মানবসভ্যতা এবং জীবিকার জন্যই সমুদ্র টিকিয়ে রাখতে হবে

শফিকুল ইসলাম খোকন

প্রকাশ : ১১ জুন ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সাগর-সমুদ্র এ দুইয়ের সঙ্গে আমরা খুবই পরিচিত। কিন্তু এ দুইয়ের মধ্যে কতশত সম্পদ রয়েছে তা হয়তো অনেকেই জানে না। আমরা জানি, যে কোনো সম্পদ মানুষের কল্যাণের জন্য, দুনিয়াতে যারাই সম্পদ অর্জন করে নিজেদের জন্য এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। আর সেই সম্পদ রক্ষা করতে আমরা কত কিছুই না করে থাকি। এই সম্পদের জন্য ভাই ভাইও অসম্পূরক হয়ে থাকে, এমনকি হত্যার মতো জঘন্য কাজও হয়ে থাকে। কিন্তু একটা বিষয় আমার কাছে প্রশ্নবিদ্ধ এবং কৌতুক মনে হচ্ছে, তা হলো সমুদ্র আমাদের সম্পদ, এই সমুদ্রের কতশত যে সম্পদ রয়েছে, তা অনেকেই জানে না। কিন্তু এই সমুদ্রে এতো সম্পদ থাকা সত্ত্বেও আমরা এই সমুদ্র রক্ষা না করে বরং ধ্বংস করি। শুধু তাই না, প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলে ধ্বংস লিলায় মেতে উঠি।

গত ৮ জুন ছিল বিশ্ব সমুদ্র দিবস। জোয়ার পরিবর্তনে স্পন্দন হারাচ্ছে সমুদ্র, আবার প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবহারের কারণে সমুদ্র দূষিত হচ্ছে- শুধু তাই না, এর ফলে সমুদ্রে মৎস্য সম্পদ যেমন প্রজনন ক্ষমতা হারাচ্ছে, তেমনি সমুদ্রের তলদেশে সম্পদগুলো দিনদিন বিলুপ্ত হচ্ছে। দিবসটি পালনের মূল উদ্দেশ্য হলো, সাগর-মহাসাগর সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা বাড়িয়ে তোলা। নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশেও দিবসটি পালন করা হয়ে থাকে। ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ধরিত্রী সম্মেলনে প্রতি বছর ৮ জুন বিশ্ব সমুদ্র দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সে বছরই প্রথমবারের মতো দিবসটি পালন করা হয়। এরপর ২০০৮ সালে জাতিসংঘ বিশ্ব সমুদ্র দিবসের পালনের বিষয়টিকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়। সাগর-মহাসাগরকে বলা হয় পৃথিবীর ফুসফুস। আমাদের অক্সিজেনের সবচেয়ে বড় জোগানদাতা হলো- এসব সাগর আর মহাসাগর। সমুদ্রের এই অবদান, আবেদন, প্রয়োজনীয়তা আর উপকারিতাকে স্বতন্ত্রভাবে বিশ্বের সবার সামনে তুলে ধরতে প্রতি বছর ৮ জুন পালন করা হয় বিশ্ব সমুদ্র দিবস।

বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নিয়ে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে আন্তর্জাতিক আদালতের ঐতিহাসিক রায়ে বঙ্গোপসাগরের ওপর বাংলাদেশের প্রায় একচ্ছত্র অর্থনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলেও বাস্তবে এ খাতে তেমন অগ্রগতি নেই বললেই চলে। বঙ্গোপসাগর একটি সুবিশাল মাছ ও জলজপ্রাণীর ভান্ডার। প্রায় ৫০০ প্রজাতির সুস্বাদু মাছ রয়েছে এখানে, যার অধিকাংশই অনারোহিত। সমুদ্র তলদেশও মূল্যবান তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদের অফুরান ভান্ডার। ভারত ও মিয়ানমার এ দুটো ক্ষেত্রে সমুদ্র সম্পদ আহরণ করে অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজে লাগাতে সক্ষম হলেও বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে অনেকাংশে। জরিপ ও গবেষণার কাজটিও প্রায় স্থবির, গতিহীন। দক্ষ জনবলের অভাবও প্রকট। তদুপরি ১৯৭৪ সালের ‘টেরিটোরিয়াল ওয়াটার অ্যান্ড মেরিন জোন অ্যাক্ট’ আইনটিও সংস্কার ও সংশোধন করা হয়নি অদ্যাবধি। সুবিশাল বঙ্গপোসাগরের বিপুল মৎস্য সম্পদ আহরণে টেকসই মৎস্য মজুত, সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা পরিচালনা এবং উপকূলীয় প্রান্তিক জেলেদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য মৎস্য অধিদপ্তর বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় বাস্তবায়ন করছে ১৮৯২ কোটি টাকার ‘সাসটেন্যাবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রজেক্ট’, যা বাস্তবায়িত হবে চার ধাপে। ২০২৩ সালের জুন নাগাদ প্রকল্পটির বাস্তবায়ন শেষ হলে তা হবে বাংলাদেশের ব্লু ইকোনমি বা নীল অর্থনীতির একটি বড় অগ্রগতি। বাংলাদেশের সমুদ্র গর্ভের সম্পদ এখন পর্যন্ত প্রায় অনাবিষ্কৃত ও অব্যবহৃত। সীমিত পর্যায়ে কিছু পরিমাণ তেল-গ্যাস এবং মৎস্য সম্পদ আহরণ করা হলেও, এর পরিমাণ বঙ্গোপসাগরের অফুরান সম্পদের তুলনায় খুব নগণ্য। ২০১৪ সালের জুলাইয়ে ভারত এবং ২০১২ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তির পর বাংলাদেশ ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বেশি সমুদ্র এলাকায় (টেরিটোরিয়াল সি) অধিকার লাভে সফল হয়। ২০০ নটিক্যাল মাইলের একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশে সব ধরনের প্রাণিজ ও অন্যান্য সম্পদের ওপর সার্বভৌম অধিকার লাভ করে। অথচ এই বিশাল অঞ্চলে কি পরিমাণ মৎস্য ও খনিজ সম্পদ রয়েছে, সে সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা নেই। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ব্লু ইকোনমি সেল। গভীর সমুদ্র এলাকায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও মৎস্য সম্পদ আহরণের জন্য ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার বহুমুখী প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এর আওতায় ৯৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে কেনা হবে অত্যাধুনিক মাল্টিডিসিপিনারি জাহাজ। বাকি ৬৫০ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে অবকাঠামো উন্নয়নসহ গবেষণার কাজে। জরিপ জাহাজের মাধ্যমে সুবিস্তৃত ও সুবিশাল বঙ্গোপসাগরের বুকে ও তলদেশে যাবতীয় মৎস্য, জলজ সম্পদ ও তেল-গ্যাসসহ মূল্যবান খনিজসম্পদ অনুসন্ধান এবং এসবের বিপুল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা জানা সম্ভব হবে। প্রাপ্তিসাপেক্ষে এসব মূল্যবান খনিজ উত্তোলন ও আহরণ সম্ভব হলে আগামীতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিধারা আরো কয়েকধাপ এগিয়ে যাবে সুনিশ্চিত।

কিন্তু এতো সম্পদ থাকা সত্ত্বেও আমরা কেন সমুদ্র সম্পদকে নিজেদের স্বার্থের জন্য রক্ষা করতে পারছি না? অথচ দিন দিন সমুদ্র নষ্ট হচ্ছে। সায়েন্স অ্যাডভান্সেস রিসার্চের প্রকাশিত একটি গবেষণা অনুসারে, সমুদ্রে পাওয়া সব প্লাস্টিকের ৮০ শতাংশ আসে এশিয়া থেকে। মহাসাগরে সব প্লাস্টিক বর্জ্যরে এক-তৃতীয়াংশের বেশি (৩৬.৪ শতাংশ) ফিলিপাইন থেকে আসে বলে বলে মনে করা হয়। তালিকায় এরপরেই আছে ভারত (১২.৯ শতাংশ), মালয়েশিয়া (৭.৫ শতাংশ), চীন (২.৭ শতাংশ) এবং ইন্দোনেশিয়া (৫.৮ শতাংশ)। এই পরিমাণগুলোতে বিদেশে রপ্তানি করা বর্জ্য অন্তর্ভুক্ত নয়, যা সমুদ্রে প্রবেশের উচ্চঝুঁকিতে থাকতে পারে। ওই প্রতিবেদনে প্লাস্টিক পরিবেশের জন্য এত বিপজ্জনক কেন? তাও উল্লেখ করেছেন। প্লাস্টিকের প্রধান সমস্যা হলো, এগুলো সহজেই বায়বীয় হয় না। এর ফলে এগুলো শত শত বছর ধরে পরিবেশে টিকে থাকতে পারে এবং মারাত্মক দূষণসমস্যা সৃষ্টি করে। সমুদ্রে নির্গত প্লাস্টিকগুলো দীর্ঘসময়ে জন্য ভাসমান থাকে। অবশেষে এগুলো তলদেশে ডুবে যায়। মহাসগরে যত প্ল­াস্টিক-এর ৯৯ শতাংশই ভূপৃষ্ঠের নিচে মাইক্রোপ্লাস্টিক আকার ধারণ করে আছে। ২০২১ সালে সায়েন্স অ্যাডভান্সেসের আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, সমুদ্রে নদীবাহিত প্লাস্টিক দূষণে দশম স্থানে বাংলাদেশ? সমুদ্রে নদীবাহিত প্লাস্টিক দূষণে শীর্ষ ১০ দেশের ৯টিই এশিয়ার। ২০১৭ সালে ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণা বলেছিল, পৃথিবীর ২০টি বড় নদী, যার অধিকাংশই এশিয়াতে সমুদ্রের ৬৭ ভাগ প্লাস্টিক দূষণের জন্য দায়ী। তবে সায়েন্স অ্যাডভান্স জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা বলছে, বড় নদী নয়, বরং ঘনবসতিপূর্ণ নগর এলাকা দিয়ে যেসব ছোট নদী গেছে, সেগুলোই মূলত এই প্লাস্টিক বর্জ্য নিয়ে যায় বড় নদীতে এবং পরে তা সমুদ্রে পড়ে।

প্রতি বছর সারা বিশ্বে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদিত হয়। এর প্রায় অর্ধেকই শপিং ব্যাগ, কাপ এবং প্যাকেজিং উপাদানের মতো এককভাবে ব্যবহারের পণ্য তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এই প্লাস্টিকগুলোর মধ্যে প্রতি বছর আনুমানিক ৮ মিলিয়ন থেকে ১০ মিলিয়ন টন নানাভাবে সাগর-মহাসাগরে নির্গত হয়। সময়ের পরিবর্তন এবং প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষের জীবনযাত্রা আধুনিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে বর্জ্য পদার্থের পরিমাণ। সময়টা এখন প্লাস্টিক পণ্যের এবং বর্তমানে পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ হলো- প্লাস্টিক। প্লাস্টিকের পণ্য ব্যবহারের পর যত্রতত্র ফেলে রাখা হচ্ছে। ফলে নানাভাবে এর বিশাল একটা অংশ চলে যাচ্ছে সমুদ্রে, যা খুব সহজেই বিপন্ন করছে, সেখানকার জীববৈচিত্র্যকে। প্লাস্টিক এখন মহাসাগরের গভীর তলদেশে ছড়িয়ে গেছে, ঢুকে পড়েছে তিমির মতো নানা প্রাণীর পেটে এবং মানুষের খাবারে। গবেষকদের এক হিসাবে দেখা গেছে, সমুদ্রের প্রতি এক বর্গকিলোমিটার এলাকাতে ১০০ গ্রাম করে এ ধরনের প্লাস্টিক বর্জ্য ভাসছে। সে অনুযায়ী হিসাব করে দেখা গেছে, গোটা বিশ্বের সমুদ্র এলাকাতে প্লাস্টিক বর্জ্যরে পরিমাণ এখন মোট ৪০ হাজার টনের বেশি। আর এসব বর্জ্যরে জন্য খুব সহজেই বিপন্ন হয়ে উঠছে পরিবেশ এবং সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য।

আগেই বলেছি সম্পদ যার, যে সম্পদ অর্জন করে তার দায়িত্ব সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ করার তার। আর প্রাকৃতিক সম্পদ যেহেতু মানবকুলের জন্য তাই এটা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও মানব কুলের। এ জন্য আমাদের সম্পদের গুরুত্ব বুঝতে হবে এবং সচেতন ও হতে হবে। দেশে এ মুহূর্তে নীল অর্থনীতি নিয়ে আরো বেশি সচেতনতা তৈরি করা দরকার। সামুদ্রিক সম্পদ কাজে লাগানোর লক্ষ্যে আমাদের দিগন্ত আরো বিস্তৃত করা দরকার। দেশের মানুষের জীবনে আর্থসামাজিক পরিবর্তন আনতে এবং টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য নীল অর্থনীতি বাংলাদেশের অন্যতম সম্ভাব্য সমাধান হতে পারে। বিভিন্ন সামুদ্রিক শিল্পে সুপ্রশিক্ষিত, দক্ষ ও শিক্ষিত মানবসম্পদ না থাকলে টেকসই ও গতিশীল নীল অর্থনীতিতে কোনো দেশের পক্ষেই সাফল্য অর্জন সম্ভব নয়। সরকারি-বেসরকারি কাঠামোগত সহযোগিতার দিকে দৃষ্টি দিয়ে নীল অর্থনীতিতে সাফল্যের জন্য সরকারের ভবিষ্যতের নীতি-কাঠামো হাতে নেয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি সমুদ্রগামী জাহাজ, মাছ ধরা ট্রলারসহ জেলেদের সচেতনতা বৃদ্ধি দরকার।

পরিশেষে বলতে চাই- পরিবারের প্রধান যেমন সম্পদ অর্জন করে সন্তান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। তেমনি প্রাকৃতিক সম্পদ সৃষ্টিকর্তাও মানব কল্যাণের জন্য অনেক সম্পদ দিয়েছেন। কিন্তু এই সম্পদ যেমন আমাদের ব্যাবহারের জন্য তেমনি আমাদের জীবন-জীবিকার জন্যও। তাই অন্যান্য সম্পদের মতো সমুদ্র সম্পদও আমাদের রক্ষা করতে হবে, টিকিয়ে রাখতে হবে, দূষণমুক্ত রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারি এবং বেসরকারিভাবে এগিয়ে আসতে হবে, তেমনি ব্যক্তি উদ্যোগেও। তাহলেই মানবসভ্যতা যেমন টিকে থাকবে, তেমনি সমুদ্রও রক্ষা হবে।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গবেষক।