ইতিহাস

পলাশীর ট্র্যাজেডি এবং বিশ্বাসঘাতকের ইতিহাস

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান

প্রকাশ : ২৪ জুন ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়। নবাব সিরাজউদ্দৌলার সৈন্যরা পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজদের সাথে মাত্র ১ ঘণ্টার প্রহসনের যুদ্ধে পরাজিত হন।

নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে চক্রান্ত করে যারা সিংহাসনচ্যুত ও হত্যা করেছিল বা নেপথ্যে ষড়যন্ত্রকারীর অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল পরবর্তীকালে তাদের পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ হয়েছিল মর্মান্তিকভাবে। এদের কাউকে নিমর্মভাবে হত্যা করা হয়েছে, কেউ দীর্ঘদিন কুষ্ঠ রোগে ভুগে মারা গেছে, কাউকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারা হয়েছে। কেউ মারা গেছে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে। কাউকে নদীতে ডুবিয়ে মারা হয়েছে। কেউ নিজের গলায় নিজেই ক্ষুর বসিয়েছে।

ইতিহাসের পাতায় অনেকেরই অস্বাভাবিক ও নিষ্ঠুরতম মৃত্যু হয়েছে। ইতিহাস কি নির্মম ও সত্য। পলাশী-পরবর্তী ঘটনা এসবই প্রমাণ করে। পলাশীর এসব ষড়যন্ত্রকারীরা কে কীভাবে মৃত্যুবরণ করেছে তা নিম্নে তুলে ধরা হলো-

মীর জাফর : ইতিহাসের সবচেয়ে ঘৃণ্যতম ব্যক্তি। মীর জাফরকে লোকে ক্লাইভের গর্দভ বলে জানত। মীর জাফর নবাব আলীবর্দী খাঁর বৈমাত্রেয় বোন শাহখানমকে বিয়ে করেছিলেন। সেই সম্পর্কে তিনি ছিলেন নবাব সিরাজউদ্দৌলার নিকটতম আত্মীয়। তিনি ছিলেন একজন বোকা, রাজনীতি জ্ঞানবিহীন একজন সেনাপতি মাত্র। মীর জাফর কোরআ শরিফ ছুঁয়ে শপথ করেছিলেন তার বাঙলার সিংহাসনের উপর কোনো মোহ নেই। পরবর্তীতে এই বিশ্বাসঘাতক মীর জাফরের হস্তেই কুষ্ঠ ব্যাধি দেখা দেয়। মীর জাফরের মৃত্যু হয় অত্যন্ত মর্মান্তিকভাবে। তিনি এই দূরারোগ্য কুষ্ঠ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েই ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দে ৭৪ বছর বয়সে মারা যান। তার মৃত্যুর পূর্বে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু মহারাজ নন্দকুমার কিরীটেশ্বরীর চরণামৃত এনে তাকে পান করতে দিয়েছিলেন। বলাবাহুল্য এই চরণামৃত মুখে করেই তার মৃত্যু হয়।

ইয়ার লতিফ : ইয়ার লতিফ খান ছিলেন নবাব সিরাজের একজন সেনাপতি। তিনি পলাশী ষড়যন্ত্রের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। পলাশীর যুদ্ধের মাঠে তার বাহিনী মীর জাফর, রায় দুর্লভের বাহিনীর ন্যায় পুত্তলির মতো দাঁড়িয়ে ছিল। যুদ্ধ-পরবর্তী ইয়ার লতিফ নিখোঁজ হয়ে যান। অনেক ঐতিহাসিকের ধারণা ইংরেজরা তাকে গোপনে হত্যা করেছিল।

রায় দুর্লভ : রায় দুর্লভ ছিলেন নবাবের একজন সেনাপতি। তিনিও মীর জাফরের সাথে সক্রিয়ভাবে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। পলাশীর যুদ্ধে তার বাহিনী মীর জাফরের সাথে যুক্ত হয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে ছিল। ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দে মীর কাশিম ইংরেজদের সাথে বক্সারের যুদ্ধে যাবার প্রাক্কালে ষড়যন্ত্রকারী রায় দুর্লভের গলায় বালুর বস্তা বেঁধে মুঙ্গেরের দূর্গশীর্ষ থেকে জীবন্ত দেহ নিক্ষেপ করেন গঙ্গার বুকে। এভাবেই গঙ্গার বক্ষে সলিল সমাধি হয় তার।

জগৎ শেঠ : ইতিহাসের জঘন্যতম ষড়যন্ত্রকারী রাজস্থানের কুসীদজীবী ব্যবসায়ী ফতেহ চাঁদের বংশধর ছিলেন জগৎশেঠ হিসাবে পরিচিত মহাতাব চাঁদ। প্রথমত তারা নবাবের বিরুদ্ধে ইংরেজদের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় এবং পরে মীর জাফর ও অন্যান্যদের এতে যুক্ত করে। নবাব সিরাজউদ্দৌলার ষড়যন্ত্রের মূল হোতা ছিলেন এই জগৎ বিখ্যাত মাড়োয়ারী জগৎ শেঠ। জগৎ শেঠের পরিবারের বার্ষিক আয় ছিল ৪০ লাখ টাকা। অর্থাৎ বর্তমানের মুদ্রা মানে ৯০০ কোটি টাকা। মুর্শিদাবাদের টাকশাল ছিল জগৎ শেঠের একক এখতিয়ার। তার আসল নাম ছিল স্বরূপ চাঁদ জগৎ শেঠ। জগৎ শেঠের পিতামহের নাম ছিল ফতেহ চাঁদ জগৎ শেঠ। জগৎ শেঠের মৃত্যু হয় রায় দুর্লভের মতোই। বক্সারের যুদ্ধে যাবার প্রাক্কালে ষড়যন্ত্রকারী জগৎ শেঠকে গলায় বালুর বস্তা বেঁধে মুঙ্গেরের দুর্গ প্রাকার থেকে নবাব মীর কাশিমের আদেশে গঙ্গায় নিক্ষেপ করে ডুবিয়ে মারা হয়। বাঙলার ইতিহাসে পলাশী-পরবর্তী অধ্যায় যেমন ন্যক্কারজনক তেমনি এ থেকে অনেক শিক্ষণীয় বিষয়ও আমাদের রয়েছে।

উমিচাঁদ : পলাশীর যুদ্ধের অন্যতম ষড়যন্ত্রকারী পাঞ্জাবি ব্যবসায়ী ছিলেন এই উমিচাঁদ। ক্লাইভ উমিচাঁদকে নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র গড়ে তোলার প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। পলাশী যুদ্ধ-পরবর্তী সিরাজের পতন হলে তাকে নবাব সম্পত্তির চার আনা অংশ দিতে হবে বলে ইংরেজদের সঙ্গে এক জাল চুক্তিপত্র সই করে এই উমিচাঁদ। ইংরেজ নৌ-সেনাপতি ওয়াটস ছিলেন এই চুক্তিপত্রের প্রধান ব্যক্তি। লাল কাগজ ও সাদা কাগজে এই দুটি চুক্তিপত্রের সই হয়। পরবর্তীতে সিরাজের পতনের পরে ওয়াটস প্রদত্ত এই চুক্তি জাল বলে প্রমাণিত হয়। উমিচাঁদ নবাবের ধনরত্ন ও সম্পদ থেকে মোট ৪০ লাখ টাকার দাবিদার ছিলেন, যা বর্তমান মুদ্রামানে ৯০০ কোটি টাকার সমান। উমিচাঁদ এই জাল দলিলের জন্য সিরাজের সম্পত্তির কোনো অর্থ পাননি। মূলত ওয়াটসই ছিলেন এই জাল দলিলের উদ্ভাবক। এই অর্থের শোকে উমিচাঁদ বদ্ধ পাগল হয়ে রাস্তায় নেমে যান। খাওয়া দাওয়া ছেড়ে মুর্শিদাবাদের পথে প্রান্তরে আকাশের দিকে মুখ করে লম্ফ দিতে দিতে সর্বদাই লাল কাগজ ও সাদা কাগজ বলে চিৎকার করে বেড়াতেন। এভাবে উমিচাঁদ চিৎকার করতে করতে তার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে অকস্মাৎ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। কি নিদারুণ ও দুর্বিষহ তার এই মৃত্যু।

রাজা রাজ বল্লভ : আমাদের ঢাকার রাজা ছিলেন রাজা রাজবল্লভ। পলাশির যুদ্ধে ইংরেজদের সঙ্গে সর্বদা সহযোগিতা করেছেন। রায়দুর্লভ ও জগৎশেঠের একত্রে সহযোগী ছিলেন এই ঢাকার কুখ্যাত ষড়যন্ত্রকারী রাজা রাজবল্লভ। তারও শেষ পর্যন্ত হয় অস্বাভাবিক মৃত্যু। এক অপঘাতে তিনি নিদারুণভাবে নিহত হন। পরবর্তীকালে তার সমূদয় কীর্তি পদ্মা নদী গ্রাস করে কীর্তিনাশা নাম ধারণ করেন।

মহারাজা নন্দকুমার : পলাশীর ষড়যন্ত্রের পর নন্দকুমারকে মীর জাফর দেওয়ান নিযুক্ত করে সব সময় তাকে নিজের কাছে রাখতেন। নন্দকুমার ভূষিত ছিল মহারাজা উপাধীতে। কিন্তু ওয়ারেন হেস্টিংসের সাজানো মিথ্যা মামলায় আসামির কাঠগড়ায় তার বিচার হয়। অদৃষ্টের কি নির্মম পরিহাস তাকে শেষ পর্যন্ত এই বিচারের রায়ে শেওড়াগাছে ঝুলতে হয় ফাঁসি কাষ্ঠে। মহারাজ নন্দকুমারের সাথে মীর জাফরের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। মীর জাফর তার শেষ জীবনে যাবতীয় কাজকর্ম নন্দকুমারের পরামর্শনুসারে করতেন। তার অন্তিম শয্যায় নন্দকুমারই তার মুখে কিরীটেশ্বরা দেবীর চরণামৃত তুলে দিয়েছিলেন।

ঘষেটী বেগম : ঘষেটী বেগম ছিলেন আলীবর্দী খানের কন্যা। সিরাজের খালা ঘষেটী বেগম তার পোষ্য ছেলেকে সব সময় বাংলার সিংহাসনে বসানোর জন্য ষড়যন্ত্র করতে থাকেন। সেই জন্য সিরাজউদ্দৌলা নবাব হবার পরই ঘষেটী বেগমকে হিরাঝিল প্রাসাদে বন্দি করে রাখেন। এছাড়া ঘষেটী বেগম প্রচুর অবৈধ ধন-সম্পদেরও মালিক ছিলেন। পরবর্তীতে পলাশীর যুদ্ধে সিরাজের পতন ও মৃত্যুর পরে মীর জাফরের পুত্র মীরণ ঘষেটী বেগমকে ঢাকার জিঞ্জিরায় বন্দি করে রাখেন। জিঞ্জিরার সন্নিকটে খরস্রোতা বুড়ীগঙ্গা নদীতে পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক ঘষেটী বেগমকে নৌকায় তুলে বুড়ীগঙ্গা নদীতে নৌকা ডুবিয়ে মেরে ফেলে। ঘষেটী বেগমের আর্তনাদ আহাজারী নদীর কিনার থেকে নিশুতি রাতে পথচারীরা শুনতে পেয়েছিল।

মীরণ : মীরণ পলাশী ষড়যন্ত্রের পরবর্তী প্রধানতম নায়ক ছিলেন। তার পুরো নাম ছিল মীর মোহাম্মদ আলী খান। সিরাজের মূল হত্যাকারী, সিরাজের মাতা আমেনা বেগম, সিরাজের ভাই মির্জা মেহেদীকেও নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিল মীরণ। তারই নির্দেশে মোহাম্মদী বেগ সিরাজকে হত্যা করে। শুধু হত্যা নয়, সিরাজউদ্দৌলার লাশকে মীরণ ক্ষত-বিক্ষত করে তারই প্রিয় হাতির পৃষ্ঠে বেঁধে গোটা মুর্শিদাবাদ শহর প্রদক্ষিণ করেছিলেন। যাতে সবাই এই বীভৎস দৃশ্য দেখে যেন পরবর্তীতে বাংলার বুকে বিদ্রোহ করতে না পারে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় সিরাজের মাতা আমেনা বেগম তার ছেলের লাশ দেখার জন্য দৌড়ে হাতির কাছে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান এবং সেসময় মীরণের দুর্বৃত্তরা সিরাজের মাতাকে কিল, চড় ও ঘুষি মেরে আবার জেলখানায় বন্দি করে রাখেন। হাতিটা কিন্তু সে সময় সিরাজের লাশ তার পৃষ্ঠে নিয়ে আমেনা বেগমের সামনে বসে পড়েন। মীরণের মৃত্যু ঘটে বজ্রপাতে। মীর জাফর তখনও বাংলার নবাব। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতোই পিতার কানে সে সংবাদ পৌঁছে ছিল। তিনি মীরণের মৃত্যু শুনে বেঁহুশ হয়ে পড়েন। মুর্শিদাবাদে মীরণের লাশ, নিয়ে আসা হলো। কি বীভৎস বিকৃত পোড়ালাশ। পিতাকে না দেখতে দিয়ে লাশ দাফন করা হলো। এভাবেই মীরণের মৃত্যু।

ইতিহাস বলে মীরণকে আঁততায়ীর দ্বারা হত্যা করা হয়েছিল। প্রচণ্ড ঝড় আর ঘন ঘন বজ্রপাতের সময় মদ্যপ মীরণের তাঁবুতে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয় এবং হত্যা করা হয়। এটা আর কিছুই নয় আসল ঘটনাকে চাপা দেওয়ার একটা কৌশল মাত্র। মীরণকে হত্যা করে ইংরেজদের নির্দেশে মেজর ওয়ালস্। তবে তার এই ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়ার জন্য ইংরেজরা বজ্রপাতে মীরণের মৃত্যু মিথ্যা গল্প বানিয়েছিল।

মোহাম্মদী বেগ : মোহাম্মদী বেগ ছিল নবাব আলীবর্দী খাঁর পৌষ্য। আলীবর্দী খাঁর আমল থেকেই তার পরিবারের একজন সদস্যরূপে তারই স্নেহছায়ায় সে বেড়ে ওঠে। সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গেও তার বিশেষ সখ্যতা ছিল। সিরাজউদ্দৌলাকে মীরণের নির্দেশে হত্যা করেছিল এই মোহাম্মদী বেগ, যাকে আলীবর্দী খাঁ কোলে পিঠে করে মানুষ করেছিলেন। মোহাম্মদী বেগ একটা খঞ্জর দিয়ে আঘাত করে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। দিনটি ছিল ১৭৫৭ খৃষ্টাব্দের ৩রা জুলাই। নবাব সিরাজ এ সময় তার কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাননি। তিনি কেবল তার কাছ থেকে দু’রাকাত নামাজ পড়ার অনুমতি চেয়েছিলেন। বলাবাহুল্য কুখ্যাত মোহাম্মদী বেগ সিরাজের সেই অন্তিম ইচ্ছাও প্রত্যাখ্যান করেছিল। মোহাম্মদী বেগ তার সংসারের দাম্পত্য কলহে বদ্ধ উন্মাদ অবস্থায় এক কূপে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে। এভাবেই তার ভবলীলা সাঙ্গ হয়।

ওয়াটসন : ওয়াটসন ছিলেন ইংরেজ নৌ সেনাপতি। পলাশীর ষড়যন্ত্রকারী ওয়াটসন ক্রমাগত ভগ্নস্বাস্থ্য হয়ে কোনো ঔষধে ফল না পেয়ে কলকাতাতেই করুণভাবে মৃত্যুমুখে পতিত হন।

ওয়াটস : পলাশীর যুদ্ধে ওয়াটস ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি পাল্কিতে করে রমণী সেজে মীর জাফরের বাড়িতে গিয়ে চুক্তিতে মীর জাফরের স্বাক্ষর এনেছিলেন। পলাশীর যুদ্ধের পর কোম্পানির কাছ থেকে বরখাস্ত হয়ে মনের দুঃখে ও অনুশোচনায় ইংল্যান্ডে হঠাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান।

স্ক্রাফটন : পলাশী যুদ্ধের পরবর্তী সিরাজের সম্পদের লুটপাটের পেছনে স্ক্রাফটন বিশেষভাবে কাজ করেছিলেন। ইতিহাস থেকে জানা যায় বাঙলার বিপুল ধন-সম্পদ লুণ্ঠন করে বিলেতে যাওয়ার পথে জাহাজ ডুবি হয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

রবার্ট ক্লাইভ : পলাশী যুদ্ধের পর হিরাঝিল প্রাসাদের ধনাগারটি লুটের বখরা বাবদ ক্লাইভ পান ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এছাড়া কৃতজ্ঞতার চিহ্নস্বরূপ তাকে আরো ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা দেন মীর জাফর। স্ক্রাফটন সাহেবের বিবৃতি থেকে জানা যায় রবার্ট ক্লাইভ ৩০ খানা নৌকা বোঝাই করে ধনরত্ন নিয়ে যান ইংল্যান্ডে।

বাংলার ছিয়াত্তরের মনন্তর, হত্যা, রাহাজানি, ঘুষ, জালিয়াতি, নারী ধর্ষণ, বাংলার নবাব পরিবারবর্গের হত্যার জন্য লন্ডনের হাউজ অব কমন্স সভায় ক্লাইভের বিচার হয়। বিচারের রায়ে ক্লাইভের ফাঁসির হুকুম হয়। এই ফাঁসির দণ্ড থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য তিনি আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থন করেন। বহু কষ্টে তিনি মৃত্যুদণ্ড থেকে মুক্তি পান। রবার্ট ক্লাইভের মৃত্যুও মর্মান্তিকভাবে হয়েছিল। পলাশী ষড়যন্ত্রের ঘটনা তাকে পরবর্তীতে কোনোদিন মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে দেয়নি। স্বজনদের উপর ক্ষোভে, অভিমানে ইংরেজ পক্ষের মূল নায়ক বরার্ট ক্লাইভ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে নিজের গলায় নিজে ক্ষুর চালিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

মীর কাশিম : নবাব মীর কাশিম ছিলেন মীর জাফরের জামাতা ও মীরণের ভগ্নিপতি। ভগবান গোলায় পলাতক ছদ্মবেশী নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে মীর কাশিমই সর্বপ্রথম ধরিয়ে দিয়েছিলেন। পরে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তিনি বাঙলার নবাব হন এবং এ সময় ইংরেজদের সাথে তার বিরোধ বাঁধে। কয়েকটি খন্ডযুদ্ধে তিনি পরাজিত হন।

বহু প্রস্তুতি বহু প্রচেষ্টা, যুদ্ধ সংগ্রাম করে ব্র্রিটিশ শক্তির কাছে পরাজিত হওয়ার পরে তিনি বনে-জঙ্গলে পথে-প্রান্তরে ছুটে বেড়াতে থাকেন। জঙ্গলেই তার দুই পুত্র ইংরেজদের হাতে নিহত হন।

অতঃপর পরাধীন দেশ ও জাতির সব প্রচেষ্টা, স্বাধীনতার সব আশা, আকাঙ্ক্ষার নিষ্ফল প্রমাণিত করে দীর্ঘ সংগ্রাম শেষে ১৭৭৭ সালের ৬ জুন মীর কাশিম দিল্লির রাজপথে এক বেওয়ারিশ লাশ হয়ে পড়ে থাকেন। এককালের লাখ লাখ নর-নারীর দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, বঙ্গ, বিহার, উড়িষ্যার মহা সম্মানিত নবাব মীর কাশিম আলী খানের দেশ উদ্ধারের সব প্রচেষ্টা আশা-আকাঙ্ক্ষার অবসান হয় এবং অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস তার গাত্রের শেষ অঙ্গাভরণ দিয়েই তার অন্তিম শয্যা রচিত হয়। কি নির্মম নিয়তি ও অদৃষ্টের পরিহাস। কারণ ইতিহাস কোনো ষড়যন্ত্রকারীকেই ক্ষমা করে না।

এভাবেই বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীরা পলাশী যুদ্ধের কিছুকালের মধ্যেই বিভিন্ন পন্থায় মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুমুখে পতিত হন। পলাশীর ইতিহাস বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস। এই শিক্ষাই আমাদের সবার মনে রাখার অঙ্গীকার করা উচিত।

লেখক-গবেষক, কলামিস্ট পাঠান পাড়া, (খান বাড়ী) কদমতলী, সদর, সিলেট-৩১১১