আত্মবলিদানের উৎসব ঈদুল আজহা
আফতাব চৌধুরী
প্রকাশ : ১১ জুন ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
চান্দ্রমাসের শেষ মাস জিলহজের দশ তারিখ ঈদুল আজহা পালিত হয়ে থাকে। প্রতি বছরের মতো কালচক্রে আবর্তিত হয়ে বিশ্ব মুুসলিমের কাছে এ দিনটি নিয়ে এসেছে ত্যাগের উৎসব, আত্মবলিদানের উৎসব, খুশির উৎসব, ঈদুল আজহা। পরম স্রষ্টার কাছে সৃষ্টির নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ, তাঁর সান্নিধ্য, আর সন্তুষ্টি বিধানের উদ্দেশ্যে পিতা-পুত্রের চরম আত্মোৎসর্গের এক মহিমামণ্ডিত পুণ্য স্মৃতিকে স্মরণ করিয়ে দিতে ফিরে এসেছে কোরবানির উৎসব, বলিদানের উৎসব ঈদুল আজহা।
মুসলমানদের মুষ্টিমেয় কয়েকটি উৎসবাদির সবগুলোই বাহ্যিক আড়ম্বরশূন্য হলেও মূলত সেগুলো জ্ঞান, কর্ম আর ভক্তির ত্রিবেণী সঙ্গমের সম্মিলিত গতিধারায় চিরস্রোতা, প্রাণের স্পর্শে মহিয়ান। অন্যান্য সব অনুষ্ঠানের মতো এ ঈদুল আজহাও হচ্ছে মুসলমানদের বারোটি মাসব্যাপী গতিধারা অর্থাৎ জীবনসাধনার বাৎসরিক অভিব্যক্তি, তার আত্মিক উপাসনার বাৎসরিক জমা-খরচ। ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের বছরব্যাপী সাধন-ভজন তার মূল লক্ষ্যের দিকে কতটুকু সফলতার সঙ্গে এগিয়ে চলেছে আজকের এ ঈদুল আজহা হলো তারই এক হিসাব-নিকাশের দিন। সালতামামী শেষে শুরু হবে আবার নতুন হালখাতার পত্তন।
বাৎসল্য প্রেমকে আল্লাহর প্রেমের সঙ্গে মনের দাড়িপাল্লার নিরিখ করার জন্য আদি পিতা ইব্রাহিমের কাছে এলো সুকঠোর নির্দেশ- ‘তোমার প্রাণপ্রিয় বস্তুকে আমার নামে উৎসর্গ করো।’ প্রাণপ্রিয় বলতে তো ছিয়াশি বছরের বৃদ্ধ ইব্রাহিমের কাছে তার শেষ বয়সের সম্বল, নয়নমণি পুত্র ইসমাইল। চিরন্তন পিতৃহৃদয় ক্ষণিকের তরে উদ্বেলিত হয়ে উঠল। কিন্তু পাষ- নমরুদের অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হয়েও যিনি ছিলেন পরম সহিষ্ণু, বৃদ্ধবয়সে পাওয়া একমাত্র শিশুপুত্র ইসমাইলসহ প্রিয়তমা পত্নী হাজেরাকে যিনি পানিশূন্য, ধু-ধু মরুপ্রান্তরে নির্বাসিত করতেও দ্বিধাবোধ করেননি, তৌহিদ বা এক আল্লাহর উপর নির্ভরশীল ইব্রাহিমের হৃদয়ে এহেন দুর্বলতা কি শোভা পায়? আজন্ম খোদাপ্রেমে মাতোয়ারা, তাঁর কাছে পূর্ণ আত্মসমর্পণকারী পূর্ণপ্রেমিক ইব্রাহিমের কাছে বন্ধুর দেওয়া এ আদেশ পালনে কোনো বাহানাই খাটে না। মীনার জনহীন প্রান্তরে নয়নের মণি ইসমাইলকে নিয়ে তিনি হাজির হলেন। ব্যাকুল পিতার মুখের পানে চেয়ে ইসমাইল বললেন- আপনি পরম স্রষ্টার আদেশ অবলীলায় পালন করুন, নিশ্চয়ই আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মাঝে দেখতে পাবেন। নিজ হাতে আপন পুত্রকে কোরবানি করতে পিতৃহৃদয় কেঁপে উঠতে পারে সে আশঙ্কায় ইব্রাহিম নিজের দুটি চোখ কাপড়ে বেঁধে নিলেন। পরম পিতার উদ্দেশ্যে প্রার্থনা জানালেন- হে প্রভু, আমার জীবন, আমার মরণ, আমার নামাজ, আমার এ কোরবানি স্বীকার করো। নিশ্চয়ই তোমার অজানা, অদেখা কিছুই নেই। পুত্র ইসমাইলকে বালুকারাশির মাঝে উপুড় করে শুইয়ে ফেলা হলো। শানিত ছুরি উদ্যত করে আপন পুত্রের গলায় বসাতে প্রস্তুত হলেন, এরপর! কিন্তু না, আল্লাহর ইচ্ছা মানুষের রক্ত নয়, মানুষের শারীরিক কোরবানি নয়। আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে দুর্বলতা, দ্বিধাদ্বন্দ্বকে প্রশ্রয় না দিয়ে, কোনো দর কষাকষি না করে নির্মম হয়ে তাঁরই পথে প্রাণপ্রিয় পুত্রকে উৎসর্গ করতে দেখে খোদার আসন টলে উঠল। স্বয়ং আল্লাহ ঘোষণা করলেন- হে ইব্রাহিম, তুমি তো স্বপ্নাদেশ ঠিকই পালন করলে। এভাবেই সৎকর্মণ্ড পরায়ণশীলদের আমি পুরস্কৃত করে থাকি।
নিশ্চয়ই এটা ছিল একটি স্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তার পরিবর্তে কোরবানির জন্য একটি পশু তোমাকে দিলাম। একইসঙ্গে আমি তা পরবর্তীদের স্মরণেও রেখেছি।’ হযরত ইব্রাহিম পেছনে ফিরে দেখলেন, সত্যিই একটি সুন্দর কোরবানির পশু দাঁড়িয়ে আছে। আল্লাহর প্রতি সীমাহীন কৃতজ্ঞতা জানিয়ে এ পশুটিকে তিনি জবাই করলেন। এটিই হলো কোরবানি। শত শত বছর অতিক্রম হয়ে গেছে। কিন্তু সৃষ্টির কাছে স্রষ্টার সে চরম অগ্নিপরীক্ষায় বিজয়ী দুই পিতা-পুত্রের চরম আত্মত্যাগের কাহিনী বিশ্ব মুসলিম আজও ভোলেনি। পশু কোরবানির মাধ্যমে তাঁর সে ঐতিহাসিক ঘটনাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে যুগ যুগ ধরে পালন করে আসছে কোরবানির উৎসব ঈদুল আজহা। আজকের দিনটিও তার ব্যতিক্রম নয়। বিশ্বপ্রতিপালকের চরম আদেশকে দ্বিধাহীন চিত্তে অবলীলায় মেনে নিয়ে জীবন-মরণের মালিক এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহ সান্নিধ্য ও সন্তুষ্টির মোহনায় পৌঁছুতে ঐশীপ্রেমের মহাসাধক ইব্রাহিমের, আদিপিতা ইব্রাহিমের আত্মত্যাগে আদর্শে আজ ধর্মপ্রাণ মুসলিম হৃদয় উদ্বেলিত, বিশ্ব মুসলিম আজ পাগলপারা। পার্থিব জীবনের ভোগ লালশা ভুলে হৃদয়-মন আজ একই লক্ষ্যে কেন্দ্রীভূত। সবার কণ্ঠে আজ একই আওয়াজ লাব্বায়েক, আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক, লাব্বায়েক, লা-শরিকা লাকা লাব্বায়েক, ইন্নাল হামদা, অনিয়ামাতালাকা অল মুলকলা শরিকা লাকা লাব্বায়েক।
হে প্রভু তোমার দাস তোমার চরণে হাজির। তোমার কোনো অংশী নেই, তোমার দাশ তোমার আহ্বানে হাজির। হে প্রভু, এ দুনিয়ায় সব কিছুর মালিক তো তুমিই। হে অদ্বিতীয় মহান প্রতিপালক আমি হাজির। পবিত্র কাবার, সে মিনার পথে প্রান্তরে আজ প্রতিটি ভক্ত হৃদয় খুঁজে ফিরছে তাঁর পরম বান্ধবকে। আল্লাহর প্রেমের কাছে হার মেনে গিয়েছিল যার বাৎসল্য প্রেম, তুচ্ছ হয়ে গিয়েছিল পার্থিব সুখ-দুঃখ, কামনা-বাসনা, ভোগবিলাস, খোদাপ্রেম আত্মহারা সে মুসলিম জাতির পিতা ইব্রাহিমের জীবনাদর্শকে সামনে রেখে ইহকাল ও পরকালের পাথেয় সংগ্রহ করতে ব্যস্ত আজ প্রতিটি ধর্মপ্রাণ মুসলিম।
আজকের এ পুণ্যময় দিনে বলতে কষ্ট হয়, বুকে হাত দিয়ে বলা কঠিন আমরা আত্মবিস্মৃত মুসলমানরা উৎসবের মূল উপাদানস্বরূপ তার অন্তর্নিহিত ভাবধারাকে কতটুকু মনপ্রাণ দিয়ে পালন করছি? নজরুলের ভাষায় প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়- আল্লাতে যার পূর্ণ ইমান কোথা সে মুসলমান?
অনেকে মনে করেন যে, পশু বলিই হচ্ছে ঈদুল আজহার মূল লক্ষ্য, একমাত্র করণীয়। ঈদুল আজহায় পশু কোরবানির বিধান আছে সত্যি কিন্তু, নিছক পশু কোরবানিই এর প্রধান ও অপরিহার্য অঙ্গ হতে পারে না। কোরবানির এ উৎসব মুসলিম জাহানে নিছক পশুবধের উৎসব নয়। প্রতীকী হিসেবে এ পশু কোরবানির মুখ্য উদ্দেশ্য হলো এর মধ্য দিয়ে আমাদের এ কুলষিত মানবমনের সমস্ত পশু সত্তাকে বলি দেওয়া। আল্লাহ তাই তো ঘোষণা করেছেন- কোরবানির মাংস বা রক্ত কোনোকিছুই আমার কাছে পৌঁছায় না। আমার কাছে যা পৌঁছায় তা হলো তোমাদের ধর্মভয়।
আজকাল ঈদুল আজহার কয়েকদিন আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় কোরবানির পশু কেনার ধুম। কার চাইতে কে বেশি দাম দিয়ে নজরকাড়া নাদুস-নুদুস পশু কিনে অর্থের কৌলিন্য আর বাহাদুরি লুটবে তার প্রায়াস আর প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। অথচ কেউ একবারও চিন্তা করেন না যে রক্তমাংসের গড়া একটি প্রাণীর হত্যা সংগঠনই কোরবানির মূল কথা নয়। বিদ্রোহী কবির ভাষায়- মনের মাঝে পশু যে তোর, আজকে তারে কর জবেহ। সে কথা কি একবারও আমরা চিন্তা করে থাকি?
প্রাণী কোরবানির সঙ্গে আমাদের মনের গভীরে কামনা-বাসনা, লোভ-লালসা, মদণ্ডমাৎসর্যের যে পশুকে আমরা দিনের পর দিন প্রতিপালন করে আসছি রিপুসম সে পশুকে অমানবিক পশুসত্তাকে কি আমরা সত্যিই কোরবানি দিতে পেরেছি? তাই তো দেখা যায় আজকাল ঈদুল আজহা নিছক পশু কোরবানির উৎসব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে রক্তমাংস যথেষ্ট আছে, আছে উৎসবের নামে লোক দেখানো বাহ্যিক আড়ম্বর, প্রচ্ছন্ন অহমিকা তামসিক ভোগবিলাসিতার প্রশ্রয়। শুধু নেই মহাসাধক পিতা ইব্রাহিমের আদর্শের সে অভূতপূর্ব চিরভাস্কর প্রেরণা, যা ছিল একসময়ে এ ঈদুল আজহা উৎসবের একমাত্র মূল লক্ষ্য।
আজকের এ মহিমাময় দিনটিতে আমাদের শপথ হোক- হৃদয়ের শানিত কৃপাণ দিয়ে মনের মীনা প্রান্তরে আমাদের কালিমালিপ্ত হৃদয়কে উদ্ভাসিত ও কলুষমুক্ত করার।
হে ঈদুল আজহা, দৈহিক মানসিক সব দিক থেকে বিপর্যস্ত এ মানবম-লীকে বর্তমানে এ চরম দূরবস্থা থেকে মুক্ত করতে সে অতীত আদর্শের বাস্তব প্রতিফলন ঘটাতে আত্মত্যাগ, প্রেম আর কল্যাণের সিঁড়ি বেয়ে মাটির পৃথিবীতে স্বর্গের সুষমা নিয়ে বারবার তুমি ফিরে এসো ত্যাগের উৎসব। মহামিলনের উৎসব, ঈদুল আজহা।