কালেরসাক্ষী পুরান ঢাকার ঐতিহাসিক বাহাদুর শাহ পার্ক

সুমন দত্ত, লেখক সাংবাদিক

প্রকাশ : ২৯ জুন ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

পুরান ঢাকার অন্যতম ঐতিহাসিক এক স্থান বাহাদুর শাহ পার্ক। অনেকে ভিক্টোরিয়া পার্ক নামেও চিনে থাকে। স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে দুটো নামেই পরিচিত। দুটো নামের পেছনে ইতিহাস আছে।

১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহ হয়। সেই বিদ্রোহ দমনে ইংরেজ সেনারা ওই বছর ২২ নভেম্বর লাল বাগের কেল্লা আক্রমণ করে। এতে ১১ জন সিপাহিকে তারা বন্দি করে। প্রহসনমূলক বিচারে সিপাহিদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তাদের এই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় এই পার্কে। তখন এই পার্কে বহু গাছ ছিল। সিপাহিদের লাশ দাফন না করে গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখেছিল ইংরেজরা। উদ্দেশ্য ছিল জনগণকে ভয় দেখানো যাতে ভবিষ্যতে কেউ বিদ্রোহ না করে।

সিপাহী বিদ্রোহ অনুষ্ঠিত হয়েছিল ইংরেজ শাসনের সমাপ্তি ঘটিয়ে মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহর শাসন পুনরায় আনার জন্য। তাই তার নামানুসারে এর নতুন নামকরণ করা হয় ‘বাহাদুর শাহ পার্ক’। ১৯৫৭ সালে, সিপাহী বিদ্রোহের ১০০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে ‘ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট’(ডি আই টি)এর উদ্যোগে এই স্থানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। এই পার্কের স্মৃতিসৌধটি চারটি পিলারের উপর দাঁড়ানো চারকোনা একটি কাঠামো।

উপরে রয়েছে একটি ডোম। এলাকার জনমত অনুসারে বহু মানুষকে সন্ত্রাসী তকমা দিয়ে ইংরেজরা এখানে এনে মেরে ফেলত। মেরে ফেলার পর তাদের লাশ গাছে ঝুলিয়ে রাখত। এক ভুতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল এই পার্ক ঘিরে।

লোকজন তখন এই পার্কের পাশ দিয়ে চলাফেরা করতে ভয় পেত। তার একশ’ বছর পর ১৯৫৭ সালে এই পার্কটির নামকরণ করা হয় বাহাদুর শাহ পার্ক।

আগে এই পার্কটির নাম ছিল ভিক্টোরিয়া পার্ক। ভিক্টোরিয়া পার্ক নামকরণ করা হয়েছিল ব্রিটেনের রানী ভিক্টোরিয়ার নামে। কারণ ১৮৫৮ সালের তিনি ব্রিটেনের শাসন ক্ষমতা হাতে নেন। তার স্মরণে একটি ঘোষণাপত্র পাঠ করেন তৎকালীন ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার। একে স্মৃতি হিসাবে ধরে রাখতে এই পার্কের নাম করা হয় ভিক্টোরিয়া পার্ক।

তৎকালীন সময়ে ঢাকার নবাব পরিবারের সঙ্গে ব্রিটিশ শাসকদের সুসম্পর্ক ছিল। বিশেষ করে নবাব খাজা আবদুল গণি ও নবাব খাজা আহসানুল্লাহ খান বাহাদুর। ১৯৫৭ সালে, সিপাহী বিদ্রোহের ১০০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে ‘ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট’ (ডি আই টি)এর উদ্যোগে এই স্থানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। এই পার্কের স্মৃতিসৌধটি চারটি পিলারের উপর দাঁড়ানো চারকোনা একটি কাঠামো। উপরে রয়েছে একটি ডোম।

তাদের পরিবার পার্কটি সংস্কার করতে অর্থ দান করেছিলেন। এ সময় খাজা আহসানুল্লাহর ছেলে খাজা হাফিজুল্লাহ অকালে মারা গেলে তার স্মরণে ১৮৮৪ সালে একটি স্মৃতি ফলক পার্কে নির্মাণ করেন ব্রিটিশ রাজের কর্মচারীরা। যেটা পার্কের দক্ষিণ দিকে দেখতে পাওয়া যায়।

ভিক্টোরিয়া পার্কের আদি নাম ছিল আণ্টাঘর। তখন এই পার্ক ঘিরে বাস করত বহু আর্মেনীয় পরিবার। পার্কের পরিধিও ছিল অনেক বড়। এলাকার ৯০ বছর বয়সি এক চাচার সাক্ষাৎকারে জানা যায়, তখন এখানে অনেক গোলাপ গাছের বাগান ছিল। গোলাপের চাষ হতো এখানে। বিভিন্ন রঙের গোলাপ ফুটে থাকত সেখানে। ইংরেজরা এখানে আমোদ ফুর্তি করত। তাদের জন্য নির্মাণ করা হয়েছিল একটি ক্লাব। বর্তমানে সেটি আর নেই।

পার্কটিকে আণ্টাঘর নামে ডাকত এলাকার লোকজন। অনেকে বলেন পার্ক ঘিরে ভাসমান ডিমের দোকান ছিল। ঢাকাইয়াদের অনেকে ডিমকে আন্ডা বলত। সেই আণ্ডা ঘর থেকে নাম হয়েছে আণ্টাঘর।

আরেকটি ইতিহাস আছে, আঠারো শতকের শেষের দিকে এখানে ঢাকার আর্মেনীয়দের বিলিয়ার্ড ক্লাব ছিল। যাকে স্থানীয়রা নাম দিয়েছিল আণ্টাঘর। বিলিয়ার্ড বলকে স্থানীয়রা আণ্টা নামে অভিহিত করত। সেখান থেকেই এসেছে ‘আণ্টাঘর’ কথাটি। ক্লাব ঘরের সাথেই ছিল একটি মাঠ বা ময়দান যা আণ্টাঘর ময়দান নামে পরিচিত ছিল।

বাহাদুর শাহ পার্ক পুরাণ ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে অবস্থিত। এই পার্ক ঘিরে ৬টি রাস্তা বিভিন্ন দিকে গেছে। পশ্চিম দিকে শাঁখারি বাজার, উত্তর দিকে রায় সাহেব বাজার ও কলতা বাজার, দক্ষিণ দিকে সদরঘাট ও নর্থ ব্রুক হল রোড, পূর্ব দিকে লক্ষ্মীবাজার।

এই পার্ক ঘিরে রয়েছে বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যার বেশিরভাগ ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, কবি নজরুল কলেজ ও ঢাকা মুসলিম গভর্মেন্ট হাইস্কুল পার্ক লাগোয়া।

মানে পার্কটি ঘিরে রয়েছে এই তিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তবে পার্ক এলাকার কাছাকাছি রয়েছে আরো কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেমন পার্কের পূর্ব দিকে রয়েছে ঐতিহাসিক সেন্ট গ্রেগরি হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ ও সেন্ট ফ্রানসিস জেভিয়ার্স গার্লস হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ, মহানগরী কলেজ, সেন্ট্রাল স্কুল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, পশ্চিম দিকে শাঁখারি বাজারের মুখে রয়েছে প্রোগজ হাইস্কুল বর্তমান নাম প্রোগজ ল্যাবরেটরি হাইস্কুল। দক্ষিণে আছে ঢাকা কলেজিয়েট গভর্নমেন্ট হাইস্কুল ও বাংলাবাজার গার্লস হাইস্কুল।

আমাদের যাদের জন্ম সত্তরের দশকে তারা এই পার্কটিকে দেখেছি লোহার রেলিংয়ে ঘেরা। ছোট বেলা যখন পার্কে যেতাম তখন পার্কে ছিল একটি সাদাকালো টিভি। বিটিভি ছাড়া অন্য কোনো চ্যানেল দেখাতো না। বহু ভবুঘরে লোক পার্কে বসে টিভির অনুষ্ঠান দেখত। তখন জবা ফুলের অনেক গাছ ছিল।

এখন সেই সব গাছ আর নেই। টিভিটাও নেই। পার্কে ঢোকার রাস্তা ছিল দুটো। পূর্ব ও পশ্চিম দিকে দুটো গেট ছিল। বর্তমানে পার্ক ঘিরে কোনো রেলিং নেই। টিভিও নেই। এখন পার্কে এসেছে রেস্টুরেন্ট।

পুরাণ ঢাকার লোকজনের চাপে এখন পার্কে বিশ্রাম নেওয়া কঠিন। সকালে ও সন্ধ্যায় বহু লোক পার্কে অবস্থান করে। হাঁটাহাঁটি করে। এছাড়া ছুটির দিনগুলোতে পার্ক ভরে যায়। তিল পরিমাণ জায়গা থাকে না। এছাড়া সিটি কর্পোরেশনের অনুমতি নিয়ে বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান আয়োজন করে থাকে এই বাহাদুর শাহ পার্কে। রাজনৈতিক কর্মসূচিও পালন করা হয় পার্ককে কেন্দ্র করে।

বাহাদুর শাহ পার্কে যেতে হলে ঢাকার যে কোনো জায়গা হতে সদরঘাট মুখি বাসে উঠে পড়বেন নেমে যাবেন পার্কেই। এই পার্ককেই বাস ওয়ালারা বলে থাকে সদরঘাট। তবে সদরঘাট বাসস্টান্ড থেকে অনেকটা দূরে। হেঁটে ১০ মিনিট লাগবে।