ঢাকা ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ২৩ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কুষ্ঠজনিত সংকট মোকাবিলায় বাজেটে পদক্ষেপ জরুরি

মো. সাজেদুল ইসলাম
কুষ্ঠজনিত সংকট মোকাবিলায় বাজেটে পদক্ষেপ জরুরি

যদিও কুষ্ঠ অন্যতম একটি জাতীয় স্বাস্থ্য সমস্যা, এই রোগের কারণে আক্রান্ত ব্যক্তিরা শারীরিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মানসিক সমস্যার মুখোমুখি হন। কুষ্ঠ নিয়ন্ত্রণে সফলতা পাওয়া গেলেও বাংলাদেশ এখনো কুষ্ঠমুক্ত দেশ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।

কুষ্ঠ মানবজাতির ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাচীন ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ। বাংলাদেশে এটি এখনো একটি জনস্বাস্থ্য সমস্যা। কুষ্ঠ একটি দীর্ঘস্থায়ী সংক্রামক রোগ, যা প্রাথমিকভাবে শনাক্ত এবং উপযুক্ত চিকিৎ্সিা করা হলে এটি নিরাময়যোগ্য।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, কুষ্ঠ নির্মূলের বিষয়টি আমাদের জাতীয় স্বার্থে জাতীয় বাজেটে যথাযথ বিবেচনার দাবি রাখে, কারণ এটি আমাদের জন্য ব্যাপক একটি নেতিবাচক অর্থনৈতিক প্রভাব রয়েছে। সরকারের ২০৩০ সালের মধ্যে কুষ্ঠমুক্ত দেশ গড়ার ঘোষণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এ লক্ষ্যে দেশে ব্যাপক কুষ্ঠরোগবিরোধী কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। কুষ্ঠ কর্মসূচির জন্য বৈদেশিক অর্থায়ন দিন দিন কমছে। তাই কুষ্ঠমুক্ত দেশ গড়ার লক্ষ্যমাত্রা র্অজনের জন্য সরকারের তরফ হতে উদ্যোগ অপরিহার্য।

তারা জানান, কুষ্ঠরোগের প্রভাব উল্লেখযোগ্য। কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা প্রতিবন্ধকতা, কুষ্ঠরোগ সম্পর্কিত কুসংস্কার এবং কুষ্ঠ রোগের উচ্চ ব্যয়ের কারণে আয় হ্রাস এবং বেকারত্বের মুখোমুখি হন। কুষ্ঠ রোগীরা সামাজিক কুসংস্কারের সম্মুুখীন হন, যা তাদের প্রতিবেশী এবং এমনকি তাদের পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে তাদের রোগ লূকিয়ে রাখতে উদ্বুদ্ধ করে, ফলে তারা চিকিৎসা খরচ বহন করা এবং আয়মূলক কাজে সক্ষমতা হারানোর মতো পরিস্থিতির সম্মুুখীন হন।

সময়মতো চিকিৎসা না করা হলে কুষ্ঠরোগ এ প্রায়শই হাত, পা, চোখ এবং মুখের প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। এই পরিস্থিতি কুষ্ঠ-সম্পর্কিত কুসংস্কারের সংমিশ্রণে আক্রান্ত ব্যক্তিদের দৈনন্দিন কাজকর্ম এবং আয়মূলক কাজগুলো সম্পাদন করার শারীরকি ক্ষমতাকে সীমিত করে। অতএব, কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে অসুবিধার সম্মুখীন হন এবং তাদের শিক্ষার সুযোগ হ্রাস পায়। এইভাবে, কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য একটি বড় অর্থনৈতিক প্রভাব ফেলে।

তাই কুষ্ঠমুক্ত দেশ গড়তে হলে কুষ্ঠবিরোধী কর্মসূচি হাতে নেওয়া প্রয়োজন। এই সংক্রান্ত কর্মসূচি সফল করার জন্য জাতীয় বাজেেট পর্যাপ্ত আর্থিক বরাদ্দ থাকা জরুরি।

লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য আমাদের নিয়মিত কন্টাক সার্ভে পরিচালনা করতে হবে, যাতে নতুন কুষ্ঠ রোগীর সন্ধান পাওয়া যায় এবং তাদের সময়মতো চিকিৎসার আওতায় আনা যায়। এ বিষয়ে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের মাঠপর্যায়ের কর্মচারীদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের কাজে লাগানো যেতে পারে।

গত ২৪ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে যে, দেশে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৩ হাজার নতুন কুষ্ঠ রোগী শনাক্ত হচ্ছে। এর অর্থ হলো রোগের সংক্রমণ আছে। তাই এটি প্রতিরোধ করা প্রয়োজন। একটি গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে, সিঙ্গেল-ডোজ রিফামপিসিন (এসডিআর) আক্রান্ত ব্যক্তিদের আশপাশের লোকজনের মধ্যে কুষ্ঠ রোগ হওয়ার ঝুঁকি কমাতে কার্যকর পদ্ধতি। কুষ্ঠরোগ প্রতিরোধের জন্য সারাদেশে এটাকে আরো সম্প্রসারিত করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে কুষ্ঠ নিয়ে কর্মরত অধিকার কর্মীরা মনে করেন।

আমাদের দেশের হাসপাতালগুলোতে কুষ্ঠ রোগের চিকিৎসা সেবার ঘাটতি রয়েছে। সরকারের উচিত হাসপাতালগুলোর সক্ষমতা জোরদার করা, যাতে এই ধরনের জটিলতার প্রয়োজনীয় সেবা সেখানে পাওয়া যায়।

এই রোগকে ঘিরে সমাজে এখনো কুসংস্কার প্রচলন রয়েছে, যা শুধুমাত্র এর চিকিৎসাই ব্যাহত করছে না, কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের অধিকারও ব্যাহত করছে। তাই সারাদেেশ কুষ্ঠ নিয়ে ব্যাপক সচেতনাতামূলক প্রচারণা চালানো উচিত। তৃণমূল র্পযায়ে সচেতনাতা বৃদ্ধির জন্য কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে কর্মরত কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের এই কাজে ব্যবহার করা উচিত।

কুষ্ঠরোগ সম্পর্কে সচেতনাতা বৃদ্ধিতে গণমাধ্যমও গুরুত্বপূর্ণ ভূূমকা পালন করতে পারে।

কুষ্ঠ নিয়ন্ত্রণ কমপক্ষে তিনটি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে অবদান রাখে : এসডিজি-৩ (মানুষের জন্য সুস্বাস্থ্য এবং মঙ্গল, যার মধ্যে রয়েছে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা বা ‘কাউকে পিছিয়ে না রাখা), এসডিজি-১০ (বৈষম্য হ্রাসকরণ) এবং এসডিজি-১৭ (লক্ষ্যের জন্য অংশীদারিত্ব)। বাংলাদেশ এখন এসডিজি অর্জনে কাজ করছে। আমরা যদি কুষ্ঠ নির্মূল করতে ব্যর্থ হই, তাহলে এই এসডিজি অর্জন করা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে।

আমাদের এমন পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা সম্পদ, সেবা, অধিকার এবং মর্যাদা প্রাপ্তির বিষয়ে সমান অধিকারসহ সাধারণ সমাজে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে, যা পরিশেষে কুষ্ঠমুক্ত দেশ গঠনে সহায়ক হবে। কুষ্ঠবিরোধী কর্মসূচির অংশ হিসেবে আমাদের বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। যেমন- প্রাথমিক অবস্থায় রোগী শনাক্তকরণ, কুষ্ঠবিষয়ক সচেতনতা তৈরি করা, কুষ্ঠ আক্রান্ত ব্যক্তিদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন, কুষ্ঠ ও এর জটিলতা ব্যবস্থাপনার সুবিধা নিশ্চিত করা এবং প্রতিবন্ধিতা প্রতিরোধ, কুসংস্কার দূর করা এবং মানবাধিকার নিশ্চিত করা।

বাংলাদশে তার জাতীয় কুষ্ঠ কৌশল (২০২৩-২০৩০) প্রণয়ন করেছে, যা একটি শক্তিশালী জাতীয় কুষ্ঠ কর্মসূচি, সমন্বিত কেস ব্যবস্থাপনা এবং সম্প্রদায়ভিত্তিক অন্তর্ভুুক্তমূলক বাস্তবায়নে এর ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। এই কৌশলটির সফল বাস্তবায়নের জন্য বাজেটে পর্যাপ্ত অর্থের ব্যবস্থা করা এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

নতুন কুষ্ঠ কেস শনাক্তকরণ উদ্যোগের জন্য অর্থের সংস্থান সংক্রান্ত সমর্থন ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। তহবিলের এই ঘাটতির কারণে সক্ষমতা বৃিদ্ধ, মাল্টি ড্রাগ থেরাপির চিকিৎসার সময় এবং পরে রোগীর ফলোআপ এবং জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কুষ্ঠ সম্পর্কিত কার্যক্রমের ওপর প্রভাব ফেলছে।

যদিও বাংলাদেশে কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে কোনো বৈষম্যমূলক আইন নেই, তবে সামাজিক, অর্থনৈতিকি, শিক্ষাগত এবং কর্মসংস্থানের সুযোগের মতো বিষয়গুলোতে তাদের অন্তর্ভুক্তি এখনো একটি চ্যালঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। এটি মোকাবিলার জন্য কুষ্ঠ বিশেষজ্ঞরা ব্যাপকভাবে কুষ্ঠ-সংক্রান্ত শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবায় এর অন্তর্ভুক্তিকরণ, কমিউনিটি কাউন্সিলিং এবং সক্রিয় বৈষম্যবিরোধী আইন প্রণয়নের ওপর জোর দেন।

কুষ্ঠ নির্মূল কর্মসূচি গ্রহণ করা গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়, কিন্তু বেশ কিছু বিষয় এতে বাধা হিসেবে কাজ করছে। যেমন কুষ্ঠ কর্মসূচিকে কম গুরুত দেওয়া হয়, কর্মসূচির জন্য অর্থের ঘাটতি এবং কর্মীদের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার কারণে নতুন কুষ্ঠ কেস শনাক্ত করার উদ্যোগের অভাব, সচেতনতা বৃদ্ধিমূূলক কার্যক্রমের অভাব এবং কর্মচারী ও অন্যান্য সেবাপ্রদানকারীদের প্রশিক্ষণের সুযোগ কম থাকা।

কুষ্ঠমুক্ত দেশ গড়ার জন্য প্রথমে ২০৩০ সাল পর্যন্ত একটি সুনির্দিষ্টি পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন। পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে কর্র্মীর সংখ্যা বৃদ্ধি এবং তাদের সক্ষমতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করা, সেবা প্রদানকারী জনগোষ্ঠীর (যেমন- ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী) সক্ষমতা বৃদ্ধি করা, সামাজিক সচেতনাতা বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রম, সক্রিয়ভাবে সম্ভাব্য কুষ্ঠ কেস শনাক্তকরণ কার্যক্রম এবং রোগ নির্ণয়সহ প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা।

কুষ্ঠমুক্ত দেশের জন্য অপারেশন প্ল্যান প্রণয়ন করা প্রয়োজন। তাই জাতীয় বাজেেট পর্যাপ্ত আর্থিক বরাদ্দ রাখা অপরিহার্য। যদি বাজেটে কুষ্ঠ বিষয়টির প্রতি যথাযথ মনোযোগ না দেওয়া হয়, তাহলে দেশে কুষ্ঠ-সংক্রান্ত যাবতীয় দুর্ভোগ চলতেই থাকবে, যা কিনা আমাদের জাতীয় উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত