গত কয়েক মাস ধরে বিষধর রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সাপের উপদ্রব নিয়ে দেশজুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ ভয় পাচ্ছে খেত-খামারে যেতে, রাতে চলাফেরা করতে, মাছ ধরতে এবং অন্যান্য স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে। মেঘনা, যমুনা তীরবর্তী জেলাগুলোতে এ সাপের উপদ্রব আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। পত্রপত্রিকার খবর অনুযায়ী, এ বছর সাপটির কামড়ে প্রায় ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। সাপটির উপদ্রব নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আলোচিত হচ্ছে। রাসেলস ভাইপার মূলত উত্তরাঞ্চলের বরেন্দ্র অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসবাস করে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এটি দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে। নদ-নদীর পানিতে ভেসে বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়েছে। প্রাণিবিদ্যা গবেষকরা বলেছেন, এতদিন এটি এক ফসলি জমিতে খাদ্য হিসেবে ইঁদুর শিকারের জন্য বেশি বিচরণ করত। এখন দেশে দুই বা তিন ফসলি জমি বৃদ্ধি পাওয়ায় এর খাদ্যের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া এবং বংশ বিস্তারে সুবিধা হওয়ায় এটি দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। ৬৪টি জেলার মধ্যে ১৭টি জেলায় রয়েছে এর উপস্থিতি। এ বছর ২৮টি জেলায় এর উপস্থিতি দেখা গেছে। সবচেয়ে বেশি বিচরণ রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে। সাপটির অভিযোজন ক্ষমতা আগের চেয়ে বেশি বেড়ে যাওয়ায় বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। আগামীতে এর সংখ্যা আরো বাড়তে পারে। এর প্রজননকাল মে থেকে জুলাই। খাবারের জোগান বেড়ে যাওয়ায় এর প্রজননও বাড়ছে। একটি স্ত্রী প্রজাতির রাসেলস ভাইপার ২০ থেকে ৪০টি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৮০টি পর্যন্ত বাচ্চা ফুটাতে পারে। বাচ্চাগুলোর দৈর্ঘ্য হয় ১৫ থেকে ২০ সেন্টিমিটার। প্রথম থেকেই এগুলোর কামড় বিষাক্ত হয়। এ সাপের বসবাস শুষ্ক ফসলি জমিতে বেশি। এছাড়া, গর্ত ও ঝোপ-ঝাড়সহ শুষ্ক এলাকায় দেখা যায়। বর্ষা এলে বের হয়ে আসে।
দেশে বর্তমানে ১০৪ প্রজাতির সাপ রয়েছে। এর মধ্যে ৩০ প্রজাতি বিষধর। সবচেয়ে বেশি বিষধর রাসেলস ভাইপার। আক্রমণের ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত ক্ষীপ্র এবং ১ সেকেন্ডের ১৬ ভাগের ১ ভাগ সময়ের মধ্যে ছোবল মারতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সাপটি কামড়ালে দেড় ঘণ্টার মধ্যে আক্রান্তকে চিকিৎসা দিতে না পারলে মৃত্যু হতে পারে। তাই দ্রুত চিকিৎসকের কাছে ও হাসপাতালে নিতে হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশে বর্ষায় পানিবৃদ্ধি ও বন্যা দেখা দিলে বিভিন্ন প্রজাতির সাপ আশ্রয়ের জন্য উঁচু জায়গা এমনকি মানুষের ঘরে এসে পড়ে। এতে প্রতি বছরই সাপের কামড়ে অনেকের মৃত্যু হয়। তবে বর্ষা আসার আগেই রাসেলস ভাইপারের উপদ্রব বৃদ্ধি এবং এর আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে আতঙ্ক দূর করতে হবে। শুধু জনগণের উপর তা ছেড়ে দিলে হবে না। পাশাপাশি মানুষকে সচেতন ও করণীয় সম্পর্কে উদ্যোগ নিতে হবে। যে কোনো সাপই মানুষের কাছে আতঙ্ক হয়ে দেখা দেয়। এর মধ্যে বিষধর হলে এবং এর ছোবলে মৃত্যু হলে আতঙ্ক আরো বেশি বেড়ে যায়। রাসেলস ভাইপারের বিস্তার, উপদ্রব ও আক্রমণের হার যেভাবে বাড়ছে, তাতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়া স্বাভাবিক। এতে মানুষের স্বাভাবিক চলাফেরা বিঘ্নিত হচ্ছে। এভাবে আতঙ্ক নিয়ে বসবাস করা যায় না। এর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া অর্থনীতিতেও পড়তে পারে। বিশেষ করে, কৃষি খাতে কৃষক যদি সাপের আতঙ্কে জমিতে যেতে না পারে, তাহলে ক্ষতির মুখে পড়বে। কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হবে। এছাড়া স্বাভাবিক চলাফেরা বাধাগ্রস্ত হবে। যেসব এলাকায় রাসেলস ভাইপারের উপদ্রব বৃদ্ধি পেয়েছে, সেসব এলাকার জনজীবন যে ব্যাহত হচ্ছে, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। রাসেলস ভাইপারের যে আতঙ্ক জনজীবনে ছড়িয়ে পড়েছে, দ্রুত এর প্রতিকারের ব্যবস্থা করতে হবে। আতঙ্ক দূর করতে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নেয়া জরুরি। পরিবেশ, প্রাণিসম্পদ, স্বাস্থ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়কে এ ব্যাপারে উদ্যোগী হতে হবে। যেসব এলাকায় এ সাপের বিস্তার ঘটেছে, তা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেয়া যায়, সে পদক্ষেপ নিতে হবে। সাপে কমড়ের চিকিৎসা দ্রুত দেয়ার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে আক্রান্তকে যথাসময়ে চিকিৎসা দেয়া যায়। মাঠ পর্যায়ে চিকিৎসা ক্যাম্প করতে হবে। মানুষকে সচেতন ও আশ্বস্ত করতে প্রচারণা চালাতে হবে। যারা কৃষিকাজে নিয়োজিত এবং জমিতে যায়, তাদের সচেতন হতে হবে। জমিতে যাওয়ার আগে গামবুট ও জিন্স প্যান্ট পরে যেতে হবে। যে কারণে রাসেলস ভাইপার আবাসস্থল থেকে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে, সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে তা নির্ণয় করে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। বিষধর এ সাপ নিয়ন্ত্রণে সরকারকেই যথোচিত পদক্ষেপ নিতে হবে।