শিশুশ্রম বন্ধ করা সময়ের দাবি

প্রদীপ সাহা

প্রকাশ : ১৪ জুন ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ছোটোখাটো কলকারখানা থেকে শুরু করে পাথর ভাঙা, ফেরি করা, ভিক্ষাবৃত্তি, বাসাবাড়িতে কাজ, গার্মেন্টস, গ্যারেজ, দোকানপাট, হোটেল-রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি ক্ষেত্রে শিশুদের শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আর্থসামাজিক বৈষম্য, সম্পদের অসম বণ্টন, নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে ফুলের মতো কোমল নিষ্পাপ শিশুদের কচি কচি হাতগুলো শ্রমের হাতিয়ার হয়ে ওঠে। তাদের সুপ্ত প্রতিভা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে শিশুশ্রম একটি মানবিক সমস্যা এবং সামাজিক ব্যাধি। ইউনিসেফের প্রদত্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, উন্নয়নশীল দেশগুলোতেই শিশু শ্রমিকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। শিশুশ্রম বন্ধের কথা বারবার ঘোষিত হলেও এই করুণ বাস্তবতার কার্যত কোনো প্রতিরোধ নেই। দেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। শিশুশ্রম বন্ধের লক্ষ্যে আমাদের অবশ্যই মহতী উদ্যোগে এগিয়ে যেতে হবে।

শিশুদের এই অমানুষিক শ্রমের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার নেপথ্যে দায়ী হলো অভাব, দারিদ্র্য, মিথ্যা প্রলোভন, ভবঘুরে থাকা ইত্যাদি। অন্যদিকে জনসংখ্যার লাগামহীন বৃদ্ধি এবং শিক্ষার অভাবও শিশুদের শ্রম বিক্রিতে সহায়তা করে থাকে। দেশের প্রতিটি আনাচে-কানাচে শিশুশ্রমের করুণ চিত্র সহজেই চোখে পড়ে। শিশুশ্রমের একটা বিরাট অংশ ছিন্নমূল। অভাবের তাড়নায় তারা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন এবং বেঁচে থাকার প্রয়োজনে নেমেছে পথে, বিক্রি করছে শ্রম। এসব ভাসমান শিশুদের বেশিরভাগই সময় কাটায় রাস্তায়-ফুটপাতে। শিশুশ্রম বন্ধের জন্য প্রতিরোধব্যবস্থা গড়ে তোলা অবশ্যই জরুরি।

শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে বিরত রাখতে ১৯৫৯ সালের ২০ নভেম্বর সাধারণ পরিষদে ‘শিশু অধিকার আইন’ সংক্রান্ত জাতিসংঘ সনদ গৃহীত হয়। জাতিসংঘের বিভিন্ন সদস্য রাষ্ট্র শিশুদের অধিকার সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করে। কিন্তু এত কিছুর পরও বর্তমান বিশ্বে শিশুদের অধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এবং জাতিসংঘ শিশু তহবিলে (ইউনিসেফ) নীতিমালা অনুযায়ী শিশুশ্রম সর্বত্র নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বাংলাদেশের আইনেও স্পষ্ট উল্লেখ আছে, যেসব শিশুর বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হয়নি তেমন কাউকে যেকোনো ধরনের শারীরিক ও মানসিক শ্রমে নিয়োগ করা যাবে না। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো এ সনদের বিষয়বস্তুগুলো অনুসরণ করলেও বাংলাদেশের সঙ্গে তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলো তা অনুসরণ করতে পারছে না। নিষিদ্ধ আইনের সামনেই এরা সকাল থেকে সন্ধ্যা, আবার কখনও গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করে। চলছে বিভিন্ন ফ্যাক্টরি, গার্মেন্ট অথবা অন্য কোনো কর্মক্ষেত্রে, যা সম্পূর্ণ আমানবিক এবং শিশুদের সুস্থ জীবনধারায় একটি অন্তরায়।

শিশুদের যদিও কোনো কষ্টসাধ্য বা বিপজ্জনক কাজে নিযুক্ত থাকার কথা নয়, তবু শিশুর শ্রম বিক্রিত অর্থই একসময় হয়ে দাঁড়ায় একটি পরিবারের জীবিকা অর্জনের অবলম্বন। জীবনযুদ্ধের শুরুতেই তারা হয়ে যায় বাজারের কুলি, হোটেল বয়, কারখানার শ্রমিক, রিকশাওয়ালা, দিনমজুর অথবা টেম্পুর পিচ্চি। আমাদের দেশের শিশুরা কায়িক শ্রমনির্ভর যেসব কাজ করতে বাধ্য হয়, তা কেবল স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকরই নয়। এতে তাদের কোমল মনের ওপরও চাপ পড়ে এবং এর ফলে শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধির ব্যাঘাত ঘটে ভীষণভাবে। অন্যদিকে, এসব শিশু অল্প বয়সে অমানবিক পরিশ্রমের ফলে অপুষ্টিতে ভোগে বিভিন্ন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয় এবং ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে পা বাড়ায়। তাদের অধিকাংশই স্বাস্থ্য সচেতন নয়। চিকিৎসায় অবহেলার ফলে রোগ-শোক তাদের নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়ায়। তাছাড়া বেশিরভাগ শিশু অনিয়মিত এবং খোলা খাবার খাওয়ার ফলে বিভিন্ন রকম পেটের অসুখে ভুগে থাকে। এদেরকে সচেতন করার কিংবা এ পথ থেকে ফিরিয়ে আনার যেন কেউ নেই।

কচি-কোমল প্রাণ এসব শিশুরা বিভিন্ন শ্রমে নিয়োজিত থাকার কারণে শিক্ষার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত থাকে। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ভ্রাম্যমাণ শিশুদের মধ্যে মাত্র ১ শতাংশ শিশু লেখাপড়া করে। তাদের পরিবার থেকেও শিক্ষার ব্যাপারে তেমন উৎসাহ প্রদান করা হয় না বা প্রয়োজন বোধ করে না। তাদের মতে, উপার্জন করানোই যেখানে মুখ্য, সেখানে লেখাপড়া শেখানোর দরকার নেই। শিশুরা যদি এভাবে শ্রমের সঙ্গে জড়িয়ে না পড়ত এবং সচ্ছল সংসারে শিক্ষার আলো পেত, তাহলে অবশ্যই তারা ভবিষ্যতের হাল ধরতে পারত এবং জাতিও তাদের কাছ থেকে পেত প্রত্যাশার উজ্জ্বল ঠিকানা। বিভিন্ন শ্রমে নিযুক্ত থাকার কারণে শিশুদের সারাদিন কিংবা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়। তারা কখনো সামাজিক বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারে না। ফলে তাদের মনে সৃষ্টি হয় এক গভীর হতাশাবোধ। সামাজিক বিচ্ছিন্নতা প্রকট হওয়ার কারণে শিশু-কিশোরদের একটা বিরাট অংশ হয়ে ওঠে অপরাধপ্রবণ। আর তাই অল্প বয়সে তাদের অনেকেই লোভে পড়ে বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বর্তমান সভ্য জগতে শিশুশ্রম একটি লজ্জাজনক চিত্র। শিশুদের এ ভয়ঙ্কর অভিশম্পাতের হাত থেকে অবশ্যই রক্ষা করতে হবে। তাদের নায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করে দৃঢ় সংকল্পে মানবিক পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে হবে আমাদের সবাইকে। বাঁচাতে হবে তাদেরকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের হাত থেকে। শিশুশ্রম বন্ধ করা এখন শুধু সময়ের দাবি। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে শিশুশ্রম বন্ধের আশা করা অত্যন্ত কঠিন হলেও তা প্রতিরোধে অবশ্যই কার্যকরী ও বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে এ শিশুশ্রম সংক্রামক ব্যাধির মতো আরো বিপুলভাবে ছড়িয়ে পড়বে আমাদের চারপাশে।