সভ্যতায় সম্পর্কের মায়াজাল সম্পর্ক মরে যায়, মানুষ বেঁচে থাকে

অলোক আচার্য, লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।

প্রকাশ : ২৭ জুন ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

এক সময় মানুষ মরে যেত, এখন মানুষ বেঁচে থাকে; কিন্তু সম্পর্ক মরে যায়! সম্পর্কের এই বিচিত্র ভাঙা গড়ায় মানুষের জীবন। ’সম্পর্কের বাজারে পৌঁছে/পা দুটো থেমে গেল.../সম্পর্ক বিক্রি হচ্ছিল/ওখানে খোলা বাজারে.../আমি কাঁপতে কাঁপতে জিজ্ঞেস করলাম/’ কি দামে, বেচছো ভাই/এই সম্পর্কগুলো...? সম্পর্ক নিয়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার কয়েকটি লাইন। আজ পৃথিবীতে কত সম্পর্ক বিরাজমান! মানুষ মূলত এক জটিল প্রাণী। মস্তিষ্কের গঠনও অতি জটিল প্রকৃতির। সেখানেই কোথাও এই সম্পর্কের জটিল রসায়ন তৈরি হয়। প্রতিদিন নতুন নতুন সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে, ভাঙছে। মা, বাবা, ভাই, বোন, মামা, কর্মী, বস, মহাজন, শ্রমিক, প্রেমিক-প্রেমিকা আরো কতশত সম্পর্কের বাঁধন যে পৃথিবীতে আছে তার হিসাব নেই। সম্পর্ক কি অথবা সম্পর্কের রসায়ন কি? বিজ্ঞান দিয়ে সম্পর্কের ব্যাখ্যা করা যায় না। যেদিন থেকে পৃথিবীতে সমাজব্যবস্থা শুরু হয়েছে, সেদিন থেকে সম্পর্কের বিষয়টিও এসেছে। মানুষ মানুষের সঙ্গে, কোনো প্রাণী প্রাণীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়ায়। সম্পর্কে জড়ানো উদ্দেশ্য হলো মানুষের একাকিত্ব কাটানো, মনের ভাব ব্যক্ত করা, সময় কাটানো। মানুষ একা থাকতে পারে না, সামাজিক এই সূত্রই মানুষকে সম্পর্কের সুতোয় বেঁধে রেখেছে। কারণ একাকিত্ব ভয়ঙ্কর। গত বছর যুক্তরাজ্যে পরিচালিত গবেষণায় দেখা গিয়েছিল, প্রতি চারজনে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী একাকিত্বে ভোগেন। অথচ সাধারণ প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে প্রতি ২০ জনে মাত্র একজন একাকিত্ব অনুভব করেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মতে, একাকিত্ব অকাল মৃত্যুর ঝুঁকি ৩০ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়। বিচ্ছিন্নতা একজন ব্যক্তির বিষণ্ণতা, উদ্বেগ এবং স্মৃতিভ্রংশ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অর্থাৎ একা থাকা প্রকৃতপক্ষে সম্ভব না। মানুষ অন্য কারও সংস্পর্শ চায়। আর এটাই সম্পর্কে রূপ নেয়। মানুষ যেখানেই থাকুক না কেন, যেকোনো সম্পর্কে জড়ানোই মানুষের নিয়তি। যদিও আজকের সম্পর্ক অত্যন্ত ঠুনকো এবং তুচ্ছ কারণেই তা ভেঙে পরে। তবুও মানুষ সম্পর্কে জড়াচ্ছে। একে অপরকে ভালোবাসছে। আবার বিচ্ছেদ হচ্ছে। এই যে আজ সংসার ভাঙার খেলা চলছে, একের পর এক দম্পতি ডিভোর্স হচ্ছে, এসব তো ভাঙা সম্পর্কের ইঙ্গিত বহন করে। কেনই বা মানুষ সম্পর্কে জড়ায় আর কেনই বা ভাঙে তা মানুষই জানে!

ভালোবাসার আলাদা একটা ব্যাখা আছে। আমাদের সমাজে প্রতিনিয়ত সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সম্পর্ক বদলায়, সম্পর্ক ভাঙে, সম্পর্ক আবার জোড়া লাগে এবং সেই জোড়া লাগা সম্পর্কও আবার ভেঙে যায়। মানুষ এবং প্রাণিকুলের মধ্যেও সম্পর্কের বিষয়টি গভীরভাবে লক্ষ্যণীয়। সম্পর্কে জড়ানোটা মানুষের স্বভাব। বৈচিত্রপূর্ণ একটি শব্দ হলো এই সম্পর্ক। মানুষ থেকে মানুষের ধমনী-শিরায় সম্পর্ক প্রভাবিত হয়। সম্পর্ক দুই ধরনের হয়। প্রথমত. রক্তের সম্পর্ক এবং দ্বিতীয়ত. মানবিক সম্পর্ক যা রক্তের না, তবে মাঝে মাঝে রক্তের সম্পর্ককেও ছাপিয়ে যায়। দুই ধরনের সম্পর্ককেই মানুষ মাঝেমধ্যে অস্বীকার করে। এর বাইরে এ যুগে যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে তা হলো স্বার্থের সম্পর্ক। কিছু দিলে কিছু পাওয়া যায় এই নীতিতেই এসব সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সম্পর্ক হাঁটে-বাজারে বিক্রি না হলেও সম্পর্ক পরিবর্তনশীল। মা-বাবা-ভাই-বোন, স্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকা অথবা অন্য যেকোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠে আবার ভেঙে যায়। সমাজ যত আধুনিকতার দিকে এগিয়ে চলেছে সম্পর্কের ক্ষেত্র তত বাড়ছে। একসময় মানুষ মরে যেতো; কিন্তু সম্পর্ক টিকে থাকত আর এখন মানুষ বেঁচে থাকে; কিন্তু সম্পর্ক মরে যায়। এখনকার সম্পর্কগুলো বড় হালকা, কাঁচের পাত্রের মতো। অর্থাৎ দ্রুতই সম্পর্কের মৃত্যু ঘটে। স্পর্শ না করা গেলেও সম্পর্কের জন্মণ্ডমৃত্যু ঘটে। সম্পর্কের রং বদলায়। কি আশ্চর্য এক অস্পৃশ্যনীয় বিষয় মানুষ আজন্মকাল বয়ে চলেছে! আজকাল অতি ঠুনকো কারণেই সম্পর্কের অবনতি ঘটে এবং ভেঙে যায়। সম্পর্কের ভেতর থাকতে হয় বিশ্বাস, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। যখন বিশ্বাস উঠে যায়, তখন শ্রদ্ধাবোধ কমে যায় এবং ভালোবাসার পরিসমাপ্তি ঘটে। তখনই সম্পর্ক বদলে যায় ঘৃণায়। অর্থাৎ সম্পর্কের রুপ পরিবর্তনশীল। সম্পর্কের শারীরিক উপস্থিতি না থাকলেও একটি অনুভূতি রয়েছে, প্রকাশ যোগ্যতা রয়েছে।

সম্পর্ক নিয়ে বিখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন যথার্থই বলেছেন, ‘সম্পর্কে জড়ানোর জন্য অভিকর্ষ বলের কোনোই দোষ নেই।’ সত্যি তাই, সম্পর্ক অভিকর্ষ বলে হয় না। সম্পর্ক হয় হৃদয়ে। রক্তের সম্পর্ক হৃদয়ের থেকেও অধিক শক্তিশালী। মানুষ কেন সম্পর্কে জড়ায় এর সুনির্দিষ্ট কোনো উত্তর নেই। মানুষের রক্তেই সম্ভবত সম্পর্কের দিকে নিয়ে যায়। মানুষ প্রকৃতিগতভাবে সামাজিক জীবন। মানুষ একে অন্যের সঙ্গে মিশে এবং তার মতের সঙ্গে মোটামুটি মিল থাকে, এমন মানুষের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ায়। তবে মানুষ যেমন সম্পর্কে জড়ায় সেভাবেই সম্পর্ক ত্যাগও করে। সন্তান তার রক্তের সম্পর্কের বাবা-মাকে ফেলে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসে। রক্তের সম্পর্কের বাইরে যে সম্পর্ক সবচেয়ে শক্তিশালী বলে সমাজে স্বীকৃত তা হলো বিবাহ বা বিয়ের সম্পর্ক। আজকাল এই সম্পর্কও একেবারে ঠুনকো। প্রতিদিন অসংখ্য স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ভেঙে যাচ্ছে। সমাজ তার খোঁজ রাখে না। সম্পর্কের মধ্যে মিশে থাকে ভালোবাসা। যখন সেই ভালোবাসায় খাদ মিশে যায়, তখনই সম্পর্কের অবনতি ঘটে। সম্পর্কের রসায়নটাই এমন। মানুষের বোধগম্যের বাইরে! কারণ সম্পর্ক পশুর সঙ্গেও গড়ে ওঠে। মানুষের বিশ্বাস স্থানান্তরিত হয় মানুষ থেকে পশুতে। বস্তুত মানুষ এমন একটি সামাজিক ব্যবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছে, যেখানে সম্পর্ক শব্দটি অমূল্য হলেও বর্তমানে এর প্রতি বিশ্বস্ততা দেখা যায় না। সেখানেও কাজ করে সম্পর্কের জটিল রসায়ন!

এানুষ বিচ্ছিন্ন কোনো প্রাণী নয়। মানুষ সম্পর্কবদ্ধ প্রাণী। হয়তো সম্পর্কে জড়ানোর জন্যই মানুষ জন্ম গ্রহণ করে। বেঁচে থাকে। সম্পর্ক একটি মোহ। এই মোহের সঙ্গে অর্থের সম্পর্ক থাকতেও পারে আবার নাও থাকতে পারে। সম্পর্কের সুতো ধরে টান দিলে লক্ষ্য কোটি সম্পর্ক চোখের সামনে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে নানান রঙে, সুরে-বেসুরে, অস্পষ্ট আলোয়, ধূসর দূরত্বে, অসীম গভীরে, আড়ালে সংগোপনে। সম্পর্কের কোনো সংজ্ঞা হয় না। জীবনে চলার পথে কত সম্পর্কে আমরা প্রতিনিয়ত জড়িয়ে যাই। সম্পর্কের সঙ্গে সম্পর্কিত শব্দগুলো ভালোবাসা, মায়া-মমতা, আন্তরিকতা, শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা হলেও সূক্ষ¥ভাবে লুকায়িত থাকে ‘স্বার্থ’ শব্দটি। অনেক সময় সম্পর্ক তৈরি হয় মনের অজান্তেই। কখনো কখনো সম্পর্ক আবার ঘাড়ে বোঝা হয়ে চেপে বসে। সম্পর্ক কেনই বা জন্ম নেয় আবার কেন বা মরে যায়, সে প্রশ্ন উত্তরহীন। এখানে স্বার্থ এবং স্বার্থের দ্বন্দ্ব শব্দটির জয়জয়কার। সারা পৃথিবীতেই এটাই চলছে। আজ সম্পর্কের সংজ্ঞা হয়েছে বহুমুখী। ভার্চুয়াল সম্পর্কের টানে সেই সুদূর বিদেশ থেকে এসে বাঙালির হাতে হাত মেলাচ্ছে কতজন। আবার এ প্রান্ত থেকেও ছুটে যাচ্ছে কেউ কেউ। এসব হচ্ছে সম্পর্কের টানে। তবে এই সম্পর্ক কতদিন থাকছে, সেটাও প্রশ্ন। সম্পর্ক শব্দটি আজ মূলত ক্ষণস্থায়ী এক শব্দে পরিণত হয়েছে। শুধু মানুষ কেন সম্পর্কে জড়ায় প্রাণিকুলও। তাদেরও সংসার হয়। তাদেরও বিচ্ছেদ হয়। তাদের মনও খারাপ হয়। তবে এ কথা সত্যি যে যদি সম্পর্কের ভেতর আস্থা ও বিশ্বাস এবং নির্ভরতা না থাকে, তবে তা একদিন ভাঙবেই। বয়ে নিয়ে যাওয়া সম্পর্কের উদাহরণও আজ প্রচুর। না চাইলেও সম্পর্ক রাখতে হচ্ছে। তা প্রয়োজনে বা অন্য কোনো কারণে। একপক্ষে হয়তো সম্পর্কের সুতা ধরে আছে, অন্য পক্ষ আবার তা ছেঁড়ার চেষ্টা করছে। যদি সম্পর্কগুলো আগের সময়কার মতো আরো সুদৃঢ় হতো, মজবুত হতো তাহলে পৃথিবীটা আরো বেশি সুন্দর হতো। এত বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটত না। সম্পর্কগুলো ঢিলে হওয়ায় এত বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। মানুষ মানুষকে কাছে টানতে পারছে না। অথচ মানুষেরই সেই ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি।