তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে বন্যার সম্পর্ক

মো. মামুন

প্রকাশ : ২০ জুন ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বন্যা পরিস্থিতির বাস্তবতা যে কতটা কঠিন এবং বন্যার্ত হয়ে দিনযাপন করা যে কতটা ভোগান্তির বিষয়, সেটা শুধু বন্যার্তদের পক্ষেই উপলব্ধি করা সম্ভব। কারণ হুট করে কিংবা ২-৩ দিনের মধ্যে বন্যা পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের কোনো ব্যবস্থা নেই। বন্যাকালীন এবং বন্যা পরবর্তী সময়ে জনদুর্ভোগ এবং আর্থিক সংকট থেকে উত্তরণ পেতে অনেক সময়ের প্রয়োজন। অনেকের ক্ষেত্রে বন্যার ক্ষতি মোকাবিলা করে পুরোপুরি আগের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসা কখনই সম্ভবপর হয় না। প্রায় প্রতি বছরই বন্যার সম্মুখীন হওয়া দেশের উত্তরাঞ্চলের পাশাপাশি সিলেটের এবারের বন্যা ধারণ করেছিল অতি ভয়াবহ রুপ।

বন্যার ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে প্রকাশ করা নিডস অ্যাসেসমেন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের (এনএডব্লিউজি) প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ বছর দেশের ১৮ জেলার প্রায় ৭৬ লাখ মানুষ বন্যার শিকার। এ বছরের বন্যায় অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৬ লাখ, যারা আশ্রয়ের জন্য ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়। ২ লাখ ৭৮ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বন্যার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ১৬ লাখ ঘর। বন্যায় মারা যায় ৯৫ জন মানুষ, বাদ যায়নি গবাদি পশুও। প্রায় ৮ লাখ গবাদিপশু আশ্রয় ও খাদ্য সংকটে ভুগছে। এদিকে শিক্ষার ক্ষেত্রেও পড়েছে বিরূপ প্রভাব। এ বছরের বন্যায় দেশে পৌনে ৬ লাখ শিক্ষার্থী বন্যাকবলিত, যাদের শিক্ষাকার্যক্রম দীর্ঘসময় ধরে বন্ধ ছিল এবং এখনো আছে।

এমতাবস্থায়, প্রশ্ন হলো- প্রায় বছরগুলোতেই কেন এভাবে ভয়াবহ বন্যার শিকার হচ্ছে দেশের লাখ লাখ মানুষ? বন্যার পেছনের কারণগুলো কি মানবসৃষ্ট নাকি প্রাকৃতিক? জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কি আমরা এখনো টের পাচ্ছি না? প্রতি বছর বন্যার কারণে অর্থনেতিক ক্ষয়ক্ষতিগুলোর দায় আসলে কার? জাতিসংঘের ইন্টারগভর্মেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিপিসিসি)-এর ষষ্ঠ মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সামগ্রিকভাবে বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ আগের সময়গুলোর থেকে অনেক বিস্তর ও গভীর। এর ফলে এখনকার বিশ্ব এমন সব বিপজ্জনক দুর্যোগের সস্মুখীন হচ্ছে- যা গত ২ হাজার বছরেও বিশ্ববাসী দেখেনি।

এশিয়া টাইমসের নিবন্ধ মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষয়ক্ষতির চরম ঝুঁকিতে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়া। শিল্প বিপ্লবের পরে বিশ্বের তাপমাত্রা ১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ১৯৮০ সালের পরে বিশ্বে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বেড়েছে দ্বিগুণ। এ বছরের মে মাসে ভারতের নয়াদিল্লিতে তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

বন্যার ঝুঁকি বৃদ্ধির সঙ্গে তাপমাত্রা বৃদ্ধির সম্পর্ক নিয়ে প্যাসিফিক স্টান্ডার্ড-এর এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে হিমবাহের গলনও বৃদ্ধি পেয়ে হিমালয়ের নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ভারত ও বাংলাদেশের যথাক্রমে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরবর্তী অঞ্চলগুলোতে বাস করা ৫০০ মিলিয়ন অর্থাৎ ৫ কোটি মানুষের বন্যা ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে ভারত মহাসাগর বেশি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। তাই মৌসুমি বায়ু বেশি শক্তিশালী হয়ে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ঘটাচ্ছে; ফলে বিশ্বের প্রধান নদী অববাহিকাগুলো ও তীরবর্তী দেশ ও অঞ্চলগুলোতে বাড়ছে বন্যা।

এ বছরে ভারতের ক্ষেত্রে সেটাই হয়েছে। অতিরিক্ত দাবদাহের পর শুরু হয়েছে অতিবৃষ্টি। ভারতের চেরাপুঞ্জি বিশ্বের সবচেয়ে বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা। সেখানে এবার রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে। পুরো বছরে চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টিপাত হয় ৫০০০ মিলিমিটার। কিন্তু এ বছর শুধু একদিনই ৯৭২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল; যা গত ১২২ বছরের মধ্যে একদিনে তৃতীয় সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত। এসব বৃষ্টির পানি বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের সবকটি জেলায় প্রবেশ করেছে। যেটার পরিণতি দেখল পুরো দেশবাসী। অল্প কয়েক দিনের মধ্যে সিলেট বিভাগের ৮০ শতাংশ এলাকা পানির নিচে চলে গিয়েছিল। অন্যদিকে বাংলাদেশের ব্রহ্মপুত্র নদের উজানে আসামের গুয়াহাটিতে ও মেঘালয়েও হয়েছে অতিবৃষ্টি। ওইসব এলাকার বৃষ্টির পানি ব্রহ্মপুত্র নদ হয়ে এসে কুড়িগ্রাম জেলাতেও বন্যায় সৃষ্টি হয়। ভারতের আসাম ও বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার ভয়াবহ বন্যার পাশাপাশি এ বছর বন্যার কবল থেকে বাদ যায়নি চীনও। চীনের দক্ষিণ ও পূর্ব প্রভিন্স এলাকায় ১৯৬১ সালের পর সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়ে রেকর্ড পানির উচ্চতার বন্যার শিকার হয়েছে চীনের এসব এলাকার লাখ লাখ মানুষ।

অর্থাৎ, জলবায়ু পরিবর্তন একটি সত্য ঘটনা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সরাসরি ঝুঁকিপূর্ণ ও ভুক্তভোগী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। জলবায়ু পরিবর্তন বৈশ্বিক ঘটনা। তাই পুরো বিশ্ব, বিশেষ করে উন্নত রাষ্ট্রগুলোর নীতিগত সিদ্ধান্ত ও সেসবের কার্যকারিতা নিশ্চিত করা জরুরি। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিশ্বকে নিতে হবে প্রয়োজনীয় নীতিগত সিদ্ধান্ত এবং নিশ্চিত করতে হবে কার যথাযথ বাস্তবায়ন। পাশাপাশি বৃদ্ধি করতে হবে বন্যায় ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের মানুষের দুর্যোগ মোকাবিলা সক্ষমতাও। তাহলেই হয়তো বন্যার দুর্ভোগ ও ক্ষয়ক্ষতি থেকে অনেকটা রক্ষা পাবে বন্যায় ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের মানুষগুলো।

লেখক : শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়