ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ট্যানারি শিল্পের আধুনিকায়ন

সংকট কাটাতে সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন
ট্যানারি শিল্পের আধুনিকায়ন

আগামী ১৭ জুন দেশে পবিত্র ইদুল আজহা উদযাপিত হবে। অনেকের কাছে এই উৎসবকে কোরবানির ঈদ হিসেবে পরিচিত। এই ঈদে সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হচ্ছে পশু কোরবানি। আমাদের দেশের সারা বছরে যে পরিমাণ পশুর চামড়া সংগৃীত হয় তার অধিকাংশ আসে কোরবানির ঈদের সময়। সারাদেশ থেকে কোরবানির চামড়া ঢাকার সাভার উপজেলার হেমায়েতপুরে ট্যানারি শিল্প নগরীতে নিয়ে আসা হয়। সেখানে চামড়া আশিংকভাবে ফিনিশড চামড়ায় পরিণত করে বিদেশে পাঠানো হয়। এই শিল্প নগরীতে যেসব ট্যানারি রয়েছে, সেখানে আধুনিক প্রক্রিয়াকরণের ছাপ খুব একটা নেই। ট্যানারিগুলোতে দূষণ রোধের উন্নত কোনো ব্যবস্থাও নেই। ফলে ওই এলাকায় চরম মাত্রায় পরিবেশ দূষণের ঘটনা ঘটে। ট্যানারি শিল্পের কারণে দূষিত হচ্ছে- সংশ্লিষ্ট এলাকার জলাশয় ও সামগ্রিক পরিবেশ। এ চামড়া শিল্পের বিষাক্ত বর্জ্য নদী-নালাসহ পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে প্রতিনিয়ত বাড়ছে দূষণ। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের অভাবে এ শিল্প হারাচ্ছে বড় বাজার। হাজারীবাগ থেকে সাভারে চামড়া নগরী স্থানান্তরের পর এই শিল্পের উন্নতি হবে বলে আশা করা হলেও বাস্তবে তা ঘটেনি। যার ফলে খেসারত দিচ্ছে পুরো খাত। বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে চামড়া খাতের রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ১ হাজার ৩৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আয় এসেছে ৮৯৫.২৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের আয়ের তুলনায় ১৪.৩৮ শতাংশ কম। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের জুলাই পর্যন্ত আয় এসেছিল ৮৩২.৩৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। রপ্তানি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্বের বড় ব্র্যান্ডগুলোর কাছে ভালো দামে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য বিক্রি করতে হলে বৈশ্বিক সংস্থা লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ থাকতে হয়। বৈশ্বিক বাজারের কথা মাথায় রেখে ঢাকার হাজারীবাগ থেকে চামড়া শিল্পনগরী স্থানান্তরের জন্য ২০০৩ সালে একটি প্রকল্প নেয় সরকার। সে অনুযায়ী ২০০ একর জমি নিয়ে সাভারের হেমায়েতপুরের হরিণধরায় গড়ে ওঠে চামড়া শিল্পনগরী।

বর্তমানে এখানে ১৪১টি ট্যানারি রয়েছে। যেখানে ৫৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ে কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) তৈরি করা হয়। তবে সেটি পুরোপুরি কার্যকর না হওয়ায় ট্যানারি প্রতিষ্ঠানগুলো এখনও এলডব্লিউজি সনদ পাচ্ছে না। ফলে সার্বিক রপ্তানিতে পিছিয়ে পড়ছে এই খাত। বিভিন্ন সময় সংশ্লিষ্টরা কার্যকরী উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানালেও সমাধান হয়নি। প্রতিনিয়তই ট্যানারির বর্জ্যে পার্শ্ববর্তী ধলেশ্বরী নদীসহ নানাভাবে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। যা ঈদুল আজহার সময় বেড়ে যায় কয়েকগুণ। সাভারের চামড়া শিল্পের বিদ্যামান সংকট সমাধান করার জন্য স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে কখনো কখনো আলাপ-আলোচনা হলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। পরিবেশগত সমস্যা নিয়ে মালিক পক্ষের অভিযোগ হচ্ছে, তারা পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে সনদ পাচ্ছে না। আর পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য হচ্ছে ট্যানারিগুলো শিল্পের মান বজায় রাখতে না পারলে সেক্ষেত্রে সনদ দেয়া সম্ভব নয়। বাংলাদেশ থেকে চীনে যে শতকরা ৮০ ভাগ লেদার যাচ্ছে, তা মূলত ক্রাস্ট লেদার। সেগুলোকে বিভিন্নভাবে প্রক্রিয়াজাতকরণ করে ফিনিশ লেদারে পরিণত করে বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করছে চীন। অথচ বাংলাদেশ নিজেই যদি আধুনিক ট্যানারি শিল্প গড়ে তোলার মাধ্যমে ফিনিশ লেদার রপ্তানি করতে পারত, তাহলে আরো বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হতো। রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে ট্যানারিশিল্পকে সাভারে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে ৭ বছর আগে। তবে অবস্থার বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয়নি। কমপ্লায়েন্সের অভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে দেশীয় চামড়ার মূল্য কমেছে। আবার ট্যানারির শ্রমিকরাও ন্যূনতম মজুরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। শ্রমিকদের আবাসন ও চিকিৎসাসহ তাদের জীবন-যাপনের মৌলিক চাহিদা পূরণের নেই যথাযথ ব্যবস্থা। শ্রমঘন ও ঝুঁকিপূর্ণ শিল্প এলাকাটির ১৫৫টি প্লটে প্রায় ২০০ ট্যানারিতে কর্মরত ৮ হাজার শ্রমিকের জীবন অনেকটা দুর্বিষহ। মজুরি বোর্ডের নির্ধারিত গ্রেড নয়, অভিজ্ঞতার আলোকে তাদের বেতন নির্ধারিত হলেও ওভারটাইম ও ছুটি সুবিধা সীমিত। নেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা। সন্তানদের শিক্ষার ব্যবস্থাও ঠিকমতো করতে পারেন না তারা। ট্যানারিগুলোতে স্থায়ী ও অস্থায়ী দুই ধরনের শ্রমিক কাজ করেন। ফড়িয়া বা দালালরা বাইরে থেকে চামড়া এনে বিভিন্ন ট্যানারিতে প্রক্রিয়াজাত করেন। তারা বেশিরভাগই অস্থায়ী শ্রমিকদের কাজে লাগান। অন্যদিকে অনেক কারখানাও অস্থায়ী শ্রমিকদের ব্যবহার করেন। শিক্ষানবীশ শ্রমিকদের কোনো বেতন দেওয়া হয় না। হাত খরচ হিসেবে কিছু টাকা তাদের দেওয়া হয়। ট্যানারিভেদে স্বল্প অভিজ্ঞ শ্রমিকদের ৭ হাজার থেকে ৯ হাজার ও অভিজ্ঞ শ্রমিকদের ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা বেতন দেওয়া হয়। ট্যানারিগুলোতে নারী শ্রমিকের সংখ্যাও নগণ্য। মালিক পক্ষের সঙ্গে শ্রমিক সংগঠনের যে সব চুক্তি হয়, তা সব সময়ই পুরোপুরি চুক্তি বাস্তবায়ন হয় না। ফলে শ্রমিকরা তাদের প্রাপ্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ন্যূনতম মজুরি সংক্রান্ত চুক্তির পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলে শ্রমিকদের বিদ্যমান সংকট দূর হতো। ২০১৭ সালে বিসিকের নেতৃত্বে রাজধানীর হাজারিবাগের ট্যানারিগুলো হেমায়েতপুরে চলে আসার পরের বছরই ট্যানারি শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করে মজুরি বোর্ড। যেখানে ট্যানারি শ্রমিকদের দক্ষতার ওপর ভিত্তি করে ৫টি গ্রেডে বেতন নির্ধারণ করা হয়। শ্রমিকদের সর্বনিম্ন বেতন নির্ধারণ করা হয় ১৩ হাজার ৫০০ টাকা। তবে ৬৯ শতাংশ ট্যানারি কোনো গ্রেডিংয়ের ধার ধারে না। শ্রমিকরা ১০ থেকে ১৫ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে কাজ করেও ‘স্থায়ী’ হতে পারছে না। দীর্ঘ সময় অস্থায়ী হিসেবে আখ্যায়িত করে স্থায়ী শ্রমিকের প্রাপ্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। চুক্তির শর্ত সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হলে কোনো শ্রমিকেরই অস্থায়ী শ্রমিক হিসেবে থাকার কথা নয়। কমপ্লায়েন্সের অভাবে আমাদের উৎপাদন কমেছে। ইউনিট প্রাইস অনেক কমে গেছে। ২০১৭ সালের আগে দেড় ডলারে চামড়া রপ্তানি করতাম। সেটা এখন ৭০ সেন্টে রপ্তানি করতে হচ্ছে। চামড়ার মূল্য নির্ধারণ আমরা করছি না।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির জরিপ বলছেন, শ্রমিকদের ৪১ দশমিক ৯ শতাংশ শ্বাসকষ্ট জনিত রোগ, ৬৪ দশমিক ৮ শতাংশ অ্যালার্জি, ২৭ দশমিক ৬ শতাংশ চর্মরোগ ও ৩২ দশমিক ৪ শতাংশ চোখের সমস্যায় ভোগেন। হাসপাতাল নির্মাণে মালিকরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেও হাসপাতাল করে দেওয়া হয়নি। একই অবস্থা শিক্ষাব্যবস্থার। সাভারে আসার পর মালিকরা শ্রমিকদের জন্য বাসস্থান এবং তাদের সন্তানদের জন্য স্কুলসহ সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। হাতে গোনা দুই একটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া কেউই মজুরি বোর্ডের নিয়মনুযায়ী বেতন দেয় না। মালিকরা লোকসানের কথা বলেন। অথচ ট্যানারি ব্যবসা করে অনেক মালিকের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে। অভাবের তাড়নায় অনেক শ্রমিক তাদের ছেলেমেয়েকে কাজে লাগিয়ে দেন। চর্মরোগ থেকে শুরু করে এমন কোনো রোগ নেই, যা ট্যানারি শ্রমিকদের হয় না। চামড়া প্রক্রিয়াকরণ করার ক্ষেত্রে প্রায় শতাধিক কেমিক্যাল ব্যবহার হয়। এসব কেমিক্যালের প্রতিটি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ফলে শ্বাসকষ্ট, হাইপারটেনশন এসব রোগ শ্রমিকদের ঘরে ঘরে। তবে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ দাবি করেছেন, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, সার্টিফিকেশনের অভাবে চামড়ার মূল্য না পাওয়ায় ট্যানারিগুলো ধুঁকছে। তিনি বলেন, আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ কমপ্লায়েন্স। এর অভাবে আমাদের শ্রমিকরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করতে আমরা নিজেরা ইটিপি করার চেষ্টা করছি। কিন্তু বিসিক ইটিপি ঠিক মতো করছে না, আবার আমাদের ইটিপি প্রস্তাবনায় অনুমোদন করছে না। দেশের চামড়া শিল্পের বিদ্যমান সংকট কাটিয়ে উঠতে সংশ্লিষ্ট সবার সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত