ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সিলেটের পরিবেশ নিয়ে ভাবনা

আফতাব চৌধুরী
সিলেটের পরিবেশ নিয়ে ভাবনা

এক অদ্ভুত অন্ধকারের মুখোমুখি এখন আমরা যেন কবি জীবনানন্দ দাশের সে অদ্ভুত আঁধার- যার রূপকথার ভয়াবহতার মধ্যদিয়ে আমরা প্রত্যক্ষ করি, চক্ষুম্মানদের চেয়ে অন্ধরাই বেশি দেখতে পায় এবং সে অন্ধদের পরামর্শ ছাড়া সমাজ অচল।

সভ্যতা স্থবির। প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল আগের সামাজিক সাংস্কৃতিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে জীবনানন্দ হতাশায় কাতর হয়ে নিশ্চয়ই ওই উক্তি করেছিলেন। কিন্তু আজকের অন্ধকার এত বেশি ভয়াবহ যে, ‘অদ্ভুত আঁধার’ এ শব্দযুগল দিয়ে তার প্রকৃত স্বরূপ নির্ণয় করা সম্ভব নয়। দিনে দিনে সভ্যতা যত অগ্রসর হয়েছে, বিজ্ঞান প্রযুক্তির সাফল্য যত জীবনকে গতিশীল করেছে, ততই যেন জীবনানন্দের উচ্চারিত সে ‘অদ্ভুত আঁধার’ তার সর্বগ্রাসী বাহু প্রসারিত হয়েছে। শামসুর রাহমান যে কারণে প্রায় দু’দশক আগে লিখেছিলেন, ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ। অদ্ভুত আঁধারের গ্রামে যাওয়ার কিংবা উদ্ভট উঠের পিঠে সওয়ার হবার মতো নির্মম বাস্তবতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে পরিবেশ দূষণ আজ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে, সেখানে অন্ধকার অতল, উদ্ভট উটগুলো এখন হিংস্র হায়েনায় রূপান্তরিত’। বিগত ১০০ বছরের এ সামান্য সময়ে মানুষের এ যান্ত্রিক সভ্যতা প্রাকৃতিক পরিবেশকে এতটা বিপন্ন করে ফেলেছে যে, বিশ্বের সচেতন ব্যক্তিমাত্রই উদ্বিগ্ন।

আমাদের এ প্রিয় সিলেট নগরীর কথাই ধরা যাক। এ নগরী ১০ লাখ মানুষের আবাসস্থল। এ শহরের বাতাসে সীসার (খবধফ) পরিমাণ অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে অনেক অনেক বেশি। বাতাসের বিষাক্ত সীসা সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে শিশুদের। বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা মনে করেন শিশুদের মস্তিস্ক বিকাশের মূল অন্তরায় সীসা। তাদের হাঁপানি রোগের মূল কারণও এ সীসা। বড়রাও সীসার ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। এ বায়ুদূষণের জন্য মূলত যান বাহনই দায়ী। সিলেটের ব্যস্ততম রাস্তার ক’মিনিট চলাচল করলেই যান বাহনের ধোঁয়ায় চোখে জ্বালা করতে থাকে। পরিস্থিতি মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছানোর বায়ুদূষণ নগরবাসীকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। এ সিলেট শহরের বাতাস, পানি, মাটি সবকিছুই যে ধীরে ধীরে বিষাক্ত হওয়ার পথে, এ বিষয়ে কারো মতভেদ থাকার কথা নয়। যাদেরই নাক, কান, চোখ, ফুসফুস আছে, তারা সবাই-এর সত্যতা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেন। দুর্ভাগ্য হলো- এটা আধুনিক সভ্যতারই একটি অভিশাপ। ১৯৯০ সালে জাতিসংঘ ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের এক রিপোর্টে বলা হয়, এশীয় প্যাসিফিক রিজিয়নে ২০১০ সালে বায়ুদূষণে প্রতি ছ’জনের মধ্যে একজন ব্যাংককবাসী এলার্জিতে আক্রান্ত হয়। থাইল্যান্ডে বাতাসে ভাসমান বস্তুকণার গ্রহণীয় মাত্রা হলো প্রতি কিউবিক মিটারে ৩৩০ মাইক্রোগ্রাম, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত মাত্রা ১২০ মাইক্রোগ্রাম। জাপানের জন্য ১০০ মাইক্রোগ্রাম। ১৯৯৪ সালে ব্যাংককের বাতাসে ভাসমান বস্তুকণা পাওয়া গেছে, প্রতি কিউবিক মিটারে ৩৪০ মাইক্রোগ্রাম। বর্তমানে কোনো কোনো এলাকায় এটা ৫ গুণ বেড়েছে। দক্ষিণ এশীয় ওইসব শহরের বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ হচ্ছে- আয়রন, স্টীল, ব্রিকস, ফার্টিলাইজার ও সিমেন্ট ফ্যাক্টরিগুলো।

সিলেটে এসবগুলো পরিবেশগত সমস্যা বিদ্যমান এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আশঙ্কাজনকভাবে এর মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের শহরের নাকের ডগায় আস্তাকুড় সঙ্কুচিত হবে বা বিলুপ্ত হবে কোনো দূষণের কারণে নয়, আবাসন নির্মাণের জন্য ‘প্রয়োজনীয়’ ভূমিখণ্ডের সংস্থান ঘটালে। সে যাই হোক, পাশ্চাত্যের ধারায় আবর্জনা পুড়িয়ে নষ্ট করার ব্যাপারে একদিন আপত্তি উঠল। কেন না, আদতে সব পদার্থই অনিঃশেষ, কেবল মাত্র বস্তুর রূপান্তর ঘটে, তা গলে-পুড়ে অন্য রকম কোনো পদার্থ বদলে যায়, অযথা কঠিন বস্তু তরল হয়, তরল বস্তু উবে যায় বায়বীয় আকারে। অনেক সময় অপপ্রয়াসের ফলে আপাত বিষহীন বস্তু থেকে তৈরি হতে পারে তীব্র বিষ। যেমন ধরুন, একটা সিগারেট আপনার পকেটে থাকলে তেমন ক্ষতিকারক নয়। কিন্তু সেটির দহন ঘটলে উৎপন্ন হবে কার্বন মনোক্সাইডসহ বেশ কটি গ্যাস, বাষ্পীভূত নিকোটিন এবং আরো কিছু জৈব যোগ। আপনার পায়ের তলায় এক কার্টুন সিগারেট থাকলে ক্ষতির কোনো সম্ভাবনা নেই, কিন্তু একটি জ্বলন্ত সিগারেটের একচিলতে ধোঁয়া আপনাকে প্যাসিভ স্মোকিং এর শিকারে পরিণত করবে। এক টুকরো পিভিসি হাতে খুব ঘষলে উঠে আসতে পারে ক্যাডমিয়ামের মত ধাতু, যা পলিভিনাইল ক্লোরাইডকে শক্ত সমর্থ করার জন্য যুক্ত করা হয়। কিন্তু পিভিসি পোড়ালে তৈরী হয় ডাইঅক্সিন নামক অতি বিষাক্ত একটি বায়বীয় পদার্থ। সামান্য পরিমাণ ডাইঅক্সিন প্রজনন ক্ষমতায় বিপর্যয় ঘটাতে পারে। একটি শিশুর পিভিসি খেলনা যদি তার সামান্য মোমের আগুনেও পোড়ে, যে পরিমাণ বিষাক্ত ডাইঅক্সিন গ্যাস নির্গত হবে, তা তার যৌবনে নিয়ে আসতে পারে মর্মান্তিক অভিশাপ। তাছাড়া কোনো একটা জায়গায় পিভিসি আবর্জনা পোড়ালে আশপাশে বিস্তৃত জায়গাজুড়ে তার ছড়িয়ে পড়তে বাধা কোথায়। সুতরাং পাশ্চাত্যে আপত্তি উঠল আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলার বিরুদ্ধে। কোনো সীসার আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলেই বা কী লাভ? জমিতে সে সীসা তো থাকবে। বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে তা ছড়িয়ে পড়বে চারপাশে।

সিলেট শহরে একসময় প্রচুর গাছপালা ছিল, সবুজের জন্য এর সুনাম ছিল প্রচুর দেশের ভেতরে এবং বাইরে কিন্তু একশ্রেণির দুষ্কৃতকারী শহরের বিভিন্ন এলাকার গাছ কেটে নিজের পকেট ভারী করছে। মাত্র কয়েক দিন আগেও সিলেট শহরের উপশহর এলাকার প্রায় ৩০০ গাছ সিটি কর্পোরেশনের নামে একদল সন্ত্রাসী দিন দুপুরে কেটে ফাইল করে রাত্রে ট্রাকে করে পাঁচার করে প্রচুর অর্থ পকেটস্থ করে। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের পর আজ পর্যন্ত এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এতে ক্ষোভ বিরাজ করছে এলাকাবাসীর মনে।

আবর্জনা পোড়ালে ধোঁয়ায় দূষিত হবে আকাশ, ভষে¥ দূষণ ঘটবে মাটিতে। অতএব, স্বাস্থ্য সচেতন পাশ্চাত্যে আপত্তি উঠল এভাবে আবর্জনা পোড়াবার বিরুদ্ধে। নিষেধাজ্ঞা জারি হলো যত্রতত্র প্লাস্টিকের বোতল ফেলে দেওয়ার ব্যাপারেও। মার্কিন সরকার জানিয়ে দিল, কো¤পানিকেই তাদের এঁটো বোতল সাফ করে দিতে হবে। এর ফলে এরা সকলে মিলে লস এঞ্জেলসে ‘প্লাস্টিক রিসাইক্লিং কর্পোরেশন অফ ক্যালিফোর্ণিয়া’ নামে একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলল। এরা মিউনিপ্যাল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে প্লাস্টিক বোতল কিনে চড়া দামে অন্য দেশে রপ্তানি করার কাজে নিযুক্ত। এসব কাজে পয়সাও কম নয়। জানা যায়, এক মার্কিন দালাল বছরে প্রায় ১০০ কোটি টাকা কামায় আবর্জনা রপ্তানির ব্যবস্থা করে। ১৯৮০ সালে মার্কিন মুলুকে ১ টন ময়লা মুক্ত হওয়ার খরচ যেখানে ছিল ১৫ ডলার, ১৯৮৯ তে সেটা গিয়ে দাঁড়ায় ২৫০ ডলারে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট। বৃক্ষরোপণে জাতীয় পুরস্কার (১ম স্বর্ণপদক) প্রাপ্ত।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত