বন্যার প্রভাব বহুমুখী

দুর্গতদের সুরক্ষায় দ্রুত যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে

প্রকাশ : ২৭ জুন ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টি এবং উজানের পাহাড়ি ঢলের কারণে বৃহত্তর সিলেট, নেত্রকোনা এবং উত্তরের জেলা কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাটের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। অনেক জেলাতেই বন্যা পরিস্থিতির অবনতিতে কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ার খবর সংবাদমাধ্যমে আসছে। তবে প্রতিদিনই নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার খবর যেমন সংবাদমাধ্যমে আসছে, তেমনি কোথাও কোথাও পানি কমে যাওয়ার খবরও আসছে। বিভিন্ন সংবাদপত্রের খবর থেকে জানা যায়, বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে পানি কমতে শুরু করেছে। মূলত বৃষ্টি থেমে যাওয়া এবং উজান থেকে পাহাড়ি ঢলের তীব্রতা কমে যাওয়াতেই বৃহত্তর সিলেটে বন্যার সার্বিক পরিস্থিতি উন্নতির দিকে। গত একদিন বৃষ্টিপাত না হওয়ায় জেলার নদ-নদীর পানিও বাড়েনি। তবে সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানি চারটি পয়েন্টে এখনও বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত। জেলা প্রশাসন সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রতিবেদন থেকে আরো জানা যায়, সিলেট মহানগরীর ১৩টি ওয়ার্ড ও জেলার ৪ পৌরসভা এবং ১০৩ ইউনিয়নে ৯ লাখ ৬৪ হাজার ৪৬৫ জন এখনও বন্যা আক্রান্ত। অন্যদিকে গত এক সপ্তাহ ধরে ডুবে আছে কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের দ্বীপচর বালাডোবা গ্রাম। লালমনিরহাটের পাঁচ উপজেলার প্রায় ১ হাজার পরিবার এখনও পানিবন্দি। আর স্থিতিশীল রয়েছে নেত্রকোনার বন্যা পরিস্থিতি।

দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে বন্যার যে পূর্বাভাস তাতে দুর্গতদের সহায়তায় বহুমুখী কর্মসূচি জোরদার করা জরুরি। কারণ বন্যার প্রভাব বহুমুখী। বন্যার পানিতে প্লাবিত হলে মানুষের দুর্ভোগ যেমন বাড়ে, তেমনি দুর্বিষহ অবস্থায় পড়ে গবাদি পশু। পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে ভেসে ওঠে বাসাবাড়ি ও রাস্তাঘাটের ক্ষতচিহ্ন। সংকট দেখা দেয় পশুখাদ্যের। এছাড়া জমে থাকা নোংরা পানি থেকে ছড়ায় তীব্র দুর্গন্ধ। চর্মরোগ, ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত নানা রোগের প্রকোপও বাড়ে। তাই যেসব এলাকা থেকে বন্যার পানি নামতে শুরু করেছে, সেসব এলাকার মানুষের চাহিদার কথা বিবেচনায় রেখে সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রসারিত করতে হবে। রংপুর, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটার আগেই উপদ্রুত এলাকাগুলোতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ত্রাণ তৎপরতা জোরদার করতে হবে। এসব এলাকার মানুষের জানমালের সুরক্ষায় যত দ্রুত সম্ভব যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের এ দেশের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ প্রকৃতির বৈরী আচরণ মোকাবিলায় অভ্যস্ত হলেও ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর মতো পরিস্থিতি অনেকাংশেই কঠিন। দুর্যোগকবলিত এলাকায় সরকারের কার্যক্রম যথেষ্ট সহায়তামূলক হলেও নানা সময়ে স্থানীয় দায়িত্বশীল কিছু মানুষের অসাধু কর্মতৎপরতায় তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। আমরা প্রত্যাশা করি, এবার সে ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হবে না। সরকারের ঊর্ধ্বতন দায়িত্বশীলরা এ ব্যাপারে সজাগ ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করবেন। বন্যাকবলিত এলাকায় বিপুল পরিমাণ ফসলি জমি, মৎস্য ও পশুর খামার তলিয়ে যাওয়ায় যে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা মোকাবিলায় প্রয়োজন পর্যাপ্ত সহযোগিতা। এক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি ব্যাংক এবং এনজিগুলোরও এগিয়ে আসা উচিত। উপদ্রুত এলাকাগুলোর যেখানে বিশুদ্ধ পানি ও শুকনো খাবারের চরম সংকট রয়েছে, সেসব এলাকায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে স্থানীয়দের এগিয়ে আসা জরুরি। বন্যা উপদ্রুত এলাকায় খাবার পানি এবং শুকনো খাবারের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ ব্যবস্থাকেও জোরদার করতে হবে। সেইসঙ্গে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দিকেও নজর দিতে হবে। যাতে করে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের ওপর দুর্বৃত্তদের কোনো আঁচড় না লাগে। একসময় কখন বৃষ্টি নামবে বা কেমনভাবে নামবে- মানুষ তা জানত। প্রতি বছর বন্যা হবে, সে ছিল আমাদের নিত্যসঙ্গী। কিন্তু নদীর সঙ্গে আজ আমাদের সম্পর্কে যে ছেদ পড়েছে, তার পেছনে রয়েছে নদীকে শাসন করার প্রবণতা। বন্যা আটকাতে আমরা বাঁধ দিয়েছি। সেই বাঁধ উপচেই আজ বন্যা আসে, সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। জীবন ভেসে যায়। একসময় বন্যার সঙ্গে বাঁচার অভ্যাসটাও আমাদের ছিল। আজকে বন্যা আমাদের ভয়ের কারণ। একসময় মানুষ সরকারের সঙ্গে সঙ্গে বন্যার্তদের সহযোগিতার জন্য পথে নামতেন, আজকে সে চলও নেই। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আমরা মনে করি, আমাদের প্রত্যেকেরই সচেতন হওয়া প্রয়োজন। মানুষে মানুষে সম্প্রীতির বন্ধন দৃঢ় করা প্রয়োজন। আজকে বন্যার মতো যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের ওপর নেমে আসছে, এর দায় তো আমাদেরও। আমাদের অবিবেচক কর্মকাণ্ডের ফল ভোগ করছে অনেকে।

বাংলাদেশ দুর্যোগপ্রবণ দেশ। ঝড়, বন্যাসহ নানারকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ সইতে হয় আমাদের। আর এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করেই দেশের মানুষ তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বন্যার মতো কিছু প্রাকৃতিক দুর্যোগের পেছনে সরাসরি মানুষের কর্মকাণ্ডকে দায়ী করা হচ্ছে। আমাদের অপরিণামদর্শী উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, নদ-নদী দখল এবং তার গতিপথ পরিবর্তনসহ জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত নতুন নতুন বিপদের আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলেছে। আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ধাক্কা যত তীব্র, সেই তীব্রতা আরো অনেকগুণ বাড়িয়ে দিতে পারে আমাদেরই কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজকর্ম। গত বছর কক্সবাজার জেলায় যে ভয়াবহ বন্যা আমাদের প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে, তার পেছনের কারণ কারোই অজানা নয়। এমনকি হাওর অঞ্চলের গত বন্যার কারণও চিহ্নিত হয়েছে। এসব বন্যার পেছনে প্রকৃতির যে প্রত্যক্ষ অবস্থান তার সঙ্গে আমাদের অপরিকল্পিত এবং অদূরদর্শী কর্মকাণ্ডও কম দায়ী নয়। আমরা উন্নয়ন চাই, তবে সেই উন্নয়ন হতে হবে পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তা যেন কোনোভাবেই পরিবেশের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয়ে ওঠে। উজানে বৃষ্টিপাতের কারণে প্রতি বছর পাহাড়ি ঢল নেমে আসবে সমতলে। প্রকৃতির এ এক স্বাভাবিক ক্রীড়া। কিন্তু সেই ঢল নেমে যাওয়ার সময় তা যেন কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত না হয়, তার পথে যেন প্রতিবন্ধকতা তৈরি না হয়, সেদিকেও আমাদের নজর দেওয়া প্রয়োজন। আমরা যদি উজানের ঢলের নেমে যাওয়ার পথে বাধার সৃষ্টি করি, তবে তা স্বাভাবিকভাবেই তার পথ তৈরি করে নিতে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত করবে। এজন্য আমাদের কোনো উন্নয়ন প্রকল্পই যেন প্রকৃতির ক্ষতিসাধন করে না হয়, তা পূর্বেই খতিয়ে দেখতে হবে। নদ-নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ যেন বাধাগ্রস্ত না হয়, নদ-নদীগুলো দখলমুক্ত করতে এগুলোর যথাযথ খনন প্রক্রিয়ার দিকেও নজর দিতে হবে। তবে তার মানে এই নয়, উন্নয়নকে থামিয়ে দিয়ে পরিবেশ বাঁচিয়ে রাখতে হবে। বরং উভয়কেই সমান গুরুত্ব দিতে হবে।