পাহাড় কাটায় প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে

৩৬ দফা সুপারিশ কার্যকর করা প্রয়োজন

প্রকাশ : ২৬ জুন ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ফের মাটি চাপা পড়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১০ জনের করুণ মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। যারা মারা গেছে তাদের মধ্যে নারী ও শিশু রয়েছে। মৌসুমি বায়ু প্রবাহে পাহাড়ের পরিস্থিতি আরো নাজুক করে দিতে পারে। রয়েছে আরো পাহাড় ধসের শঙ্কা। এতে বড় ধরনের হতাহতের ঘটনা ঘটতে পারে। এমন অভাবনীয় মৃত্যু মানুষ মেনে নিতে পারে না। কয়েকদিন আগে সিলেটে একই পরিবারের তিনজন মাটিচাপা পড়ে মারা গিয়েছিল। তার রেশ কাটতে না কাটতেই আবারও মর্মান্তিক দুর্ঘটার শিকার হলো মানুষ। সাধারণ বৃষ্টিপাত হলেই এখন পাহাড় ধসের অবতারণা হচ্ছে। প্রশাসনিকভাবে কার্যকর এবং বলিষ্ঠ পদক্ষেপের অভাবেই একের পর ঘটে চলেছে দুর্ঘটনা। পাহাড়ের কোন অঞ্চল মারাত্মক ঝুঁিকপূর্ণ, তা প্রশাসন চিহ্নিত করেছে। তার পরও কেন পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হচ্ছে না? এ সরল প্রশ্নের কোনো উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় না অনেক সময়। একটি ঘটনার পর আমাদের টনক নড়ে। কিছুদিন তা বহাল থাকে। আবার সব কিছু আগের নিয়মে চলতে থাকে। এভাবে আমরা পাহাড়ের অনেক বোবা কান্নার সাক্ষী হয়েছি। প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে কি আমরা এভাবেই পাহাড় চাপা পড়ে মরব?

পাহাড় ধসের অন্যতম কারণ হলো, পাহাড় কেটে আমরা নগ্ন করে ফেলেছি। তার ফলে পাহাড় এখন দাঁড়াতে পারছে না। পাহাড়ের অবকাঠামোগত বৈশিষ্ট্য বিনষ্ট করায় প্রবল ঝড় বৃষ্টিতে মাটি ধরে রাখা পাহাড়ের পক্ষে আর সম্ভব নয়। আমরা নির্বিচারে গাছ কেটে পাহাড় উজাড় করে ফেলেছি। গাছের শিকড় মাটি শক্ত করে ধরে রাখার কাজটি করে যেত। গাছ কেটে ফতুর করায় পাহাড় তার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। একেকটি পাহাড় ধরিত্রীর জন্য খিলান স্বরূপ। পাহাড়ের মাটি এবং গাছ কাটার ফলে বৃষ্টিপাত এবং ভূমিকম্পে মাটি নড়বড়ে হয়ে যাওয়ায় এবং প্রবল ভূমি ধসে পাহাড়ের মাটি গলে নিচের দিকে নামতে থাকে। কিছু লোভী মানুষ পাহাড়ের পাদদেশের জায়গা দখল করে সেখানে নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে ঘর ভাড়া দিয়ে থাকে। এভাবে একসময় খেটে খাওয়া মানুষগুলোকে মৃত্যুর মুখে পতিত হতে হয়। ২০০-৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতই ভূমি ধসের জন্য যথেষ্ট। সেখানে ৪০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হচ্ছে। ২০০৭ সালে ৯৫০ মিলি মিটার পর্যস্ত বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছিল। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যে মৃত্যু হলো তাতে সেখানকার পরিস্থিতি যে আরো ভয়ানক তা কারো বুঝতে বাকি নেই। আরো বড় ঘটনার জন্য কি আমরা এখন প্রহর গুনব, নাকি প্রশাসনিকভাবে কোনো প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে? দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট এলাকা এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, কক্সবাজারে পাহাড় রয়েছে। তবে বৃহত্তম চট্টগ্রামে ১৫ হাজার ৮০৯ বর্গমাইল বিস্তৃত এলাকাতেই মূলত পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে থাকে। এসব পাহাড়ের যেসব অঞ্চলে ঘনবসতি এবং মানুষের বিচরণ বেশি সেসব পাহাড় টিলাতেই দুর্যোগ-দুর্বিপাক বেশি ঘটছে। এ এলাকার বান্দরবান ও আলীকদম উপজেলায় দুর্যোগপূর্ণ বেশি। এর মধ্যে লামা উপজেলার হরিণমারা, চিউসিমারা, ফাইতং, তেলুনিয়া, জামালিয়া, কামিয়াখালী ও রূপসী এলাকা। লামা পৌর এলাকার হাসপাতাল পাড়া, লুনারবিল, কুড়ালিয়ার টেক, টিএনটি পাহাড় এবং আলীকদম উপজেলার ক্রপ পাতা, পোয়ামহরী, আমতলী ও বাবুপাড়া সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।

২০০৭ সালে পাহাড়ে মহাবিপর্যয়ের পর চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে ২৮টি কারণ এবং ৩৬ দফা সুপারিশ প্রণয়ন করা হয়েছিল। তার বাস্তবায়নের অগ্রগতি নেই। সেটি কার্যকর করা হলে পাহাড় ধসের পরিমাণ অনেক কমে যেত। পাহাড় ধসের ২৮টি উল্লেখযোগ্য কারণ হলো: ভারি বর্ষণ, বালুর আধিক্য, পাহাড়ের উপরিভাগে গাছ না থাকা। গাছ কেটে ভারসাম্য নষ্ট করে ফেলা, পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকির্পূণ বসবাস, বৃষ্টিপাতের পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না করা ইত্যাদি। অপরদিকে ৩৬টি সুপারিশ বাস্তবায়নের মধ্যে ছিল: জরুরি ভিত্তিতে বনায়ন, গাইড ওয়াল নির্মাণ, নিষ্কাশন ও শক্ত করে সীমানা প্রাচীর তৈরি করা, পাহাড়ের পানি ও বালু অপসারণের ব্যবস্থা গ্রহণ, বসতি স্থাপন টেকসই করা, যত্রতত্র পাহাড়ি বালু উত্তোলন না করা, পাহাড় এলাকার ১০ কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা নিষিদ্ধ করা, পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে হাউজিং প্রকল্প করতে না দেওয়া, মতিঝর্না এবং বাটালী হিলের পাদদেশে থাকা বসতি উচ্ছেদ করে পর্যটন স্পট করা, পাহাড় কাটায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা ইত্যাদি। এসব সুপারিশসের বাস্তবায়ন ঘটেনি। একারণে মৃত্যুর মিছিল বেড়েই চলেছে। গত কয়েক দশকে হাজারের মতো মানুষের প্রাণ গেছে পাহাড় ধসের ঘটনায়। এর মধ্যে ১৯৯৬ সালে ৭ জন, ১৯৯৭ সালে ৭, ১৯৯৯ সালে তিন, ২০০৩ সালে ১০, ২০০৪ সালে ৫, ২০০৫ সালে ৩, ২০০৬ সালে ২, ২০০৭ সালে ১২৭, ২০০৮ সালে ১৩, ২০০৯ এবং সালে ৩, ২০১০ সালে ৫৬, ২০১১ সালে ১৩, ২০১২ সালে ৯০, ২০১৫ সালে ১৯, ২০১৭ সালে ১৮০, ২০২৩ সালে মারা গেছে চারজন। এ পরিসংখ্যান বলছে, পাহাড় ধস হবে আর তাতে মৃত্যুর মিছিল বাড়বে। প্রশাসনিক কোনো দায় ও দায়িত্ব যেন এক্ষেত্রে নেই। সত্যি কি নেই?