হিজড়া জনগোষ্ঠীকে নিয়ে ভাবতে হবে

প্রদীপ সাহা

প্রকাশ : ০৯ জুন ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সাধারণ মানুষের মতো ওদের গলার স্বর নয়; মহিলাদের মতো করে কথা বলে। গলার স্বর অনেকটা নারী-পুরুষের মিশ্র ভঙ্গিতে। দু’হাতে তালি, কোমড় দোলোনোসহ অদ্ভুত চালচলন পথিকের দৃষ্টি কাড়ে। হিজড়া জনগোষ্ঠী নামেই তারা বেশি পরিচিত। সাধারণত অধিকাংশ হিজড়াই স্বাভাবিক পুরুষের শারীরিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। তারা স¤পূর্ণরূপে পুরুষ বা নারী কোনোটাই নয়। ২০১৪ সালের ২৬ জানুয়ারি রাষ্ট্রীয় গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে হিজড়া সম্প্রদায়কে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ভারতেও রূপান্তরিত লিঙ্গের ব্যক্তিবর্গকে ২০১৪ সালের এপ্রিলে সুপ্রিমকোর্ট তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে আইনি স্বীকৃতি প্রদান করে। তাদের সামাজিকভাবে গ্রহণ না করার কারণে চিকিৎসা, শিক্ষা, কর্মসংস্থানসহ নানা স্থানে বিভিন্নভাবে বিড়ম্বনার মুখে পড়তে হয়। সমাজসেবা অধিদপ্তরের জরিপ অনুযায়ী দেশে হিজড়ার সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার হলেও বেসরকারি সংস্থার মতে, এ সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজারেরও বেশি। নেপাল, পাকিস্তান, ভারত এবং বাংলাদেশ আইনগতভাবে পাসপোর্ট এবং অন্যান্য দাপ্তরিক কাগজপত্রে লিঙ্গ অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে তৃতীয় লিঙ্গের অস্তিত্বকে স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশ সরকার এরইমধ্যে তাদের কিছু কাজের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যা খুবই অপ্রতুল।

একটি শিশু ছেলে বা মেয়ে হিসেবে জন্ম নেওয়ার পর যখন একটি নির্দিষ্ট বয়সে এসে পুরুষ বা নারী হিসেবে পরিণত হয় এবং যেসব হরমোন তাদের স্বাভাবিক মাত্রায় থাকা প্রয়োজন, সেসব হরমোনের তারতম্যের কারণেই নারী-পুরুষের বাইরে আরেকটি লিঙ্গের সৃষ্টি হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বলছেন, এর সঙ্গে আরো বেশ কিছু কারণ থাকতে পারে। একটি শিশু হিজড়া হিসেবে বেড়ে ওঠার জন্য হরমোনের তারতম্যের সঙ্গে মানসিক কারণও থাকতে পারে। সেইসঙ্গে শিশু বয়সে অ্যাবইউজ হওয়া বা কোনো ট্রমা থেকেও তারা অপর লিঙ্গের মতো নিজেকে ভাবতে থাকে। বাংলাদেশে হিজড়া জনগোষ্ঠী স্কুল থেকে ঝরে পরার পর এবং পরিবার থেকে বের হয়ে যাওয়ায় এক অর্থে ভাসমান জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়। সমাজের প্রত্যেক স্তরে, স্বাস্থ্যসেবা বা কর্মসংস্থানের মতো জায়গাতে তারা চরমভাবে অবহেলা ও বিড়ম্বনার স্বীকার হয়। নবজাতক শিশুকে আশীর্বাদ করা, বাজারে-পথে-ঘাটে মানুষের কাছ থেকে অর্থ নেওয়া তাদের আদি পেশা। জীবিকার তাগিদে তারা পেশা হিসেবে মূলত যৌনকর্মকে বেছে নেয়।

হিজড়া জনগোষ্ঠী এবং তাদের নিয়ে যারা কাজ করেন, তারা দীর্ঘদিন দাবি জানিয়ে আসছিলেন- হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হোক। কারণ তারা মনে করেন, নারী-পুরুষের বাইরে হিজড়াকে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলে শিক্ষা-স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের জায়গাতে হিজড়ারা কিছুটা হলেও গ্রহণযোগ্যতা পাবে। বাংলাদেশে হিজড়া জনগোষ্ঠীকে নিয়ে কাজ করে বেশ কিছু সংস্থা। সমাজে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও নাগরিক সুবিধাগুলো ফিরিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে এসব সংস্থাগুলো কাজ করে। অনেক পুলিশ অফিসার এবং ব্যক্তিপর্যায়ে কিছু কিছু লোকও তাদের উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন। তবে হিজড়াদের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনাটা বেশ সময়সাপেক্ষ। উপমহাদেশে হিজড়া প্রথার প্রচলন সেই মুঘল আমল থেকে। যৌনপেশা তাদের ঐতিহ্যের মধ্যে রয়েছে। দুই ধরনের হিজড়া আছে আমাদের সমাজে। একদল আছেন- যারা এসব কাজ থেকে সরে আসতে চায়, আরেক দল আছে- যারা এসব চায় না। আমরা মনে করি, হিজড়া জনগোষ্ঠীকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে অনেক সময় লাগবে। তবে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হলে সেই কাজটা দ্রুতই করা সম্ভব।

শেফালি (ছদ্মনাম) ছেলে হিসেবে জন্ম নিলেও ছোটবেলা থেকেই তার মেয়েদের কাপড় পরতে ভালো লাগত; মেয়েদের সঙ্গে মিশতে ভালো লাগত। এজন্য তার ভাই, বাবা-মায়ের কাছ থেকে অনেক মারধর খেতে হয়েছে। তার বয়স যখন আট বছর, তখন থেকেই তার হাঁটাচলা মেয়েদের মতো হতে থাকে। বয়স যত বাড়তে থাকে, সে উপলব্ধি করে- অন্যদের থেকে সে একেবারেই আলাদা। তখন সে বিষণ্ণতায় ভুগত। আর ভাবত, তার মতো কী আর কেউ নেই! এক পর্যায়ে সে পরিবার ছেড়ে পালিয়ে যায় এবং হিজড়াদের খাতায় নাম লেখায়। বিউটি (ছদ্মনাম) জানায়, স্কুলে সহপাঠী ও শিক্ষকদের অসহযোগিতার কারণেই তার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের মতো সাজতে তার ভালো লাগত। সে লিপস্টিক-কাজল দিয়ে স্কুলে যেত। এসব দেখে তার সহপাঠী ও স্কুলের শিক্ষকরা তাকে দেখে বিদ্রূপ করত। তারপর সে আর স্কুলে যায়নি। এভাবেই তার পড়াশোনার সমাপ্তি ঘটেছে। বাংলাদেশে হিজড়া জনগোষ্ঠীর এসব মানুষরা পরিবার ও সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্যতা না পাওয়ায় প্রথমে কিশোর বয়সেই তাদের লেখাপড়া থেমে যায়। একইভাবে পরিবারের সদস্যদের কাছে সমর্থনের অভাবে তারা সেখান থেকেও বের হয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে যোগ দেয় হিজড়ারাদের সঙ্গে। প্রত্যেক হিজড়া জনগোষ্ঠীর একজন করে গুরু মা থাকেন এবং তিনিই তাদের আশ্রয় দেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে হিজড়া জনগোষ্ঠী।

নেপাল, পাকিস্তান ও ভারতের মতো মুসলিম দেশে হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে অনেক আগেই স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে সরকারিভাবে হিজড়াদের কোনো পরিসংখ্যান নেই। সমাজে তাদের অস্তিত্ব থাকলেও খাতাণ্ডকলমে কোনো অস্তিত্ব দেখা যায় না। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার মতে, তাদের কাছে ৫০ হাজার হিজড়ার তালিকা আছে। আর যারা আছে, তারা তাদের পরিচয় গোপন করে আছে। সব মিলিয়ে এ সংখ্যাটি আরো বেশি। সরকারিভাবে যেসব প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়, সে সম্পর্কে হিজড়ারা তার গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন তোলে। বাংলাদেশ সমাজসেবা অধিদপ্তরের মতে, তারা ২০১২ সালে প্রথমবারের মতো হিজড়া শিশুদের শিক্ষা উপবৃত্তি ও প্রশিক্ষণের ওপর পাইলট প্রকল্প শুরু করে। সমাজের সব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হলেও মূল কষ্টের জায়গা হচ্ছে, তাদের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি। হিজড়ারা রাস্তায় বের হলে মানুষ বিভিন্ন বাজে মন্তব্য করে। টাকা আদায়ের সময় হিজড়া সম্প্রদায় যেমন সামাজিকভাবে অস্বস্তির পরিবেশ সৃষ্টি করে, তেমনি তারাও বিভিন্নভাবে দৈহিক লাঞ্ছনায় উৎপীড়িত হয়। একটা মেয়ে যেভাবে চলাফেরা করে, হিজড়া হওয়ার কারণে বাসে মানুষ পাশে বসে না; একটা ভালো বাসা ভাড়া নিতে পারে না। তাদের ইচ্ছে করে বাবা-মা এবং পরিবারের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে। অন্য সবার মতো হেসেখেলে বেড়াতে, চাকরি করে প্রতিষ্ঠিত হতে। হিজড়াদের নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বেসরকারি ও সরকারিভাবে যে গবেষণাগুলো করা হচ্ছে, সেখানেও একটি বিষয় গুরুত্ব সহকারে ওঠে এসেছে। সেখানে বলা হচ্ছে, বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও স্বীকৃতির ফলে হয়তো তারা সামাজিক সুবিধাগুলো গ্রহণ করতে পারবে। কিন্তু সমাজে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে তাদের প্রতি গ্রহণযোগ্য দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে না পারলে হিজড়া জনগোষ্ঠীকে সমাজের মূলধারায় নিয়ে আসাটা আরো দীর্ঘায়িত হবে। আসুন, আমরা সবাই হিজড়াকে মানুষ হিসেবে পরিচয় দিই- কোনো খারাপ আচরণ বা বাজে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকি এবং তাদের সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার উপায় খুঁজি।