রাজনীতি

প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে যে আশা ছিল জনগণের

সুমন দত্ত, লেখক সাংবাদিক

প্রকাশ : ২৬ জুন ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ভারতের নির্বাচনের কারণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর এই সফর দেরিতে অনুষ্ঠিত হয়। শেখ হাসিনা পঞ্চমবারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ায় ভারত সফর করতে চেয়েছিলেন। এদিকে শি জিন পিং চেয়েছিল শেখ হাসিনা ভারতের আগে চীন সফর করুক। চীনের সেই প্রস্তাবে রাজি হয়নি প্রধানমন্ত্রী। এদিকে ভারতের বিজেপি সরকার আসন্ন লোকসভা নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। বিজেপি ক্ষমতায় থাকবে কি না এ নিয়ে ছিল ভেতরে ভেতরে সন্দেহ। এজন্য নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারতে আসতে বলা হয়। তার আগেই ভারতের পক্ষ থেকে উচ্চ পদস্থ কূটনীতিবিদ বিনয় কোয়াত্রা বাংলাদেশ সফর করেন। তিনি সফরের সূচি চূড়ান্ত করেন। বর্তমান সরকারকে টিকিয়ে রাখতে ভারতের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। এ কারণে ভারত সফর বর্তমান সরকারের কাছে যে কোনো কাজের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। শেখ হাসিনার পূর্ব নির্ধারিত এই সফর শেষ হয়েছে। দেশে ফিরেছেন তিনি। এখন তার সফর ঘিরে শুরু হয়েছে রাজনীতি। যে রাজনীতির কোনো শেষ নেই। ভারত সফরে কি পেল বাংলাদেশ? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফর শেষে দেশে ফেরার পর এই প্রশ্নটা এখন সবার মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছে। প্রচারে বেশি তিস্তার পানি। অথচ এ বিষয়ে কোনো আলাপ হয়নি দুই দেশের। পশ্চিমবঙ্গে গজলডোবা বাঁধের কারণে তিস্তায় পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। গঙ্গা চুক্তি হলেও প্রয়োজনমতো পানি পাচ্ছে না বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ভারতের এই পানি আগ্রাসনের কারণে বাংলাদেশের কৃষি আজ হুমকির মুখে। শীতের সময় বাংলাদেশে পানির চাহিদা বেশি থাকে। দুই দেশের পানি বিশেষজ্ঞরা একে শুষ্ককালীন মৌসুম বলে থাকেন। শীতকালীন ফসলের উৎপাদন বাড়ানো যায় না পানি সংকটের কারণে। অন্যদিকে বর্ষাকালে পানির চাহিদা না থাকলেও ভারত এই সময়ে ফারাক্কা, গজলডোবা, টিপাইমুখ সব বাঁধের দরজা খুলে দিয়ে বাংলাদেশকে পানিতে ভাসিয়ে দেয়। ভারতের এই আচরণ কি বন্ধু সুলভ? তারপরও আমাদের বলতে হয় ভারত আমাদের বন্ধু। বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে আয়তনে খুব ছোট একটি দেশ। ভারতের সঙ্গে কোনো কিছুতে তুলনায় আসে না। সেই হিসেবে ছোট দেশ বড় দেশকে কি দিতে পারে? বরং বড় দেশই, ছোট দেশকে অনেক কিছু দিতে পারে, অন্য কথায় দেবার ক্ষমতা রাখে। তাই ভারতের কাছে আমাদের চাহিদার তালিকা দীর্ঘ। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে নিত্যপণ্যের উচ্চ মূল্য রয়েছে। এদিকে ভারত কয়েকটি নিত্যপণ্য বাংলাদেশে রফতানি বন্ধ করে রেখেছে। যা বন্ধু সুলভ আচরণ নয়। এই নিত্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখতে ভারতের উচিত সব পণ্যের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া। বাংলাদেশের জনগণ আশা করেছিল প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়টি ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরবেন। জনগণ ভেবেছিল দেশের প্রধানমন্ত্রী মোদিকে বলবেন, আপনার দেশ হুট-হাট করে পেঁয়াজ, আদা, রসুন, আলু, চিনি, গম বন্ধ করে দেয়ার কারণে বেকায়দায় পড়ে বাংলাদেশের আমদানিকারকরা। স্টক খালি হয়ে যাবে এই ভয়ে তারা দাম বাড়িয়ে জনগণকে কষ্ট দেয়। এটা কীভাবে রোধ করা যায়, দুই দেশকে তা ভেবে দেখতে হবে।

নেপাল, ভুটান ও ভারতের সেভেন সিস্টারে বাংলাদেশের পণ্যের চাহিদা আছে। এই দেশগুলোর বাজারে বাংলাদেশের পণ্য সরাসরি যেতে পারে না ভারতের বাধার কারণে। অল্প একটু জায়গা করিডোর দিলে কিংবা কয়েক কিলোমিটার ভারতের ভিতর দিয়ে টানেল তৈরির সুযোগ দিলে বাংলাদেশ স্থলপথে সরাসরি ব্যবসা করতে পারে নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে। অথচ এ ধরনের কোনো আলোচনা বাংলাদেশের পক্ষ থেকে করা হচ্ছে না। ভারত যদি নিরাপত্তার কারণে ওপর দিয়ে যেতে বাধা দেয় তবে নিচ দিয়ে যাবার সুযোগ করে দিক। বাংলাদেশের প্রতি ভারতের বন্ধু সুলভ আচরণ হলে এতে ভারতের আপত্তি থাকার কথা নয়। প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরের আগ থেকেই দুই দেশের কানেকটিভিটি নিয়ে কথা হচ্ছিল। ভারতীয় পক্ষের সব দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে। এবার ভারত উদার হয়ে বাংলাদেশকে নেপাল, ভুটান ও সেভেন সিস্টারে যাওয়ার পথ করে দিক। বাংলাদেশের সরকারের ওপর ভারতীয় কর্তৃপক্ষের আস্থা আছে এটা গর্বের সঙ্গে বললেও কাজের বেলা এটা প্রতিফলিত হচ্ছে না। বাংলাদেশকে অনুমতি দেব দিচ্ছি বলে ঝুলিয়ে রাখা হচ্ছে।

আজকে বাংলাদেশের পদ্মা সেতু দিয়ে কলকাতা আগরতলা রেল নেটওয়ার্ক তৈরি হয়ে গেছে। এতে ভারতের চরম এক উপকার করেছে বাংলাদেশ। এর প্রতিদানস্বরূপ বাংলাদেশকে ভারতের স্থল সীমান্তগুলো ব্যবহার করে নেপাল, ভুটান ও সেভেন সিস্টারে প্রবেশের সুযোগ দিক। আশা করি এদেশের সরকার ভারতকে এ বিষয়ে রাজি করাতে পারবে।

প্রতি বছর ভারতে যায় কয়েক লাখ বাংলাদেশি। ভারতীয় হাইকমিশনের তথ্য মতে গত বছর ২০২৩ সালে বাংলাদেশের জন্য ২০ লাখ ভিসা ইস্যু করা হয়েছে। এই চাহিদা দিন কে দিন বেড়েই চলেছে। সম্প্রতি ভারত মাল্টিপল ভিসা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। ভিসা ব্যবস্থা সহজ করলে দুই দেশের নাগরিকদের মধ্যে সম্পর্ক বৃদ্ধি পাবে।

বাংলাদেশের কলকাতা ভিসা কেন্দ্র দালালনির্ভর। দালাল ছাড়া সেখানে ভারতীয়দের বাংলাদেশের ভিসা মেলে না। বাংলাদেশকে এই জায়গায় কাজ করতে হবে। নিজ দেশের পর্যটন বৃদ্ধি করতে কলকাতায় ভিসা সেন্টারে সেবার মান উন্নত করতে হবে।

একটা সময় বাংলাদেশ থেকে বহু শিক্ষার্থী পড়াশোনার জন্য ভারত যেত। এখন সেই সংখ্যাটা কমে গেছে। বেড়ে গেছে চিকিৎসা নেওয়া লোকজনের সংখ্যা। এ কারণে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সেবার ক্ষেত্রে ভারত কি ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে তার একটি কৌশল বর্তমান সরকার তৈরি করতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে ই-মেডিকেল ভিসার ঘোষণা এসেছে ভারতের পক্ষ থেকে। এটা বাংলাদেশের জনগণের জন্য একটি সুসংবাদ। ওষুধ বানানোর ক্ষেত্রেও ভারতীয় অভিজ্ঞতা আমাদের দরকার। ুভারতের ওষুধের দাম বাংলাদেশের চাইতে বেশি। গুণগত মান বাংলাদেশের চাইতে ভালো। ভারতের ফার্মাসিটিক্যাল কোম্পানি বাংলাদেশে বিনিয়োগ করুক। এতে বাংলাদেশ লাভবান হবে।

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক ভারতে রফতানি করা যেতে পারে। কিছুদিন আগে টাঙ্গাইল শাড়ি নিয়ে বিতর্ক হলো। সেই শাড়ি ভারতে রফতানি করা যায়। বাংলাদেশের জামদানির চাহিদাও ভারতের সর্বত্র। এছাড়া তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে জিনসের প্যান্টের চাহিদা রয়েছে। এগুলোর মার্কেট বাড়ানো যায়। ভারতের বাজার বড়। এসব পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ লাভবান হতে পারে। এছাড়া মিঠা পানির মাছ রফতানি করা যায় পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরাতে। বর্তমানে তা হচ্ছে ছোট পরিসরে।

বাংলাদেশ থেকে অনেক পণ্যই ভারতে যাচ্ছে তবে বেশিরভাগ চোরাই পথে। উভয় দেশ রাজস্ব বঞ্চিত হয় এসব কর্মকাণ্ড পরিচালনার কারণে। দুই দেশকে এসব বন্ধ করতে হবে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের লিখিত বাণিজ্য ভারসাম্য ব্যাপক। আর এর সঙ্গে অলিখিত ব্যবসা যোগ হলে তার ব্যবধান কত বাড়তে পারে তা কল্পনা করাও কঠিন। সম্প্রতি নারিকেলের মতো পণ্য ভারত থেকে আনছে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা। কয়েকমাস আগে কাঁচামরিচ আমদানি করে আনা শুরু হয়েছে।

বাংলাদেশ ভারতের বন্ধু হলে সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে হত্যা কি কারণে? ভারতের সঙ্গে নেপাল, ভুটান, চীন, পাকিস্তান, মিয়ানমার সীমান্ত রয়েছে। ওই সীমান্তগুলো বছরজুড়ে শান্ত থাকে। বাংলাদেশের সীমান্তে এমন কি ঘটে যেখানে বিএসএফকে গুলি করতে হয়। সীমান্তের প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে হবে। বেনাপোল সীমান্তে দুই দেশের দুর্নীতিবাজ নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের হেনস্তার শিকার হয় সাধারণ পর্যটকরা। প্রকাশ্যে পর্যটকদের কাছে ভিক্ষা চায় দুই দেশের পুলিশ। দীর্ঘদিনের এই চর্চা বন্ধ করতে অসমর্থ দুই দেশ। ভারত-বাংলাদেশ অন্য সীমান্তে এই দৃশ্য অনুপস্থিত। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ছিটমহল সমস্যার সমাধান, সমুদ্র-সীমা নির্ধারণ, স্থল-সীমানা চিহ্নিতকরণ এবং সেটা ভারতের সংসদে পাস করে স্বীকৃতি প্রদান বাংলাদেশের জন্য বিরাট এক অর্জন। ক্ষুদ্র চোখে এসব দেখার সুযোগ নেই। বর্তমান সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকার কারণে এই কাজগুলো সম্পন্ন হয়েছে। এতদিন এসব নিয়ে রাজনীতি করত বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল পক্ষ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এসব সমস্যা ঝুলে ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফলতা এই জায়গায়। জ্বালানি সেক্টরে ভারতের বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে বাংলাদেশে। উত্তর বঙ্গে ডিজেল সরবরাহ এখন সহজ করা হয়েছে। আগে চট্টগ্রাম হতে ডিজেল সরবরাহ করা হতো। এতে বেশ কয়েকদিন সময় ব্যয় হতো। পরিবহন খরচ বেড়ে যেত। এখন তা আর হচ্ছে না। আইটি সেক্টরে বাংলাদেশ ভারতের বিনিয়োগ চায়। ভারত এখানে কাজ করছে ধীরগতিতে। আশা করা হচ্ছে আগামীতে ভারতে বাংলাদেশে আইটি হাব তৈরি করবে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে। তেমন পথেই হাঁটছে দুই দেশ। ভারতের নেইবার ফাস্ট পলিসি এই সম্পর্ককে আরো এগিয়ে নেবে। বাংলাদেশের রেল নেটওয়ার্ক তৈরিতে ভারত কাজ করছে। বর্তমান সরকার দেশের সব জেলাকে রেল নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা নিয়েছে। এতে দেশের প্রতিটি জেলায় উন্নয়ন হবে। আর ভারত এক্ষেত্রে নানা ধরনের সহায়তা দিতে পারে। বাংলাদেশের রেল নেটওয়ার্ক যত উন্নত হবে ভারতের উত্তরপূর্ব রাজ্যগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা তত উন্নত হবে। এটা মাথায় রেখেই দুই দেশের কাজ এগিয়ে যাচ্ছে।