বিশ্বজুড়ে বাড়ছে শরণার্থী সংকট

অলোক আচার্য

প্রকাশ : ২১ জুন ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

পৃথিবীব্যাপী বাস্তুচ্যুত মানুষ একটি সমস্যা। পৃথিবীতে জন্ম নেওয়া প্রতিটি নাগরিকেরই রয়েছে- বাসস্থানের মতো মৌলিক অধিকার। আশ্রয়হীন মানুষকে পৃথিবীতে বাস্তুচ্যুত বলা হয়। আর বাস্তুচ্যুত হয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিলে তাকে শরণার্থী বলে। মূলত শরণার্থী হলো একজন মানুষ যার নিজের আশ্রয় রয়েছে- দেশ রয়েছে, সেখানে থাকার অধিকার রয়েছে; কিন্তু তাকে আশ্রয়ের খোঁজে অন্যত্র যেতে হয় এবং সেখানে তিনি অস্থায়ীভাবে বসবাস করেন। কখনো সেই বসবাস বহু দিনের দীর্ঘ হয়, আবার ভাগ্য ভালো হলে অল্প দিনেই দুর্ভাগ্যের শেষ হয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে বর্তমান পৃথিবীতে আশ্রয়হীন মানুষের সংখ্যা ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদিও তাদের আশ্রয় পাওয়ার পূর্ণ অধিকার রয়েছে বাকি সবার মতো তবু তাদের সেই অধিকার দেওয়া হচ্ছে না। খুব স্বাভাবিকভাবেই তারা মানবেতর জীবনযাপন করছে। বিশ্বজুড়েই আশ্রয়হীন শরণার্থী মানুষের ভিড়। মাথার উপর বিশাল আকাশ সব মানুষের ছাদ হয়ে থাকলেও সবার কপালে আশ্রয় জুটছে না। যে নিশ্চিত আশ্রয়ে তারা জন্মগ্রহণ করছে, সেই আশ্রয় একসময় ছাড়তে হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা গত ১০ বছরে ১২ কোটিতে পৌঁছেছে। যুদ্ধ, নিপীড়ন, সহিংসতা, মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো কারণগুলোর জন্য ৬৯ জনের মধ্যে একজন জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত বা ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) জানিয়েছে, চলমান গাজা সংঘাত, ইউক্রেন যুদ্ধ, আফগানিস্তান সংকট এবং সুদানের গৃহযুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে শরণার্থীর সংখ্যা কয়েক গুণ বেড়েছে। সে হিসাবে বিশ্বব্যাপী কমপক্ষে ১১ কোটি ৭৩ লাখ মানুষ অর্থাৎ প্রতি ৬৯ জনে এক জন জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হচ্ছেন। এদের অনেকে আভ্যন্তরণীভাবে নিজ দেশেও বাস্তুচ্যুত। আর এই সংখ্যা চলতি বছরের প্রথম ৪ মাস বাড়তে থাকে এবং এপ্রিলের শেষ নাগাদ ১২ কোটিতে অতিক্রম করে। ইউএনএইচসিআরের সবশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর রেকর্ডসংখ্যক মানুষ বাস্তুহারা হয়। যুদ্ধ-সহিংসতায় নিজ দেশ ও ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন প্রায় ১ কোটি ৯০ লাখ মানুষ। ইসরায়েল-গাজা-সংঘাত, ইউক্রেন যুদ্ধ ও সুদান সংকটে লাখ লাখ উদ্বাস্তু নতুন করে যোগ হওয়ায় বিশ্বজুড়ে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতের সংখ্যা বেড়ে রেকর্ড ১২ কোটিতে পৌঁছেছে। এরমধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাস্তুচ্যুতি সংকটে রয়েছে সিরিয়া। দেশটিতে ঘরহারা মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ৩৮ লাখ। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, এই সংখ্যা নির্দেশ করে যে নতুন এবং আগে থেকেই বিদ্যমান দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতগুলোর সমাধান না হওয়ার কারণে এখন আরো বেশি পরিমাণে মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। আর এতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার প্রধান ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি। তিনি বলেন, ‘মানুষের মধ্যে সহিংসতা বাড়ছে। এতে বাস্তুচ্যুতের সংখ্যা হু হু করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে লাখ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি ছাড়া হচ্ছেন।’ একইসঙ্গে, যুদ্ধ, নিপীড়ন, বৈষম্য, সহিংসতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো কারণগুলোকেও এজন্য দায়ী করেন জাতিসংঘের এই কর্মকর্তা। বিশ্বে ২০২৩ সাল শেষে রেকর্ড ৭ কোটি ৫৯ লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে উদ্বাস্তু হয়েছেন। সুদান ও ফিলিস্তিনের গাজায় চলমান সংঘাতের জেরে এ সংখ্যা বেড়েছে। বেসরকারি সংগঠন ইন্টারনাল ডিসপ্লেসড মনিটরিং সেন্টারের (আইডিএমসি) প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। ২০২২ সাল শেষে এ সংখ্যা ছিল ৭ কোটি ১১ লাখ। সংঘাতসহ নানা কারণে যারা উদ্বাস্তু হয়ে নিজ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে অন্য দেশে চলে যেতে বাধ্য হন, তাদের শরণার্থী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর যারা নিজ দেশের ভেতর এক জায়গা থেকে অন্যত্র স্থানান্তরিত হন, তাদের অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু ধরা হয়। ২০২১ সালের শেষে বাস্তুচ্যুত শিশুর সংখ্যা ছিল ৩৬ দশমিক ৫ মিলিয়ন। তথ্যে জানা যায়, সিরিয়া ভেনিজুয়েলা, ইউক্রেন, আফগানিস্তান ও দক্ষিণ সুদানে শরণার্থীর সংখ্যা যথাক্রমে- ৬ দশমিক ৮, ৫ দশমিক ৬, ৫ দশমিক ৪, ২ দশমিক ৮ ও ২ দশমিক ৪ মিলিয়ন। ২০২১ সালের শেষ নাগাদ জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত লোকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৯ কোটি। আশ্রিত, বাস্তুচ্যুত, শরণার্থী অথবা উদ্বাস্তু নামে তাদের আশ্রয় নিতে হচ্ছে অন্য কোনো দেশে। মানুষের এই পরিণতির জন্য মূলত মানুষই দায়ী। শরণার্থী শিবিরে জন্ম নেওয়া শিশুরা তাদের জন্ম থেকেই শরণার্থী হিসেবে বড় হয়ে উঠছে। শিক্ষালাভের সুযোগ থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে। সেসব শিশুরা এমন একটি পরিবেশে বড় হয়ে উঠছে, যা একটি শিশুর ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ প্রতিকূল। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এক নতুন পৃথিবী আবিষ্কার করছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে গত কয়েক বছর ধরেই রোহিঙ্গারা শরণার্থী হিসেবে বসবাস করছে। লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে, যেখানে তাকে বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া ও নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। নিজের আশ্রয় ছেড়ে তারা এখন শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে। বিপুল সংখ্যক শরণার্থী বাংলাদেশ মানবিক কারণেই আশ্রয় দিয়েছে। বিশ্বের ধনী দেশগুলো বৈশ্বিক শরণার্থী সমস্যার আপাত সমাধান হিসেবে আর্থিক ও অন্যান্য সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে ঠিক; কিন্তু একটি প্রত্যাশিত সমাধান যা তাদের বাস্তুচ্যুত বা শরণার্থী অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে পারে, সে বিষয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। একটি প্রত্যাশিত মানবিক বিশ্ব উপহার দিতে বিশ্ব নেতারা স্পষ্টভাবেই ব্যর্থ হয়েছে। বিশ্বজুড়েই বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন- নদীভাঙন, বন্যা, খরা এবং গৃহযুদ্ধ বা যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করা, খাদ্য সংকট, পানি সংকট ইত্যাদি নানামুখী কারণে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। তা ছাড়া পৃথিবীজুড়েই আজ হানাহানি, হামলা, শক্তিমত্তা প্রদর্শন, নিপীড়ন এসব ঘটনার সংখ্যা বাড়ছে। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক সংস্থা ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টারের (আইডিএমসি) গ্লোবাল রিপোর্ট অন ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট ২০২১-এর প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২০ সালে উদ্বাস্তু ৫ কোটি মানুষ। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও নানা দ্বন্দ্ব-সংঘাতে গত বছরে বিশ্বের ১৪৯টি দেশ ও ভূখণ্ডে নতুন করে উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫ কোটি ৫০ লাখ। এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো দেশের অভ্যন্তরে এবং এক দেশ থেকে অন্য দেশে আশ্রয়হীন মানুষ শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিচ্ছে। প্রাকৃতিক কারণে যারা আশ্রয়হীন হচ্ছে, তাদের সমস্যার সমাধান হচ্ছে। অন্যদিকে যারা দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ফলে আশ্রয়হীন হচ্ছে, তাদের দীর্ঘদিন আশ্রয়হীন অনিশ্চিত জীবনযাপন করতে হচ্ছে। তাদের সমস্যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হাতে চলে যাচ্ছে যার সুরাহা সহসাই হচ্ছে না। প্রতি বছর যদি উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে, তাহলে পৃথিবী এক ধরনের বিপর্যয়ের মধ্যে যেতে পারে। এত বিপুলসংখ্যক মানুষের শ্রমণ্ডমেধা বাদ দিয়ে কোনোদিনই পৃথিবী শান্তির পথে এগিয়ে যেতে পারে না। পৃথিবী সৃষ্টির আদিলগ্ন থেকেই মানুষ একটি নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ছুটেছে। একটি রাষ্ট্রের নাগরিক হয়েও দ্বন্দ্ব-সংঘাতে অন্য রাষ্ট্রে আশ্রয় নেওয়া মানুষগুলো সত্যিই দুর্ভাগা। এরা তখন রাষ্ট্রহীন নাগরিক! মানুষের আশ্রয় নিরাপদ করতে বা নিশ্চিত করতে বিশ্ব শক্তিগুলো শান্তি খুঁজতে গিয়ে পৃথিবী অশান্তির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এবং প্রয়োগ, অস্ত্র, প্রাকৃতিক বিপর্যয় (যার পেছনেও মানুষের দায় রয়েছে) প্রভৃতি কারণে মানুষের আজকের পরিণতি। যার দায় নিতে হচ্ছে কিছু মানুষকে। ভাবতে হবে ক্রমেই এই মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব মানুষ অবশ্য কোনোভাবেই এসব পরিস্থিতির জন্য দায় নিতে রাজি নয়। এরা হলো পরিস্থিতি শিকার। বিরূপ পরিস্থিতির শিকার হওয়া এসব মানুষ তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে ছুটছে। এসব আশ্রয়হীন মানুষ ছুটছে একদেশ থেকে আরেক দেশে, এক শহর থেকে অন্য শহরে। অনেক মানুষ তার জীবনের বাকি দিনগুলো এভাবে রাষ্ট্রহীন নাগরিক হিসেবেই কাটিয়ে দিচ্ছে। তারা সব ধরনের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিশ্ব নেতাদের দায়িত্ব হলো এসব মানুষকে তাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে দিয়ে অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।