি ছিল। প্রতি বছরে ২ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০১৪ সালে মোদি প্রথম ক্ষমতায় এসেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে তিনি সেই অঙ্গীকার পূরণ থেকে যোজন-যোজন মাইল দূরে। সর্বশেষ জানুয়ারি-মার্চের ত্রৈমাসিকে সরকারি অনুমান দেখা গেছে, শহুরে এলাকায় ১৫-২৯ বছর বয়সিদের বেকারত্বের হার আগের ত্রৈমাসিকের ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশের বেশি হওয়া সত্ত্বেও খাদ্যদ্রব্যর দাম বৃদ্ধির কারণে গ্রামীণ জীবনে দুর্দশা বেড়েছে। কেন না, এই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সবার হয়নি। ভারতের জনসংখ্যার সবচেয়ে ধনী ১ শতাংশের মধ্যেই এটি সীমাবদ্ধ। ভারতে এখন মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশের কাছাকাছি অবস্থান করছে, যা তুলনামূলকভাবে কম। তবে ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে খাদ্যদ্রব্যের মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশের ওপরে উঠেছে, এতে বিপাকে পড়েছে দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষরা। এছাড়া জোট সরকার গঠনে কৌশলগত দিক থেকে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে মোদির। এর মানে এটা যে মোদিকে প্রথমে দেশের অর্থনীতি মেরামতের কাজটি দক্ষ হাতে সামাল দিতে হবে। বেকারত্ব কমানো, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং গ্রামীণ মানুষেল জীবনমান উন্নত করা কাজটি বেশ চ্যালেঞ্জিং। তাছাড়া সরকার গড়তে যাদের সমর্থন আবশ্যকভাবে প্রয়োজন হয়েছে, সেই নেতাদের মতো উপেক্ষা করা সম্ভব হবে না। সরকার টিকিয়ে রাখতে হলে তাদের সঙ্গে নিয়েই চলতে হবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি একটি নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করবে সরকারকে। যা গত দুই নির্বাচনে করতে হয়নি।