ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

লোডশেডিং সহনীয় মাত্রায় আনা সম্ভব হয়নি

নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাচ্ছে না দেশের মানুষ
লোডশেডিং সহনীয় মাত্রায় আনা সম্ভব হয়নি

গত দেড় দশকে বিদ্যুৎ খাতে বিপুল বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে উৎপাদন সক্ষমতা তিন-চারগুণ বাড়লেও বিদ্যুতের লোডশেডিং সহনীয় মাত্রায় নামিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। বিদ্যুৎ খাতের বিনিয়োগ, চাহিদা অনুপাতে ঘাটতি, ভর্তুকি এবং লোকসান পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। রেন্টাল, কুইক-রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জের নামে ক্রমবর্ধমান ভর্তুকির বোঝা শেষ পর্যন্ত জনগণের উপর চাপাচ্ছে সরকার। ভোক্তা পর্যায়ে প্রতি বছর মূল্য বাড়িয়ে গ্রাহকদের উপর বাড়তি খরচের বোঝা চাপিয়ে দিলেও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাচ্ছে না দেশের মানুষ। গত গ্রীষ্মে দেশে অসহনীয় তাপপ্রবাহ শুরু হয়ে এখনো চলছে। এ কারণে স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখাসহ পরিবর্তিত সময়সূচিও নির্ধারণ করে সরকার। বিদ্যুতের বাড়তি লোডশেডিং তাপপ্রবাহের দুর্ভোগকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে বিদ্যুতের লোডশেডিং সহনীয় মাত্রায় রাখার প্রয়াস দেখা গেলেও এর বিপরীত ফলাফল পড়ছে গ্রামাঞ্চলে। বিভাগীয় শহরের বাইরের জনপদে ক্রমবর্ধমান লোডশেডিংয়ের কারণে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় ব্যাঘাত সৃষ্টির পাশাপাশি কৃষি উৎপাদন এবং গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান লোডশেডিংয়ের কারণে শিল্পোৎপাদনে স্থবিরতা এবং জনদুর্ভোগের চিত্র বেরিয়ে এসেছে। একই অবস্থা বৃহত্তর সিলেট, যশোর এবং রংপুর অঞ্চলেও। চট্টগ্রাম অঞ্চলের ২৬টি বিদ্যুতকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা সাড়ে ৪ হাজার মেগাওয়াটের বেশি হলেও চাহিদা অনুসারে জ্বালানি সরবরাহের সক্ষমতার অভাবে ১৯শ’ থেকে ২ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না।

তাপপ্রবাহ তথা হিটওয়েভের কারণে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা এবং কর্মপ্রবাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। বিদ্যুতে লোডশেডিং সেই দুর্ভোগ এবং স্থবিরতাকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। দেশের বিদ্যুৎ খাতে এক জটিল বিদঘুটে অবস্থা বিরাজ করছে। এই মুহূর্তে দেশে ২৭ হাজার ৫১৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা থাকলেও বিদ্যুতকেন্দ্রগুলো থেকে চাহিদা ১৫ হাজার মেগাওয়াট। গতকাল একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে গত বুধবার চাহিদার চেয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন ২,২৪৫ মেগাওয়াট কম হওয়ায় এ পরিমাণ বিদ্যুতের লোডশেডিং দিতে হয়েছে। তবে মাঠের বাস্তব চিত্র আরো বেশি প্রকট বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। ঈদের ছুটি শেষে মানুষের কর্মব্যস্ততা এবং যখন ক্ষুদ্র ও বৃহৎ শিল্পকারখানাগুলো উৎপাদনে ফিরে আসতে শুরু করেছে তখন তাপপ্রবাহ বৃদ্ধির সাথে সাথে বিদ্যুতের লোডশেডিং জনজীবন ও উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় বাড়তি বিপত্তি হয়ে দেখা দিয়েছে। দেশে ডলার সংকট তথা অর্থনৈতিক সংকট বিদ্যুতের জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থাকে সরাসরি আক্রান্ত করছে। অথচ বিনিয়োগ ও শিল্পোৎপাদনের চাকা নিরবচ্ছিন্ন রাখা ছাড়া অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করা অসম্ভব। এর একটির সাথে আরেকটি নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত। গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান লোডশেডিং জনজীবনে দুর্ভোগ বৃদ্ধির সাথে সাথে দেশের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের বড় অংশের শিক্ষা জীবনে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করছে। বিদ্যুতের অনির্ধারিত লোডশেডিং ও ভোল্টেজের ওঠানামার কারণে টিভি, ফ্রিজারসহ ঘরের ইলেকট্রনিক সামগ্রী নষ্ট হয়ে যাওয়ায় অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়ছে গ্রামের সাধারণ মানুষ।

বিদ্যুৎ খাতের এমন জটিল অবস্থা হঠাৎ করেই শুরু হয়নি। অগ্রাধিকার ভিত্তিক খাতের তকমা নিয়ে গত দেড় দশকে ধীরে ধীরে বিদ্যুৎ খাত একটি শ্বেতহস্তিতে পরিণত হয়েছে। যত দিন যাচ্ছে বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকি ও লোকসান বেড়েই চলেছে। আর এই লোকসানের বোঝা শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষের উপর বর্তাচ্ছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডি’র সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে পিডিবি’র লোকসান ১৯৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে কমপক্ষে ১৮ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছবে। আগামী বছর তা ২৫ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছাতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ক্যাপাসিটি চার্জের নামে দেশি-বিদেশি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে বসিয়ে রেখে গত অর্থবছরে ২৬ হাজার কোটি টাকার বেশি ভর্তুকি দিয়েছে সরকার। ভর্তুকি কমানোর জন্য গ্রাহক পর্যায়ে বার বার বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানো হলেও ভর্তুকি, লোকসান এবং লোডশেডিং কমাতে পারেনি। জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুতকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জের নামে দুর্নীতি, লুটপাট বন্ধের কথা বললেও সরকার এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের সাথে চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি করা অব্যাহত রেখেছে। কেউ কেউ একে লুটেরা মডেল বলে অভিহিত করেছেন। দেশের বিদ্যুৎ খাতকে সরকারের সাথে সম্পৃক্ত একটি প্রভাবশালী মহলের লুটপাট এবং ভারত ও চীনা কোম্পানির পুনর্বাসন কেন্দ্র হিসেবে জনগণের উপর দুর্বহ বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ীরা বাড়তি মূল্য দিয়ে হলেও শিল্পকারখানায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের নিশ্চয়তা চেয়েছেন। গ্যাস-বিদ্যুৎ শুধুমাত্র উৎপাদন ব্যবস্থার নিয়ামক শক্তিই নয়, এটি জনজীবনের এক অত্যাবশ্যকীয় বিষয়ে পরিণত হয়েছে। অনিয়ন্ত্রিত ও অনিশ্চিত লোডশেডিং কৃষি উৎপাদন, খাদ্য নিরাপত্তা, শিল্পোৎপাদন, শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ও জনজীবনকে চরমভাবে প্রভাবিত করছে। বিদ্যুৎ খাতের সক্ষমতাকে কাজে লাগাতে হলে প্রথমেই এর অস্বচ্ছতা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। জ্বালানি খাতে আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় উৎসগুলোর দিকে নজর দেয়া এখন সময়ের দাবি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত