সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিদায় হজের ভাষণ

জিল্লুর রহমান

প্রকাশ : ১৫ জুন ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

মুসলমানদের কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় মানুষ মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। বিশ্বের সর্বকালের সেরা মহামানব হিসেবে মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে প্রশ্নাতীতভাবে স্বীকৃত। হজরত মুহাম্মদ (সা.) কেবল নেতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন শেষ নবী ও বিশ্বনবী, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব। ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়াল বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) পৃথিবীকে আলোকিত করে আগমন করেন। ইন্টারনেট জায়ান্ট ‘গুগল’ ডটকমের র‍্যাংকিংয়েও বিশ্বসেরা মানুষ হিসেবে তালিকায় প্রথম স্থানে তারই নাম রয়েছে। মাইকেল হার্টসের লেখা ‘বিশ্ব সেরা ১০০ মনীষী’ গ্রন্থে প্রথম স্থানেই রয়েছে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নাম। ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত ওই বইটি বিভিন্ন মহলে ব্যাপক হইচই ফেলে দেয়। তিনি লিখেছেন, ‘মুহাম্মদ (সা.)-এর সাফল্যের মধ্যে জাগতিক ও ধর্মীয় উভয় বিধ প্রভাবের এক অতুলনীয় সংমিশ্রণ ঘটেছে। এজন্য সংগতভাবেই তাকে ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।’ (দ্য হ্যান্ড্রেড) তরুণ বয়সেই হজরত মুহাম্মদ (সা.) সত্য ও সুন্দর সমাজ গঠনের লক্ষ্যে শান্তিকামী যুবকদের নিয়ে ‘হিলফুল ফুজুল’ অর্থাৎ শান্তিসংঘ গঠন করে আরব সমাজে হৈচৈ ফেলে দেন। হিলফুল ফুজুলের উদ্দেশ্য ছিল, আর্তমানবতার সেবা করা, অত্যাচারীকে প্রতিরোধ করা, শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা, গোত্রে গোত্রে সম্প্রীতি বজায় রাখা ইত্যাদি। কোরআনে তাকে ‘রাহমাতুল লিল আ’লামীন’ বা জগতবাসীর জন্য ‘রহমত’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। মক্কা বিজয়ের পর তিনি মুসলমান, খ্রিস্টান, ইহুদিসহ সব সম্প্রদায়ের লোকের পরস্পরের মধ্যে শান্তি, সম্প্রীতি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য ঐতিহাসিক ‘মদীনা সনদ’ সম্পাদন করেন। এ মদীনা সনদই ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম লিখিত চুক্তি বা সংবিধান। এ সনদের ফলে মুসলমান আর অমুসলমানদের মধ্যে এক অপূর্ব সম্প্রীতির সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মানুষের জানমালের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হয়। নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। তা ছাড়া, ইসলামের ইতিহাসে তথা বিশ্বের ইতিহাসে ‘হুদায়বিয়ার সন্ধি’ এক যুগান্তকারী ঘটনা। বিশ্বের ইতিহাসে এ সন্ধি এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। এ সন্ধিতে স্বাক্ষর করে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এক অসাধারণ রাজনৈতিক প্রতিভা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দেন। তাই ‘হুদায়বিয়ার সন্ধি’ মহানবী (সা.) এর জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এসব নানা ঘটনা তাকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবের স্বীকৃতি দিয়েছে। আল্লাহ তা’আলা দ্বীন ইসলামকে বিজয়ী ও পূর্ণতা দানের জন্য মহানবী (সা.)কে প্রেরণ করেছেন। যখন দ্বীন ইসলাম বিজয় ও পূর্ণতা লাভ করে তখন তিনি তার বিদায়ের কথা অনুভব করেন। আরবি দশম হিজরী সনে রাসূল (সা.)-এর বিদায় হজ অনুষ্ঠিত হয় এবং সেখানে লক্ষাধিক সাহাবি উপস্থিত ছিলেন। যে কোনো আদর্শিক নেতার জীবনের সর্বশেষ কর্মী সম্মেলনে দেওয়া ভাষণ নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে থাকে। অধিকন্তু তার দৃঢ় আশঙ্কা ছিল যে, এটিই তার জীবনের সর্বশেষ হজ ও সর্বশেষ বিশ্ব সম্মেলন। আর নবী জীবনের পরিপূর্ণতা সাধিত হয়েছে বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)এর বিদায় হজের ভাষণে। দশম হিজরীতে প্রায় এক লাখ ৫০ হাজার সাহাবির সামনে জিলহজ্জ মাসের ৯ তারিখ বিকালে আরাফাতের ময়দানে যে বক্তব্য পেশ করেন এবং পরদিন ১০ জিলহজ ঈদের দিন ও কোরবানির দিন প্রদান করেছিলেন। এই দুইদিনে দেওয়া তার বক্তব্য বিদায় হজ্জের ঐতিহাসিক ভাষণ হিসেবে ব্যাপক পরিচিত। তাই তিনি হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা)কে ইয়েমেনের গভর্নর নিযুক্ত করে প্রেরণকালে বলেছিলেন, ‘হে মুয়াজ, সম্ভবত এ বছরের পর আমার সঙ্গে তোমার আর সাক্ষাৎ হবে না। হয়তো তুমি আমার মসজিদ ও আমার কবরের পাশ দিয়ে গমন করবে।’ আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ঐতিহাসিক বিদায় হজের ভাষণের প্রারম্ভে মহান আল্লাহর হামদ ও প্রশংসা জ্ঞাপন করার পর বলেন, হে লোক সকল! আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘হে মানবজাতি! আমি তোমাদিগকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিত হতে পারো। নিশ্চয় আল্লাহর কাছে সেই সর্বাধিক সম্মানিত, যে সর্বাধিক পরহেজগার।’ (সূরা হুজুরাত, আয়াত ১৩)। সুতরাং কোনো অনারবের ওপর কোনো আরবের; কোনো আরবের ওপর কোনো অনারবের, এমনিভাবে শ্বেতাঙ্গের ওপর কৃষ্ণাঙ্গের এবং কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শ্বেতাঙ্গের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। সব মানুষ আদম (আ.)-এর সন্তান; আর আদম (আ.) মাটি দ্বারা সৃষ্ট। হে সভ্যমণ্ডলী! এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই, সব মুসলমান পরস্পর ভাই ভাই; তোমাদের অধীনদের (দাস-দাসী) প্রতি খেয়াল রাখবে-তোমরা যা খাবে, তাদের তা খাওয়াবে, তোমরা যা পরিধান করবে, তাদেরও তা পরাবে। সাবধান! ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করবে না; কেননা তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা ধর্মীয় বিষয়ে বাড়াবাড়ি করার কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে। হে লোক সকল! তোমরা তোমাদের রবের ইবাদত করবে; পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়বে, রমজান মাসে রোজা রাখবে, সন্তুষ্টচিত্তে সম্পদের জাকাত প্রদান করবে, স্বীয় প্রভুর ঘরে এসে হজ পালন করবে এবং নেতাদের আনুগত্য করবে; তাহলে তোমাদের রবের জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে। হে মানবম-লী! তোমরা আমার কথা শোনো। হয়তো আমি এ বছরের পর এখানে আর কখনো তোমাদের সঙ্গে মিলিত হবো না। হে মানবম-লী! তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদ এই দিন ও এই মাসের মতো তোমাদের ওপর নিষিদ্ধ ও পবিত্র তোমাদের প্রভুর সঙ্গে সাক্ষাতের দিন পর্যন্ত। অচিরেই তোমরা তোমাদের মহান প্রভুর সাক্ষাতে উপনীত হবে। তখন তিনি তোমাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন। আমি তো তোমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছি। তোমাদের কারো কাছে যদি কোনো আমানত গচ্ছিত থাকে, তা তার প্রাপকের কাছে অবশ্যই পৌঁছে দেবে। নিশ্চয়ই সব ধরনের সুদ রহিত করা হলো। তবে তোমাদের মূলধন বহাল থাকবে। মহান আল্লাহ ফয়সালা দিয়েছেন যে, আর কোনো সুদ নয়। আব্বাস ইবন আবদুল মুত্তালিবের সব সুদ রহিত করা হলো। তোমরা কোনো জুলুম করবে না, বরং তোমাদের প্রতিও কোনো জুলুম করা হবে না। জাহিলী যুগের যত রক্তের দাবি, তা সব রহিত করা হলো। প্রথম আমি রিবয়া ইবন হারিস ইবন আবদুল মুত্তালিবের শিশুপুত্রের রক্তের দাবি রহিত করলাম। হে মানবম-লী! নিশ্চয়ই শয়তান তোমাদের এই ভূখণ্ডের উপাস্য হওয়ার ব্যাপারে চিরদিনের জন্য নিরাশ হয়ে গেছে। তবে এ ছাড়া তোমরা যা তুচ্ছ মনে করে থাকো, এমন বহু কাজ রয়েছে, যাতে তার আনুগত্য করলে সে খুশি হবে। সুতরাং তোমরা তোমাদের দ্বীনের ব্যাপারে তার থেকে সাবধান থেকো। হে মানবম-লী! নিশ্চয়ই মাসসমূহকে আগ-পিছ করা বস্তুত কুফরিকেই বৃদ্ধি করা, যা দ্বারা কাফিররা বিভ্রান্ত হয়। অথচ কাল (সময়) তার নিজস্ব নিয়মে প্রকৃতিতে আবর্তিত হয়। হে মানবম-লী! নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা প্রত্যেক প্রাপকের (উত্তরাধিকারীর) জন্য তার অংশ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। যে ব্যক্তি নিজের জন্মদাতা ছাড়া অন্যের সঙ্গে নিজের বংশসূত্র স্থাপন করে এবং যে নিজ মনিব ছাড়া অন্যকে মনিব বলে স্বীকার করে, তার ওপর আল্লাহর লানত। সব ঋণ পরিশোধের যোগ্য ও অধিকার, ধারকৃত বস্তু ফেরতযোগ্য, উপঢৌকনেরও বিনিময় প্রদান করা উচিত, জামিনদার জরিমানা আদায় করতে বাধ্য থাকবে। কারো জন্য তার অপর ভাইয়ের কোনো কিছু বৈধ নয়, যতক্ষণ না সে নিজে সন্তুষ্টচিত্তে তা প্রদান না করে। কোনো নারীর জন্য তার স্বামীর অনুমতি ব্যতিরেকে স্বামীর অর্থ-সম্পদ থেকে কাউকে কিছু দেওয়া বৈধ নয়। তোমরা কখনো একে অন্যের ওপর জুলুম কোরো না। নিশ্চয়ই তোমাদের স্ত্রীদের ওপর তোমাদের অধিকার রয়েছে এবং তোমাদের ওপরও তাদের অধিকার আছে। তাদের ওপর তোমাদের অধিকার হলো তারা তোমাদের বিছানায় কাউকে কখনো স্থান দেবে না, যা তোমাদের সবার অপছন্দনীয় এবং তাদের ওপর তোমাদের অধিকার হচ্ছে, তারা কোনো অশ্লীল বা লজ্জাকর কাজে লিপ্ত হবে না। তোমরা নারীদের প্রতি কল্যাণকামী হও। কারণ, তারা তোমাদের কাছে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ। তারা তো নিজেদের জন্য কিছু করে না। তোমরা তো তাদের আল্লাহর আমানতস্বরূপ গ্রহণ করেছ এবং আল্লাহর বাণীর মাধ্যমে তাদের সতীত্বের ওপর অধিকার লাভ করেছ (বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে দাম্পত্য অধিকার লাভ করেছ)। অতএব, হে মানবম-লী! তোমরা আমার কথা অনুধাবন করো। আমি তো পৌঁছে দিয়েছি। আমি তোমাদের মাঝে এমন সুস্পষ্ট দুটি বিষয় (বিধান) রেখে গেলাম, যা দৃঢ়ভাবে ধারণ করলে তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না: আল্লাহর কিতাব এবং তার নবী (সা.)-এর সুন্নাহ। হে মানবম-লী! তোমরা আমার কথা শোনো ও অনুধাবন করো। তোমরা অবশ্যই জেনে রেখো, প্রত্যেক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই এবং মুসলিমগণ ভ্রাতৃপ্রতিম। সুতরাং কোনো মুসলিমের জন্য তার ভাইয়ের কোনো কিছু বৈধ নয়, যতক্ষণ না সে সন্তুষ্টচিত্তে তাকে তা প্রদান করে। অতএব, তোমরা নিজেদের প্রতি জুলুম কোরো না। সবাই শোনো, এখানে উপস্থিত লোকেরা যেন এই বার্তাগুলো অনুপস্থিত লোকদের কাছে পৌঁছে দেয়। হয়তো অনেক অনুপস্থিত লোক উপস্থিত শ্রোতা অপেক্ষা অধিক হেফাজতকারী হবে। শোনো! তোমরা আল্লাহর দরবারে আমার ব্যাপারে যখন জিজ্ঞাসিত হবে, বলো তখন কী উত্তর দেবে? উপস্থিত সাহাবিরা উত্তর দিলেন, আপনার ওপর অর্পিত দায়িত্ব আপনি যথাযথ পালন করেছেন; ইয়া রাসুলুল্লাহ! (হে আল্লাহর রাসুল!) আপনি রিসালাতের হক পূর্ণরূপে আদায় করেছেন এবং উম্মতকে কল্যাণ পথের দিশা দিয়েছেন। তারপর তিনি সাহাবিদের উদ্দেশে বললেন, ‘আমি কি পৌঁছে দিয়েছি?’ উপস্থিত সাহাবিরা সমস্বরে বলে উঠলেন, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই আপনি পৌঁছিয়েছেন।’ তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) আকাশের দিকে শাহাদত অঙ্গুলি উত্তোলন করে বললেন, ‘হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষী থাকুন; হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষী থাকুন; হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষী থাকুন।’ মহানবী (সা.) ভাষণ শেষ করলেন এবং তার চেহারা মোবারক উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি করুণ স্বরে করুণভাবে আকাশ পানে তাকালেন এবং তিনি বললেন, ‘হে মহান প্রভু! হে পরওয়ার দিগার! আমি কি তোমার দীনের দাওয়াত পরিপূর্ণভাবে মানুষের কাছে পৌঁছাতে পেরেছি। তখন উপস্থিত জনতা সবাই সম্মিলিতভাবে বললেন, নিশ্চয়ই আপনি আপনার দীন পরিপূর্ণভাবে পৌঁছাতে পেরেছেন।’ তখন তিনি আবার বললেন যে, ‘হে প্রভু! আপনি শুনুন, আপনি সাক্ষী থাকুন, এরা বলেছে আমি আপনার দীনকে লোকদের নিকট পৌঁছাতে পেরেছি। আমি আমার কর্তব্য পালন করতে পেরেছি।’ ভাবের আতিশয্যে নবী নীরব হলেন। জান্নাতি নূরে তার চেহারা আলোকদীপ্ত হয়ে উঠল। এই মুহূর্তে কোরআনের শেষ আয়াতটি নাজিল হয়। ‘আজকের এই দিনে তোমাদের দীনকে পূর্ণ করে দিলাম। তোমাদের ওপর আমার নিয়ামত পূর্ণ করে দিলাম। ইসলামকেই তোমাদের ওপর দীন হিসেবে মনোনীত করলাম।’ (সুরা মায়েদা আয়াত ৩) এরপর হজরত রাসূল (সা.) কিছুক্ষণ চুপ রইলেন। জনতাও নীরব। কিছুক্ষণ পর হজরত (সা.) জনতার দিকে তাকালেন এবং করুণ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন বিদায় বন্ধুগণ, বিদায়। হজরত রাবিয়া ইবনে উমাইয়া ইবনে খালফ জনতার কাছে উচ্চকণ্ঠে বিদায় হজের ভাষণের বাণী পৌঁছে দেন (ইবনে হিশাম)। ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে জিলহজ মাসে বিদায় হজের পর ২৯ সফর মহানবী (সা.) মাথাব্যথা ও জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। ১২ রবিউল আউয়াল, সোমবার ৬৩ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। মহানবী (সা.) আজ নেই। তিনি ছিলেন সর্বশেষ নবী, সর্বকালের সেরা মানব। জীবন সায়াহ্নের আগে দিয়ে গেছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ, যা ইসলামের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত আছে। সৃষ্টির আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত আগত, বিগত পৃথিবীর সব ভাষণের মধ্যে এ ভাষণ শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় বিভূষিত। বিশ্ব মানবতার মুক্তির এমন কোনো দিক নেই, যার ছোঁয়া এই মূল্যবান ভাষণে লাগেনি। মূলত বিদায় হজের ভাষণ মহানবী (সা.)-এর ২৩ বছরের নবুয়তি জীবনের কর্মপন্থা ও প্রজ্ঞার নির্যাস। এ ভাষণের পর তিন মাস অতিবাহিত হতে না হতেই তিনি এই নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে অবিনশ্বর জগতে পাড়ি জমান। জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে তিনি লাখো জনতার কণ্ঠে নবুয়তি দায়িত্ব যথার্থভাবে পালনের স্বীকারোক্তি গ্রহণ করেন। রাসুল (সা.)-এর মুখে ‘আল-বিদা’, ‘আল-বিদা’ ধ্বনি শুনে ভক্তকুলের আকাশ বিদীর্ণ করা আর্তনাদ ও নিঃশব্দ আকুতিতে সেদিন ভারি হয়েছিল আরাফার আকাশ। ‘আমি কি পয়গাম পৌঁছে দিয়েছি?’ বারবার ধ্বনিত হওয়া এ বাক্যটি শুনে বিগলিত মন ও সিক্ত নয়নে ভক্তকুলের মুখ থেকে কেবল একটি শব্দই বেরিয়ে এসেছিল, ‘নায়াম’- হ্যাঁ। ইসলামের পূর্ণতা এসেছিল এ বিদায় হজের ভাষণের মধ্য দিয়ে। আর কোনো নবী আসবেন না। তিনি আমাদের জন্য রেখে গেছেন দুটি মুল্যবান জিনিস। একটি হলো সর্বকালের সেরা কিতাব আল কোরআন আর অপরটি হলো তার সর্বশ্রেষ্ঠ সুন্নাহ। বলা হয়েছে এই দুটিকে শক্ত করে আকড়ে ধরলে মানুষ কখনও পদভ্রষ্ট হবে না।

লেখক : ব্যাংকার ও কলাম লেখক।