ঢাকা ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ২৩ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

শিশুকে ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস থেকে দূরে রাখতে হবে

আবুল খায়ের বাবু
শিশুকে ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস থেকে দূরে রাখতে হবে

গত ২ এপ্রিল, ২০২৪ইং মঙ্গলবার দেশে পালিত হয়েছে বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস। আলোচনায় সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণের কথা এসেছে। অটিজম বা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের শিক্ষাব্যবস্থা সহজ এবং পিতা-মাতার সামর্থ্যরে মধ্যে রাখায় সরকার এবং দেশের সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের এগিয়ে আসার বিষয়ে লিখতে গিয়ে অনেক আগের একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর হাতে তখন অফুরন্ত সময়। শুয়ে বসে ইন্টারনেট ঘেটে তা যেন কাটতে চাইতো না। তাই ছোট ভাইয়ের একটা গিফটশপ ‘গিফট গার্ডেন’-এ গিয়ে বসতাম, তাতে করে ছোট ভাইকে কিছুটা সাহায্য করা সেই সাথে নিজের কর্মহীন অফুরন্ত সময় কাটতো। এমনি এক সন্ধ্যায় দূর থেকে একটা করুণ আকুতি কেবলই নিকটবর্তী হচ্ছিল। মনটা আগে থেকেই ভালো কোঝা যাচ্ছিল না। করুণ আকুতি বুকের ভেতর কেমন যেন হাহাকার করে উঠল। গ্লাস ডোর ঠেলে বাহিরে এসে দাঁড়ালাম। আকুতির উৎস খুঁজতে চেষ্টা করে প্রথমে ব্যর্থ হলাম। এদিকে ওদিকে তাকাতে দূরে মানুষের আনাগোনা লক্ষ্য করে দেখলাম কিছু একটা গড়িয়ে আসছে আর সেখান থেকেই এই আকুতি। কাছে আসতে দেখা গেল একটা বিশ পঁচিশ বছরের যুবক হাত পা সবই পঙ্গু। পিঠ এবং কোনো রকমে পা দিয়ে সম্মুখে যাওয়া আর মুখ দিয়ে করুণ আকুতিতে ভিক্ষা চাওয়া, পুরাটা স্পষ্ট নয়। মানুষ এবং মানবতার জন্য এ দৃশ্য বড়ই পীড়াদায়ক। যে কোনো মানুষের হৃদয়ের গভীরে তা ব্যথা লাগারই কথা।

পুনর্বাসন যদি করতেই হয় প্রথমে এসব পঙ্গু বিকলাঙ্গ অসহায়দের পুনর্বাসন বড় বেশি প্রয়োজন। এরা যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন তাদের ভোরণ-পোষণ দিতে হবে, তাদের থেকে কিছুই আশা করার নেই। শুধু এই ভিখিরির কথা নয়, রাস্তা-ঘাটে ওভারব্রিজ ফুটপাতে এরকম অসংখ্য বিকলাঙ্গ মানুষকে অমানবিকভাবে ফেলে রেখে দূরে সতেজ সুস্থ সবল মানুষকে পথচারী মানুষের দুর্বল মনে আঘাত করে অর্থ উপার্জন করতে দেখা যায়। সেই সমস্ত বিকলাঙ্গ মানুষের অবস্থা দেখে রাস্তায় চলাচলকারী আমাদের কোমল মতি শিশুদের মনের উপর একটা প্রভাব পড়ে। অনেকবারই খবর বেরিয়েছে একশ্রেণির মানুষরূপী অমানুষরা শিশুদের হাত পা ভেঙে বিকলাঙ্গ করে বড় করে তোলে। পরে ভিক্ষা বৃত্তিতে নামিয়ে মানুষের দুর্বল মনে আঘাত করে অর্থ উপার্জন করে। যদি তাদের রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয় একসময় অমানুষদের, শিশুদের বিকলাঙ্গ করার প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাবে।

দেশে এমন প্রতিবন্ধী মানুষ ছাড়াও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। যাদের অনেক ধরনের সমস্যা আছে। কারো আছে শারীরিক এবং মানসিক সমস্যা, কারো কথা বলা ও শোনার সমস্যা, কারো সবকিছুতেই অমনোযোগী, কেহ খুব বেশি চঞ্চল, কারো আবার শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ বেকে যাওয়া, বয়স অনুযায়ী মানসিক বিকাশ না হওয়া ছাড়াও নানা সমস্যা। ‘ইপন’-এর একটা অনেক আগের গবেষণার তথ্য থেকে জানা যায় শহরে প্রতি দশ হাজারে সতের শিশু অটিজমে আক্রান্ত। গ্রামে এর সংখ্যা নাকি আরও বেশি। এদের কারো দরকার বিহেবিয়ার থেরাপি, কারো প্রয়োজন স্পিচ থেরাপি কারো অকুপেশনাল থেরাপি কারো দরকার ফিজিও থেরাপি। জন্মগত সমস্যা তো আছেই ডিজিটাল যুগে এসে শিশুদের ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইজে আসক্ত করে পিতা-মাতার অসচেতনতা, অবহেলা, অজ্ঞতায় সুস্থ শিশু নিজেদের অজান্তেই বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুতে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। একবার এমনি এক যুবতী মায়ের সাথে আলাপ হয়, তিনি জানান বাচ্চার দুই বছর পর মাস্টারস পরীক্ষার জন্য তৈরি হতে গিয়ে ছেলেকে শান্ত রাখতে হাতে ডিভাইস তুলে দিয়ে ছেলের সর্বনাশ করে ফেলেছেন। ছেলে আর মোবাইল ছাড়া শান্ত থাকে না। এভাবে বছর পার হয় কিন্তু পড়াশুনায় কিছুতে আনা যায় না। কারো সাথে কথা বলে না। কারো সাথে মেশে না। এখন স্কুলে দিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। বিভিন্নজন বিভিন্ন প্রশ্ন করলে নিজেকে বড় বেশি অপরাধী মনে হয়। সবাই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে হাসি খুশিতে থাকলেও নিজে তা পারছেন না। এছাড়াও সামাজিক কুসংস্কারের ফলে সন্তানের পিতা-মাতা হীনম্মন্যতায় ভোগে সন্তানকে কারো সামনে নিয়ে যেতে সংকোচবোধ করে। সন্তানকে কারো সাথে মিশতে দেয় না, খেলাধুলা করতে দেয় না। ফলে যে সমস্যা দশটা ছেলে-মেয়ের সাথে মিশলে খেলাধুলা করলে ভালো হতে পারত তা আর হয়ে ওঠে না। এক সময় বয়স বাড়ে দৈনন্দিন জীবনযাপনের কিছু জানার এবং শেখার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কিন্তু বয়স বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ স্কুলেও ভর্তি করাও সম্ভব হয় না।

বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষের জন্য সরকার চাকরি, রাস্তায় চলাচলের বিভিন্ন সুবিধা ছাড়াও সামান্য কিছু আর্থিক সাহায্যের ব্যবস্থা নিয়েছেন বলে জানা যায়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং তার কন্যা সায়মা ওয়াজেদের আন্তরিক পৃষ্ঠপোশকতায় বেসরকারিভাবে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠেছে। কিন্তু মানসম্পন্ন সেই সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার ব্যয়ভার বহন করা পিতা-মাতার জন্য একেবারেই অসম্ভব তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রয়োজনেই দুই-চারটা প্রতিষ্ঠান দেখার এবং মোবাইলে খোঁজ নিতে গিয়ে দেখেছি মাঝারি মানসম্পন্ন একটা স্কুলে প্রথমেই ভর্তি করাতে বাইশ থেকে পচিশ হাজার টাকা, মাসিক বেতন আট হাজার থেকে তেরো-চৌদ্দ হাজার টাকা এবং থেরাপি (যদি প্রয়োজন হয়) প্রতি থেরাপিতে প্রতিদিন আটশত টাকা অর্থ্যাৎ একটা সন্তানের পেছনে ভর্তি ফি ছাড়া মাসে গড়ে ২০ দিন ক্লাস ধরলে বেতন ৮০০০+১৬০০০ (একটা থেরাপি ৮০০/প্রতিদিন) = ২৪ হাজার টাকা প্রয়োজন। শুনেছি এক লাখ টাকা ভর্তি এবং চল্লিশ হাজার টাকা মাসিক বেতনেরও স্কুল এই ঢাকা শহরে আছে। এতো টাকা দিয়ে ক’জন মা-বাবা তার সন্তানকে পড়াতে পারবেন? কম বেতনের প্রতিষ্ঠান যে নাই তা নয় কিন্তু একজন শারীরিক বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুকে মানসিক বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন অথবা কথা বলা ও শোনার সমস্যা, কিংবা অমনোযোগী, কিংবা খুব বেশি চঞ্চল শিশুদের শিক্ষক স্বল্পতার কারণে একসাথে একই টেবিলে পড়ানো হয়। এটা সঠিক বলে মনে হয় না। শিশুদের মানসিক বিকাশ এবং শারীরিক জড়তা কাটানোর জন্য খেলাধুলা করার প্রয়োজন কিন্তু তার জন্য কোনো জায়গা নেই। একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে এমনি চলছে শিক্ষা কার্যক্রম।

আলাপে জেনেছি এই সব শিশুর সঠিকভাবে পরিচর্যা পরিসেবা দিতে হলে অনেক ক্ষেত্রে শিশুপ্রতি একজন শিক্ষক প্রয়োজন। দেশে পর্যাপ্ত দক্ষ শিক্ষকের অভাব আছে। দক্ষ শিক্ষকের বেতন ত্রিশ-চল্লিশ হাজারের বেশি দিতে হয়। তাই শিক্ষকদের বেতন স্কুলের ঘর ভাড়া বেশ ব্যয় সাপেক্ষ যার ব্যয় মেটানোর জন্য প্রচুর টাকার প্রয়োজন। তাই বাধ্য হয়েই শিশুদের অভিভাবকদের উপর চাপ বাড়াতে হয়। আমরা দেশকে উন্নত দেশের সঙ্গে তুলনা করি বাস্তবে তার কিছুই দেখি না। শুধু দৃশ্যমান অবকাঠামো উন্নয়ন যথেষ্ঠ নয়। আমার এক বন্ধুর ভাগিনা এমনি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু, আমেরিকায় থাকে। শুনেছি তাকে একটা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করা হয়েছে ভাগিনার সবকিছু প্রতিষ্ঠানেরই দায়িত্বে অভিভাবককে তার জন্য কোনো কিছুই ভাবতে হয় না। আমাদের দেশে এমনি সবার জন্য শিক্ষা এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। আমরা যদি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের লক্ষণ ভেদে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা এবং শিক্ষার ব্যয়ভার অভিভাবকদের সামর্থ্যরে মধ্যে রাখার চেষ্টা করতে পারি তবে অনেক শিশুই সুস্থ হয়ে পরিবার সমাজ ও দেশের অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখতে পারবে। তা না হলে প্রয়োজনীয় সেবার অভাবে একসময় এরাই পরিবার সমাজ ও দেশের বোঝায় পরিণত হবে। শুধু সরকার নয়, বিত্তবানদেরও এ ব্যাপারে ভেবে দেখার সময় এসেছে। সেই সাথে সন্তানের পিতা-মাতাকে সচেতন হতে হবে শিশুদের সাথে সময় কাটাতে হবে। শিশুদের শুধু ঘরে ড্রয়ং রুমে ফার্মের মুরগির মতো হৃষ্ট-পুষ্ট বানালে হবে না তার মানসিক বিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে। শহরে পর্যাপ্ত খেলার মাঠ নেই সত্য আপনি অবসরে সন্তানকে নিয়ে রাস্তায় হাঁটতে নামুন, সামাজিক অনুষ্ঠানে সন্তানের হাতটি ধরে হাজির হন দশ রকমের দশটা ছেলে-মেয়ের সাথে মিশতে দিন। পড়ে গিয়ে ব্যথা পাবে, একজনের সাথে আরেকজন হাতাহাতি করবে এভাবেই শিশুদের মানষিক বিকাশের চেষ্টা করুন। সেইসাথে যে কোনোভাবেই অপরিণত শিশুকে ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস থেকে দূরে রাখতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত