ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

পরিবেশ

বজ্রপাতে মৃত্যু এবং কিছু কথা

প্রদীপ সাহা, লেখক কলামিস্ট
বজ্রপাতে মৃত্যু এবং কিছু কথা

প্রতিবছরই আমাদের দেশে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে বজ্রপাতে মৃত্যু। সাধারণত মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত বজ্রপাত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বজ্রপাতের পরিমাণ দিন দিন বাড়িয়ে তুলছে। দেখা গেছে, যেসব এলাকায় আগে খুব একটা বজ্রপাত হতো না, এখন সেসব এলাকাতেই বজ্রপাত বেড়ে গেছে। গত এক দশকের হিসাবে দেখা গেছে, প্রতিবছরই বাড়ছে বজ্রপাতের ভয়াবহতা ও বিস্তৃতি। এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত এক দশকে বজ্রপাতে মৃত্যু হয়েছে ৩ হাজার চারজন। চলতি বছর বজ্রপাতের আতঙ্ক আরো বাড়ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বজ্রপাতের ঘটনা বেড়ে চলেছে। অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ৮৪ লাখ বজ্রপাত হচ্ছে এবং এর ৭০ ভাগই হয় এপ্রিল থেকে জুন মাসে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে। জাতিসংঘ বলছে, বাংলাদেশে গাছপালা কেটে ফেলা, খোলা মাঠে উঁচু গাছ ধ্বংস করে ফেলা এবং অসচেতনতার কারণে বজ্রপাতে মৃত্যু আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে।

‘সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরাম’ (এসএসটিএএফ)-এর এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বজ্রপাত বাড়ার প্রধান কারণ হলো বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি এবং উঁচু গাছপালা কেটে ফেলা। কোথাও এক ডিগ্রি উষ্ণতা বাড়লে বজ্রপাত বাড়ে ১২ শতাংশ। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, গাছপালা কেটে ফেলা, বাতাসে ধুলিকণা বেড়ে যাওয়া এবং মোবাইল টাওয়ারের মতো আধুনিক প্রযুক্তি বজ্রপাতের পরিমাণ ক্রমাগত বাড়িয়ে তুলেছে। বাংলাদেশে গত ২৫ বছরে তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। বজ্রপাত বৃদ্ধির অন্যতম কারণ তাপমাত্রা বৃদ্ধি। আর এ তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রধান কারণই হলো জলবায়ু পরিবর্তন। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দেশে বজ্রপাত বাড়ার পাশাপাশি বেড়ে গেছে বজ্রপাতপ্রবণ এলাকাও। দেশের যেসব এলাকায় আগে খুব একটা বজ্রপাত হতো না, সেখানে এখন বজ্রপাত হচ্ছে। দেশের হাওর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল সাধারণত বজ্রপাতপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। সম্প্রতি দেশের পাহাড়ি এলাকায় বজ্রপাত এবং প্রাণহানি আগের চেয়ে বেড়ে গেছে। যেসব এলাকায় তাপমাত্রা বেড়েছে, সেসব এলাকায় বজ্রপাতও বেড়েছে। যেসব স্থানে বজ্রপাত আগের থেকেই বেশি, সেখানে এখন আরো বেশি বজ্রপাত হবে; যেসব এলাকায় বজ্রপাত কম ছিল, সেখানেও বজ্রপাত বাড়বে।

‘হেলিয়ন জার্নালে’ প্রকাশিত গবেষণায় বলা হয়েছে, ‘প্রাক-বর্ষা সময়ে তাপমাত্রা বেশি থাকে এবং এ সময় বজ্রঝড় হয়। যাকে আমরা বলি ‘কালবৈশাখি’। কখনও কখনও এ ঝড়ের সঙ্গে থাকে শিলাবৃষ্টি। বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে তাপমাত্রা যদি ১ ডিগ্রি বৃদ্ধি পায়, তাহলে তীব্র আবহাওয়া ১২ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে।’ গ্লোবাল স্টাডি অনুযায়ী ‘ইন্টার গর্ভনমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’ (আইপিসিসি)-ও এমনটাই বলেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, বজ্রপাতে দেশের ১৩টি জেলায় অর্থাৎ সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নওগাঁ, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নেত্রকোনা, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, সিলেট, গাইবান্ধা, পাবনা ও দিনাজপুরে মৃত্যু সবচেয়ে বেশি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয় সুনামগঞ্জে এবং এখানে বজ্রপাতে দেশের মোট প্রাণহানি ঘটে থাকে ৪ দশমিক ৮২ শতাংশ। ২০১৫ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বজ্রপাতে দেশে ২ হাজার ১৪২ জন মারা গেছেন এবং আহত হয়েছেন ৫৩৮ জন। জরিপে দেখা যায়, ২০১৯ সালে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১৯৮ জন, ২০২০ সালে ছিল ২৫৫ জন। কিন্তু ২০২১ থেকে ২০২৩ সালে বজ্রপাতে গড়ে মৃত্যুর সংখ্যা ৩০০ জনেরও বেশি ছিল।

বাংলাদেশের বজ্রপাতবিষয়ক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৯৯০ থেকে ১৯৯৯ সালে দেশে বজ্রপাতে গড়ে মারা গেছেন ৩০ জন, আহত হয়েছেন ২২ জন। ২০০০ থেকে ২০০৯ সালে গড়ে মারা গেছেন ১০৬ জন, আহত হয়েছেন ৭২ জন। অন্যদিকে, ২০১০ থেকে ২০১৭ সালে প্রতিবছর গড়ে মারা গেছেন ২৬০ জন এবং আহত হয়েছেন ২১১ জন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে বজ্রপাতে মৃত্যু বেড়ে গেছে। জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী, বজ্রপাতে বাংলাদেশে প্রতিবছর তিন শতাধিক মানুষ বজ্রপাতে মারা যান। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর বজ্রপাতে ২০ জনের কম মারা যান। নতুন এ দুর্যোগ পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। আবহাওয়াবিদ এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা আরো বাড়তে পারে। কারণ বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অধিক বজ্রঝড় ও বজ্রপাত হওয়ার মতো আবহাওয়া তৈরি হয়ে আছে। পরিবেশ বিজ্ঞানের ভাষায়, বজ্রপাতে মৃত্যু হলো ‘ডাইরেক্ট ওয়েদার রিলেটেড ডেথ’। বজ্রপাতে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে কয়েক মিলি সেকেন্ডে প্রায় ৩০ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বা ৮০০ ভোল্টেজ বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। এতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। সরাসরি আঘাতপ্রাপ্ত না হলেও সে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মৃত্যুর পাশাপাশি বজ্রপাতে আহত হয়ে বেঁচে থাকা ব্যক্তিদের পক্ষাঘাত, দুর্বলতা, মাথাঘোরা, স্মৃতিশক্তি এবং যৌনশক্তি হ্রাসের মতো উপসর্গ নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়।

দেশে বজ্রপাত বৃদ্ধির সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন দৃঢ়ভাবে জড়িত। এ পরিবর্তন সামুদ্রিক ঝড়, ঘূর্ণিঝড়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা, পরিবর্তিত বৃষ্টিপাতের ধরন এবং চরম তাপমাত্রাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপত্তিতে প্রকাশ পাচ্ছে। তথ্যমতে, বছরে বিশ্বে ২৫ মিলিয়ন বজ্রপাত হয়। সরকার বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এটিকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করেছে। আমরা জানি না, মৃত্যুর এই হার কোথায় গিয়ে ঠেকবে। বজ্রপাতে মৃত্যু আমাদের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে সচেতনতা অত্যন্ত বড় একটি বিষয়। বজ্রপাতপ্রবণ এলাকাগুলোতে তালগাছ রোপণের পাশাপাশি বজ্রপাত নিরোধক যন্ত্রও (লাইটেনিং অ্যারেস্টার মেশিন) বসানো হয়েছে এবং আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। বজ্রপাতের পূর্বাভাস খুব আগে থেকে দেওয়া যায় না। আবহাওয়া অধিদপ্তর মাত্র ৩০-৪০ মিনিট আগে পূর্বাভাস দিতে পারে। কিন্তু মূল সমস্যা হলো আমাদের সচেতনতার অভাব। আকাশে যখন কালো মেঘ হয়, তখনই একজন মানুষকে তার জীবনরক্ষার জন্য নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়া উচিত। উঁচু গাছের নিচে আশ্রয় নেওয়া যাবে না কিংবা খোলা জায়গায় থাকলে কী করতে হবে, সে বিষয়ে আমাদের সচেতন থাকতে হবে। আমরা দেখি, আকাশে মেঘ দেখলেই অনেকে আরো উৎসাহ নিয়ে মাছ ধরতে যান, খোলা মাঠে কাজ করতে থাকেন। এসব থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে এবং বজ্রপাতের বিষয়ে আরো সচেতন হতে হবে। তবেই হয়তো আমরা বজ্রপাতে মৃত্যুর হাত থেকে কিছুটা হলেও নিজেকে বাঁচতে পারব।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত