ঢাকা ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ২২ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সিন্ডিকেটের কারণে শ্রমবাজার হুমকির মুখে

বিদেশে কর্মী প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে
সিন্ডিকেটের কারণে শ্রমবাজার হুমকির মুখে

সিন্ডিকেটের কারণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান খাত শ্রমবাজার এখন হুমকির মুখে পড়েছে। এই সিন্ডিকেটে মন্ত্রী, এমপি, সরকারের প্রভাবশালী গোষ্ঠী থেকে শুরু করে বায়রার একশ্রেণির ব্যক্তি জড়িত। তারা মালয়েশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, লিবিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রটি কুক্ষিগত রেখেছে। এতে বিদেশ যেতে একজন শ্রমিককে সরকার নির্ধারিত অর্থের চেয়ে দ্বিগুণ-তিনগুণ বেশি অর্থ দিতে হচ্ছে। মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য সরকার নির্ধারিত খরচ জনপ্রতি ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা হলেও সিন্ডিকেট নিচ্ছে গড়ে ৫ লাখ ৪৪ হাজার টাকা করে। শত শত কোটি টাকা তারা হাতিয়ে নিয়েছে। তারপরও তাদের অনেকেই যেতে পারেনি বা পারছে না। এই সিন্ডিকেটের কারণে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার সর্বশেষ তারিখ ৩১ মে’র মধ্যে ১৭ হাজার কর্মী যেতে পারেনি। আরো ২০ হাজার কর্মী অনুমোদন পেয়েও যেতে পারছে না। এসব কর্মীদের ভাগ্যে কি আছে, তা কেউ বলতে পারে না। সিন্ডিকেট এখন মালয়েশিয়া থেকে সউদী আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ, লিবিয়া, সিঙ্গাপুর ও উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে তৎপর হয়ে উঠেছে। বাহরাইন, ওমানের শ্রমবাজার বন্ধ এবং আরব আমিরাতে ভিসানীতি কড়াকড়ি করার কারণে মধ্যপ্রাচ্যে কর্মী পাঠানো কঠিন হয়ে পড়েছে। এমতাবস্থায়, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে সিন্ডিকেট সক্রিয় হয়ে উঠেছে, যা এ খাতের জন্য অশনি সংকেত। এতে দেশগুলোতে কর্মী পাঠানো সংকুচিত হওয়া এবং কর্মীদের প্রতারণার শিকার হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাব মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারে নিশ্চিতভাবেই পড়বে এবং তা রেমিট্যান্সে বড় ধরনের আঘাত হানবে।

বহু বছর ধরে বিদেশে কর্মী পাঠানো নিয়ে সিন্ডিকেট সক্রিয় থাকলেও এখন তাতে সরকার সংশ্লিষ্ট রাঘববোয়ালরা জড়িয়ে পড়ায়, জনশক্তি রপ্তানি বিপর্যয়ের মুখে রয়েছে। এ খাতে সরকার কোনো শৃঙ্খলা ও নিয়মণ্ডনীতি বজায় রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। বলা বাহুল্য, যেসব তরুণ বিদেশে যায়, তারা নিজ উদ্যোগে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য যায়। ভিটামাটি, বাড়িঘর, জায়গা-জমি, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি ও ধারদেনা করে তারা বিদেশ পাড়ি জমায়। এই পাড়ি জমাতে গিয়ে অনেকে দালালের খপ্পড়ে কিংবা সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। অনেকে গন্তব্যস্থলে গেলেও তাদের যে কাজের কথা বলে নেয়া হয়, সে কাজ পায় না, কিংবা অবৈধ হয়ে যায়। আমরা দেখেছি, শত শত কর্মী লিবিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে সেখানে কাজ না পেয়ে অবৈধ পথে ইউরোপে পাড়ি জমাতে গিয়ে সাগরে সলিল সমাধির শিকার হয়েছে এবং হচ্ছে। যারা এ পথে গিয়ে গন্তব্যস্থলে পৌঁছেছে, তাদের অনেকেই সংশ্লিষ্ট দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে জেলে পড়ে আছে। শুধু মধ্যপ্রাচ্য থেকে নয়, অন্যান্য দেশ থেকে অনেকে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে আমেরিকাণ্ডমেক্সিকো সীমান্তে গিয়ে আটকা পড়ে আছে। অনেকে এ পথ অতিক্রম করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছে ও করছে। এসব সংবাদ বিশ্ব গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছে, যা দেশের ভাবমর্যাদাকে চরমভাবে ক্ষুণ্ণ করছে। অথচ আমরা কথায় কথায় দেশকে অর্থনীতির ‘ইমার্জিং টাইগার’, ‘উন্নয়নের রোল মডেল’ ইত্যাদিতে আখ্যায়িত করে মুখে ফেনা তুলে ফেলছি। এর বিপরীতে অর্থনীতির অন্যতম প্রধান স্তম্ভ রেমিটেন্সের ক্ষেত্রে কি দেখছি? এটা কি, উন্নতির স্মারক বহন করে? উন্নয়নশীল অনেক দেশই বিদেশে কর্মী পাঠায়। সেসব দেশে কর্মী পাঠানো নিয়ে এমন সিন্ডিকেট ও অরাজক পরিস্থিতি দেখা যায় না। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, সিন্ডিকেটের কারণে শ্রমবাজার ভয়াবহ সংকটের মুখে পড়েছে। শুধু কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রেই নয়, বিদেশ থেকে দেশে ফেরার জন্য বিমানের টিকিট নিয়েও সিন্ডিকেটবাজি চলছে। মধ্যপ্রাচ্যগামী বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের টিকিটের দাম বাড়িয়ে সিন্ডিকেট কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে দেশে ফেরার ওয়ান ওয়ে টিকিটের দাম ৪০-৫০ হাজার টাকা হলেও নেয়া হচ্ছে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, বাংলাদেশ বিমানে সিট খালি রেখে গমনাগমন করলেও টিকিট নেই বলে দিচ্ছে। এসবই হচ্ছে টিকিট নিয়ে সিন্ডিকেটের কারসাজি। উল্লেখ করা প্রয়োজন, ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশ অনেক বিদেশি এয়ারলাইন্সের বকেয়া পরিশোধ করতে পারছে না। এজন্য কোনো কোনো বিদেশি এয়ারলাইন্স বাংলাদেশে কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন (আইএটিএ)-এর হিসাবে, বিদেশি এয়ার লাইন্সের প্রায় ৩২৩ মিলিয়ন ডলার বাংলাদেশে আটকা পড়ে আছে। বকেয়া পরিশোধের ক্ষেত্রে সংস্থাটি গত জুনে নাইজেরিয়ার পর বাংলাদেশকে দ্বিতীয় শোচনীয় দেশ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশ এ পাওনা পরিশোধ করতে পারছে না। এতে দেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ভুল নীতির কারণে ডলার সংকট যেমন কাটছে না, তেমনি বিভিন্ন দেনাও পরিশোধ করতে পারছে না। মধ্যপ্রাচ্যে দেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সউদী আরবে প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ লাখ বাংলাদেশি কর্মী কাজ করে। দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলে আউটসোর্সিং কোম্পানি খুলে হাজার হাজার কর্মী নিয়ে মাসের পর মাস ফেলে রাখা হয়েছে। আয় করা দূরে থাক, সেখানে তাদের ধারদেনা করে খাবার কিনে খেতে হচ্ছে। রিয়াদস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস, জেদ্দায় বাংলাদেশ কনস্যুলেট অফিস ও বিএমইটিতে অসংখ্য অভিযোগ দিয়েও তারা কোনো সমাধান পাচ্ছে না। বিভিন্ন রিক্রুটিং এজেন্সির অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে বিদেশে তাদের দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায় কাটাতে হচ্ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, করোনা মহামারির কারণে সউদী আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো অর্থনৈতিক মন্দাবস্থার কবলে পড়লেও এখন সেখানে ট্রিলিয় ট্রিলিয়ন ডলারের ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে। এসব দেশে এখন অনেক শ্রমশক্তির প্রয়োজন। বিভিন্ন দেশ থেকে তারা কর্মী নিচ্ছে। এদিক থেকে আমরা ক্রমেই পিছিয়ে যাচ্ছি। কেন পিছিয়ে যাচ্ছি, তা বোধকরি ব্যাখ্যা করে বলার অবকাশ নেই। সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে সেখানে বিপুল জনশক্তি রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। শুধু মধ্যপ্রাচ্যে নয়, ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও ব্যাপক শ্রমশক্তির চাহিদা রয়েছে। দেশগুলোতে নিজস্ব শ্রমশক্তি হ্রাস পাওয়ায় বাইরের শ্রমশক্তির প্রতি তাদের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব দেশেও বাংলাদেশের শ্রমবাজার সম্প্রসারিত হওয়ার প্রচুর সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে। শুধু প্রয়োজন, দেশগুলোর সরকারের সাথে যোগাযোগ এবং সুদূরপ্রসারি চিন্তা ও পরিকল্পনার মাধ্যমে যথাযথ প্রক্রিয়ায় কর্মী পাঠানো।

বিদেশে শ্রমবাজার সম্প্রসারণ, শ্রমশক্তি রপ্তানি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে শ্রমবাজার কেন সংকুচিত হচ্ছে এবং কি সমস্যা, তা নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর উচিত ছিল শুরুতেই বিভিন্ন দেশের সরকারের সাথে কথা বলে সমঝোতা ও সমন্বয় করা। অথচ শ্রমবাজারকে দৃঢ় করে রেমিট্যান্স বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এ মন্ত্রণালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এ দায়িত্ব মন্ত্রণালয় যথাযথভাবে পালন করেনি। এটা একধরনের ব্যর্থতা। বিদেশে দূতাবাসসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও বছরের পর বছর ধরে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। যাদের মাধ্যমে দেশের রেমিট্যান্স সমৃদ্ধ হচ্ছে, তাদের সমস্যা সমাধান ও সুযোগ-সুবিধা দেখার বিষয়ে তারা চরম উদাসীনতা ও উপেক্ষা প্রদর্শন করছে। এর মধ্যে সিন্ডিকেটের কালো থাবা বিস্তৃত হয়েছে। এতে যে, শ্রমবাজার বিঘ্নিত হবে, তাতে সন্দেহ নেই। এ ব্যাপারে সরকারকে সরাসরি পদক্ষেপ নিতে হবে। সিন্ডিকেট কারা তৈরি করেছে এবং কারা জড়িত, তা সরকার ভাল করেই জানে। তাদের বিরুদ্ধে সরকারকে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। এমন শাস্তি দিতে হবে, যা দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। বিদেশে শ্রমবাজার বৃদ্ধি ও সুসংহত করতে সরকারকে সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে। দেশের চরম অর্থনৈতিক দুর্দশার মধ্যে সরকারের সামনে জনশক্তি রপ্তানি নির্বিঘ্ন ও মসৃণ করে রেমিট্যান্স বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে। এ খাতটিকে অর্থনীতির মেগা প্রকল্প হিসেবে নিয়ে তা বাস্তবায়নে সব ধরনের পরিকল্পনা নিতে হবে। সিন্ডিকেট ভেঙে কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে। সউদী আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ব্যাপক কর্মী পাঠানোর সুযোগ রয়েছে। এ সুযোগ হাতছাড়া করা কোনোভাবেই উচিত হবে না। এজন্য, দেশগুলোতে কর্মীরা কী ধরনের প্রতিবন্ধকতার শিকার হচ্ছে, বন্ধ হয়ে যাওয়া শ্রমবাজার কীভাবে খোলা যায়, তা নিয়ে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত