বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজন বিশেষ শিক্ষাব্যবস্থা

মো. তাহমিদ রহমান

প্রকাশ : ২২ জুন ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

একটি জাতির উন্নয়নের প্রধান গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হলো শিক্ষা। প্রতিযোগিতাময় বিশ্বের মানচিত্রে জাতি হিসেবে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে শিক্ষিত ও দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরির কোনো বিকল্প নেই। উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছানোর জন্য দক্ষ জনশক্তির ভূমিকা অপরিসীম। সৃষ্টিলগ্ন থেকে পৃথিবীতে রয়েছে মানব বৈচিত্র্য। বৈচিত্র্যময় মানবগোষ্ঠীর মধ্যে বিস্ময়কর বৈচিত্র্য হলো অটিজম বা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানব। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে অটিজম বা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষরা একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক তথা রাষ্ট্রীয় ইস্যু। তারা আমাদের মোট জনগোষ্ঠীর একটি বৃহৎ অংশ। একটি দেশের সব জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের পাশাপাশি সবার মেধা ও দক্ষতার সঞ্চালনে দেশটি সমৃদ্ধি লাভ করে। তাই আমাদের মোট জনসংখ্যার বৃহৎ একটি অংশ বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্র থেকে আলাদা রেখে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। জাতির সমৃদ্ধিতে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন এই ব্যক্তিদের অংশগ্রহণ করানোর জন্য প্রয়োজন বিশেষ শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের দক্ষ করে গড়ে তোলা। আমাদের জাতীয়ভাবে বিশেষ শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে এখনই ভাবতে হবে, কারণ Autism Spectrum Disorder (ASD) শিশুর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষা বোর্ডগুলো জাতীয় পরীক্ষায় বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন পরীক্ষার্থীদের জন্য পরীক্ষা গ্রহণের নীতিমালা প্রণয়ন করলেও মাঠ পর্যায়ে সচেতনতা সৃষ্টি না হওয়ায় বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীরা প্রায়ই বঞ্চিত হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার কারণে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের নিয়ে পাঁচটি মন্ত্রণালয় যৌথভাবে কাজ করছে। তাদের অধিকার ও সুরক্ষায় আইনও প্রণয়ন করা হয়েছে। এখন প্রয়োজন বিশেষ এই শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন। এই বিশেষ শিশুরা অনেক ক্ষেত্রেই সৃজনশীল হয়ে থাকে আর সৃজনশীলতা সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত বিস্ময়কর একটি ব্যাপার যা কোনো প্রতিবন্ধকতা দ্বারা আটকে রাখা যায় না। আমরা যদি দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তন করে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের আশীর্বাদ হিসেবে গণ্য করে তাদের জন্য যথাযথ সম্মান ও বিশেষ শিক্ষার ব্যবস্থা করি তাহলে হয়তো আমরা এমন কোনো মানব সন্তান পেয়েও যেতে পারি যে কি না একাই সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে আমাদের শত বছর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে! ঠিক যেমনটি নিজ জাতি ও বিশ্বকে এগিয়ে নিয়ে গেছে স্টিফেন হকিং, আলবার্ট আইনস্টাইন, আইজাক নিউটন, আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, হেলেন কিলার। আমাদের দেশের চলমান উন্নয়ন ব্যবস্থায় অটিজম বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন শিশুরা সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের সম্মুখীন হয় শিক্ষা ক্ষেত্রে। যেহেতু এসব শিশুর ইন্দ্রিয় ক্ষমতা ভিন্ন তাই তাদের প্রয়োজন হয় বিশেষ শিক্ষাব্যবস্থার। আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় প্রতিদিনের শ্রেণীকক্ষের শিখন কাজ আর লিখিত মূল্যায়ন এসব শিশুদের শিক্ষার ক্ষেত্রে এক বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজন তাদের উপযোগী শ্রেণীকক্ষ, প্রশিক্ষক, মূল্যায়ন পদ্ধতি, স্পেশাল শিক্ষক এবং সর্বোপরি ‘সকল শিশুর জন্য শিক্ষা’ আইনটির যথাযথ প্রয়োগ। শিক্ষা একটি জীবনব্যাপী ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। যে কোনো ব্যক্তিকে তার পরিবার-পরিবেশ ও সংস্কৃতিতে সুষ্ঠুভাবে মানিয়ে নেওয়াতে সাহায্য করে শিক্ষা। শিক্ষার এই প্রথাগত ধারাটি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমেই চলমান। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীরা প্রায় ক্ষেত্রে শিক্ষার এই সাধারণ কাঠামোতে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পারে না। শিক্ষা একজন ব্যক্তির সংবিধানসম্মত মৌলিক অধিকার। তাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রচলিত পরিকাঠামোতে রাষ্ট্র কিছু বাড়তি উদ্যোগ গ্রহণ করলেই তাদের শিক্ষার সুযোগ গ্রহণ করানো সম্ভব। আমাদের মাথায় রাখতে হবে বিশেষ শিক্ষা কোনো ভিন্নধর্মী ধারা নয় বরং মূল শিক্ষাধারার একটি সমৃদ্ধ অংশ। বিশেষ শিক্ষাব্যবস্থার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বাধা মুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিক্ষার্থীদের সাধারণ শ্রেণীকক্ষের পাঠ গ্রহণের পাশাপাশি প্রয়োজন অনুযায়ী বিশেষ রিসোর্স রুমের ব্যবস্থা করা। এজন্য প্রয়োজন সরকারিভাবে উপযুক্ত রিসোর্স পার্সন বা বিশেষ শিক্ষক নিয়োগ দান এবং তাদের যথাযথ মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করা। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় আমরা সাধারণত চেতনার বিকাশ, জীবন দক্ষতার বিকাশ, মানবসম্পদের উন্নয়ন, জাতীয় জীবনমানের উন্নয়ন, সামাজিক উন্নয়ন, দায়িত্বশীল নতুন প্রজন্ম সৃষ্টি, পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রগুলোতে লক্ষ্য দিয়ে থাকি। বিশেষ শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রেও উপর্যুক্ত প্রয়োজনগুলো সমমাত্রায় বিদ্যমান থাকার পরও আরো কিছু উল্লেখযোগ্য প্রয়োজনীয়তা উল্লেখের দাবি রাখে। যেমন:

১. বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের সক্ষমতার ক্ষেত্রগুলো শনাক্তকরণে বিশেষ শিক্ষার প্রয়োজন। কেবল তার দুর্বলতার দিক নয়, সাম্যর্থ্যরে দিকটিও শনাক্ত করা ও সুনিশ্চিত করার জন্য বিশেষ শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা আছে।

২. কেবলমাত্র সক্ষমতার দিকটি চিহ্নিত করা নয়, তার যথাযথ ব্যবহার ও দক্ষতাগুলো বিকাশের জন্য বিশেষ শিক্ষার প্রয়োজন।

৩. সাধারণ শ্রেণিকক্ষে যে বিশেষ চাহিদাগুলো পূরণ করা সম্ভব নয়, বিশেষ শিক্ষা সেই সুবিধাগুলো প্রদান করে। তাই বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থী বিশেষ শিক্ষা গ্রহণ করে স্বনির্ভর হয়ে উঠতে পারে।

৪. বিশেষ শিক্ষা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীর শিক্ষক প্রশিক্ষণে নতুন মাত্রা যোগ করে।

৫. বিশেষ শিক্ষার মাধ্যমে জনমানবের মধ্যে চেতনার উন্মেষ ঘটানো যায়।

৬. শিশুর শিক্ষা অধিকার সুনিশ্চিত করতে এবং সংবিধান অনুসরণ করে সব শিশুকে শিক্ষার আওতাভুক্ত করতে বিশেষ শিক্ষার বিকল্প নেই।

৭. বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের চাহিদা ও সক্ষমতা অনুযায়ী ভবিষ্যৎ জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে বিশেষ শিক্ষার কোনে বিকল্প নেই।

৮. বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের নিয়ে পরিবারে যে অনিশ্চয়তা ও প্রতিকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় তা একমাত্র বিশেষ শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে দূর করা সম্ভব।

বিশেষ শিক্ষার মাধ্যমে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের দুর্বলতার ক্ষেত্রগুলোকে যথাযথ বিকশিত করে আত্মবিশ্বাসী, স্বনির্ভর, দায়িত্বশীল ও বাস্তব-সচেতন করে গড়ে তুলতে পারলে পরবর্তীতে সমন্বিত শিক্ষাব্যবস্থায় সহজেই তাদের অংশগ্রহণ করানো সম্ভব হবে।

লেখক: শিক্ষক ও বিশেষ

চাহিদাসম্পন্ন শিশুর পিতা।