মনের পশু দাও কোরবানি

অলোক আচার্য

প্রকাশ : ১৪ জুন ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

‘চাহি না ক গাভি দুম্বা উট/কতটুকু দান? ও দান ঝুট/চাই কোরবানি, চাই না দান/রাখিতে ইজ্জত ইসলামের/শির চাই তোর, তোর ছেলের/ দেবে কি?’ কে আছ মুসলমান- এই কথাগুলো বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইলামের ‘শহিদি-ঈদ’ কবিতার অংশবিশেষ। ত্যাগের মহিমা নিয়ে বছর ঘুরে আবার এসেছে পবিত্র ঈদুল আজহা। ঘরে ঘরে সেই প্রস্তুতি চলছে। কোরবানির পশু কেনাবেচা চলছে পুরোদমে। বন্যা পরিস্থিতি এখনো তেমন অবনতি না হলেও সিলেটে উজানের ঢলে বন্যা হয়েছে। নদনদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। রমজানের ঈদের পর আনন্দে মাতিয়ে দিতে কোরবানির ঈদ এসেছে আগামী সোমবার দেশব্যাপী উদযাপিত হবে পবিত্র ঈদুল আজহা। আসলে ঈদ মানেই খুশি। সবার মাঝেই এই আনন্দ বিরাজ করবে। দেশজুড়ে সবাই ব্যস্ত কেনাকাটায়। বাবা-মা তার সন্তানের জন্য পছন্দের এক বা একাধিক পোশাক কিনতে ব্যস্ত। যাদের ন্যূনতম সামর্থ্য আছে, তারাই দোকানে যায় পোশাক কিনতে। কিন্তু যাদের একেবারেই কেনার সামর্থ্য নেই বা অভিভাবকহীন তাদের অবস্থা ভাবা দরকার। আবার পছন্দের পোশাকের দাম বেশি হলে অভিভাবকের আয়ত্তে থাকে না। তাছাড়া গত ২ থেকে ৩ বছরে যুদ্ধ এবং প্রাকৃতিক কারণে পৃথিবীতে আর্থিক খাতে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এর ফলে বহু মানুষের আর্থিক সক্ষমতা কমেছে। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের ওপর খরচের চাপ বেড়েছে। বিশ্বজুড়েই মূল্যস্ফীতির আঘাত চলছে। আমাদের দেশও তার ব্যতিক্রম নয়। একদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অন্যদিকে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণেও মানুষের আর্থিক সক্ষমতায় আঘাত এসেছে। তবুও সবাই সামর্থ্যমতো আনন্দ উদযাপনের চেষ্টা করবে- এটাই স্বাভাবিক। কোরবানির শিক্ষা আমরা নিজেদের জীবনে কতটুকু কাজে লাগাতে পারব জানি না। আল্লাহর উদ্দেশ্যে পশু কোরবানির সঙ্গে সঙ্গে নিজের মনের ভেতরের হিংসা, ক্রোধ, ধ্বংস রয়েছে, সেসবও শেষ করতে হবে। যদি সমাজে হিংসা, বা পশুত্ব বজায় থাকে, তাহলে এ শিক্ষা কোনো কাজেই আসবে না। কোরবানির শিক্ষা হলো মনের সেই পশুকে জবেহ করা এবং নিজেকে খোদার কাছে আত্মসমর্পণ করা। ঈদুল আজহা তাই আত্মত্যাগের দিন। নিজেকে মানুষ প্রমাণ করতে পশুত্বকে শেষ করার সময় এসেছে। মানুষ আজ মনুষ্যত্ব হারিয়ে পশুত্বকে বেছে নিচ্ছে, সেই পশুকেও শেষ করতে হবে। সমাজ আজ বিপথে ধাবিত হচ্ছে। না হলে উৎপলের মতো একজন শিক্ষককে নিজের ছাত্রকে শাসন করার অপরাধে সেই ছাত্রের দ্বারাই নির্মমভাবে মরতে হতো না। তাই শুধু একটি পশু জবাই করাই আমাদের মূল কথা নয়। নিজেকে শুদ্ধ করার যে শিক্ষা দেয় তা গ্রহণ করতে হবে। একটি কলুষমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সামর্থ্যহীন শিশু বা অভিভাবকের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। আবার অনেকের কোরবানি দেওয়ার সামর্থ্য নেই। আমাদের বাড়ির পাশেই হয়তো এমন অসহায় মানুষ রয়েছে। বিশেষত যেসব অঞ্চলে বন্যাক্রান্ত ছিল বা আছে, সেসব এলাকার অনেকেই এখন নিজের ঘর এবং ক্ষতিগ্রস্ত জায়গাগুলো ঠিক করতেই হিমশিম খাচ্ছে। তাদের কাছে কোরবানি গোশত পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। রয়েছে এতিম ও অসহায় শিশু, বয়স্ক যাদের দেখভাল করার কেউ নেই। যদিও দেশে অনেক মানবিক সংগঠন রয়েছে, যারা ঈদের অসহায় শিশুদের পাশে দাঁড়ায়। ঈদুল আজহাতেও নতুন পোশাক কেনা হয়। অনেকের সেই সামর্থ্য নেই। তাদের জন্য ভালো খাদ্যের ও পোশাকের ব্যবস্থা করতে হবে। সামর্থ্যবান সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে। অনেকেই আছেন যাদের মুখ ফুটে বলেন না; কিন্তু কার্যত কোনো উপায় নেই, তাদের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। এর মধ্যেই এ ধরনের দু’একটি ঘটনা মনে দাগ কাটে। ঈদ সবার জন্য। ঈদ সবার সঙ্গে আনন্দ ভাগ করে আনন্দ করা। ঈদ মানে মানবতা। একটি শিক্ষা। সেই শিক্ষা মহত্ত্বের, মানবতার। কেউ কেউ হয়তো নতুন পোশাক কিনতেও পারবে না। বিশেষ করে রাস্তায় বেড়ে ওঠা শিশুগুলো। যাদের তিনবেলা খাওয়ারই নিশ্চয়তা নেই। যারা দিনের বেশিরভাগ সময়ই খালি গায়ে থাকে। যারা তীব্র শীতে ফুটপাতে চটের বস্তা গায়ে দিয়ে ঘুমায়। ওরা কীভাবে নতুন পোশাক কিনবে? কোরবানির সামর্থ্যও নেই ওদের। বর্তমান সমাজে কোরবানির প্রকৃত তাৎপর্য উপলব্ধি করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমিত্ব, অহমিকা, ব্যক্তিস্বার্থই যদি আমরা আল্লাহর জন্য বিসর্জন দিতে না পারি, তাহলে কোরবানির প্রকৃত অর্থ অনুধাবন অসম্ভব। একটি শিক্ষা যা জীবনের উদ্দেশ্যকে বদলে দিতে পারে। এটা না করতে পারলে সমাজে বিদ্যমান অশান্তি ও সমস্যাদি থেকেও মুক্তি পাব না। আজ ভাই-ভাইয়ের মধ্যে বিবাদ, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিবাদ, প্রতিবেশীর সঙ্গে বিবাদ, পিতা-মাতার সঙ্গে বিবাদ, সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ, নৈতিক অবক্ষয় এসব দূর করতে না পারলে সমাজ কোনোদিন আন্তরিক ও মানবিক হবে না। ঈদের দিনেও রাস্তায় বহু নিঃস্ব সহায়-সম্বলহীন মানুষের দেখা পাওয়া যায়। যদি এদের কষ্ট দূর করা যায়, অর্থাৎ তাদের জন্য স্থায়ী কোনো সমাধান করা যায়, তাহলে ঈদের আনন্দ আরো বেড়ে যাবে। ঈদে তাদের পাশে দাঁড়ানোও একটি নির্মল আনন্দের বিষয়। কারণ ঈদ আমাদের ত্যাগের শিক্ষা দেয়। আমরা যারা একটু সামর্থ্যবান রয়েছি, তারা চাইলেই ঈদে একটি পোশাক কিনতে না পারা শিশুকে নতুন পোশাক কিনে দিতেই পারি। এই তো প্রকৃত আনন্দ। অন্যের মুখে হাসি ফুটলে তবেই তো স্বার্থকতা আসে। এ সমাজে আজও শ্রেণি বৈষম্য বিদ্যমান। যদি বিত্তশালীরা সকলেই হতদরিদ্রদের সাহায্য করে, তাদের পাশে দাঁড়ায়, তাহলে সমাজে প্রভেদ থাকবে না। আমাদের মনের সকল জীর্ণতা, গ্লানি, হীনতা, নীচতা প্রভৃতি দূর করতেই আসে ঈদ। আমরা কি সকলে সেই পশুত্বকে কোরবানি করে সমাজকে বিশৃঙ্খলমুক্ত করতে পারব? যদি না পারি তাহলে আমরা নিজেদের জীবনে কোরবানি ঈদের অর্থ কাজে লাগাতে ব্যর্থ। সকল শ্রেণি বৈষম্য সকল ভেদাভেদ ভুলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একসঙ্গে চলার শিক্ষা জাগ্রত করে ঈদ। মানুষে মানুষে আজ যে হানাহানি, মারামারি বা সংঘাত, আজ মানুষের মনে জায়গা করেছে হিংসা, ক্রোধ, মানুষের মন আজ ভরে গেছে অহংকারের কাঁদায়, সেসব মুছে দিয়ে সেখানে শান্তির বাণী, সঠিক পথের দিশা দেখাতেই আসে পবিত্র এ মুহূর্ত। পরিশেষে বিদ্রোহী কবির সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলতে চাই, মনের পশুরে দাও কোরবানি। তবেই তো আমরা মানুষ হয়ে গড়ে উঠতে পারব। আমাদের সামাজিক, পারিবারিক ও জাতীয় জীবনে ঈদুল আজহা আনন্দ নিয়ে আসে। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে, ছোট-বড়, ধনী-গরিব এক কাতারে শামিল হওয়ার দৃষ্টান্ত ঈদ উৎসবে পরিলক্ষিত হয়। ঈদুল আজহার শিক্ষাই হচ্ছে- আত্মত্যাগে উজ্জীবিত হওয়া, মানবিক কল্যাণ সাধন করা, সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষা করা এবং সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে আরো সুদৃঢ় করা। পবিত্র ঈদুল আজহা প্রতি বছর আমাদের জন্য বয়ে আনে আত্মত্যাগের মহান বার্তা। এতে জড়িয়ে থাকা কর্তব্যবোধ, সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্ব বোধের বৈশিষ্ট্য। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সম্প্রীতির ভাবটা এখানে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ঈদুল আজহার শিক্ষায় উজ্জীবিত হলে আমরা সব পাপ, বঞ্চনা, সামাজিক অনাচার ও রিপুর তাড়না বা শয়তানের অসওয়াসা থেকে নিজেদের রক্ষা করতে সক্ষম হব।

প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

ই-মেইল : [email protected]