লেখালেখি একালে কতটা উত্থান হয়েছে

রহিম ইবনে বাহাজ, কবি ও প্রাবন্ধিক

প্রকাশ : ৩০ জুন ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

লেখালেখি করে আত্মার প্রশান্তি পেয়েছি কিছু সৃজনশীল মানুষের ভালোবাসায় পূর্ণ হয়েছে কয়েক দিন বেঁচে থাকার জন্য ভিসা। স্কুল, কলেজে আমার কোনো সহপাঠীরা সাহিত্য সংস্কৃতি পছন্দ করতো না, আবার আমি যে লিখতাম তাদের ঠাট্টা, মশকরা এবং এমনকি তিরস্কারও পেয়েছি, বন্ধুদের সবাই একটা কথা বলতো এসব লিখে কি হবে। তাদের এসব কথা আমি পাত্তা দেয়নি, লেখালেখির দীর্ঘ জীবনে পুরান কথাটা আজও শুনতে হয় কি হবে এসব লিখে? ছড়া, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, কলাম, মেধা খাটিয়ে কাঙ্ক্ষিত স্বর্গ আমি পেয়েছি। কবি বা লেখকের কলম যদি হাতে তুলে না নিতো আজকের ঘুণে ধরা সমাজ টার কথা কে লিখতো, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দুর্বার যুদ্ধ কে করতো শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি চলচ্চিত্র আমাদের জীবনেরই অংশ বিশেষ। বাংলাদেশের রূপ, রস, পাহাড় পর্বত, সু-বিশাল সিন্ধু, পাহাড়ের ঝর্ণা ধারা, তেরশ নদী মাঝির বৈঠা বাইতে বাইতে গান, ফসলের মাঠে কৃষকের উচ্ছ্বাস আনন্দ বার মাসের তের পার্বণ, যাদের সাথে আমার লেখালেখির কারণে সখ্যতা গড়ে উঠছে, তাদের মধ্যে কবি ও প্রাবন্ধিক এর নাম বলছি, বঙ্গ রাখাল, মিলু সামস, শফিক হাসান, গোলাম কিবরিয়া পিনু, ওবায়েদ আকাশ, অলোক আচার্য, গোবিন্দ লাল হালদার, আদ্যনাথ ঘোষ, রায়হান উল্লাহ, জুবায়ের মিলন, শেখ ফজল, ধ্রুব জ্যেতি ঘোষ মুকুল, আশরাফুল মান্নান, মেহেদী ইকবাল, ফখরুল হাসান, এনাম রাজু, মীম মিজান, আহমদ কাউসার এনাম আনন্দ, ইমামুল ইসলাম, হাসান ইমতিয়াজ, শাহিনুল ইসলাম, মাহমুদ নোমান, নুসরাত সুলতানা, নূরে জান্নাত, আহমেদ সাগর, মিনহাজ উদ্দিন শপথ, সোহেল বীর, শামীম খান যুবরাজ, এমএ রহমান, হুমায়ুন কবির, শামসুল কিবরিয়া, অসীম বাহাদুর, দ্বীপ সরকার, লতিফ জোয়ার্দার, আবদুল লতিফ, প্রদীপ সাহা, মজনু মিয়া, হাসু কবির, কুমকুম দত্ত, মাসুদ চয়ন, রোকন রেজাসহ অনেকের সাথে আত্মার সখ্যতা দিন দিন আরো বেশি গভীরতা তৈরি হচ্ছে। এটা ই বা কম কিসে সাহিত্য সংস্কৃতির মানুষগুলোর সমাজে কি কখনো অন্যায় হয়েছে? ধর্ষণের জগন্য কাজ হয়েছে, কোনো সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়েছে অমুক কবি মানুষ খুন করেছে। কিন্তু কিছু স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার শিক্ষকসহ সমাজে ব্যাধি এক হাজার লোকের মধ্যে হয়তো মানুষ পাবেন একজন। লোক আর মানুষের মধ্যে বিশাল পার্থক্য রয়েছে। কবি, সাহিত্যিক দর্শন বুঝেন, দেশি-বিদেশি বই পড়েন।

যে বই কুণ্ডকাজ, মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে তাহার চিন্তা চেতনা অন্যজনের থেকে একটু ব্যতিক্রম, ক্রমশ চৈতন্য সৃষ্টি হয়েছে সতত। আজও দুই বাংলায় বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, পল্লী কবি জসিম উদ্দিন, রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ, কবি শামসুর রাহমান, কবি আল মাহমুদ, লেখক হুমায়ুন আজাদ, সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হক, নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ, কবি রফিক আজাদ, কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, কবি কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র, কবি আবুল হাসান, প্রাবন্ধিক প্রমথ চৌধুরী, কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়, কবি ওমর আলি, দ্রোহের কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, কবি হেলাল হাফিজ, কবি শহীদ কাদরী, কবি নির্মলেন্দু গুণ কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যসহ এখনো তারা প্রাসঙ্গিক সাধারণ মানুষ বা পাঠক তাদের কেউ পাঠ করছে একথা মানতে হবে। কারণ হিসেবে জাতীয় পাঠ্য পুস্তকে এখানে যাদের নাম উল্লেখ করেছি তাদের অনেকের লেখা স্থান পেয়েছে, পাঠক তাদের লেখা পড়েই ক্রমশ বড় হয়েছি আমরা, একালে যারা লেখালেখি করেন, ছড়া, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, থিলার, প্রবন্ধসহ ভূত প্রেতের গল্পও পাঠক টানেনি, শিশুতোষ গল্পও নব উদ্যমে এগিয়ে যায়নি, কিন্তু তাই বলে কবি বা লেখকরা লেখা কিন্তু বন্ধ করেনি, যেমন আমার কথাই বলি, আমার লেখা কোথায় প্রকাশিত হবে, কে পাঠ করবে, কে পাঠ করবে না অঙ্কের সে হিসাব করে লেখালেখি করি না। বহুবার বলেছি লেখালেখিটা আত্মার শান্তি লাগে, মনের প্রশান্তি হয়, সৃজনশীল শিল্পমাধ্যমে সমগ্র বিষয়গুলো কলমের আছড়ে তুলে আনা যায়। শব্দগুলো খুঁটে খুঁটে মালা বোনা যায়। গত কয়েকদিন আগে একজন পাঠক আমায় বলল; আচ্ছা একালে কবি লেখকরা জনপ্রিয় হচ্ছে না, পাঠক নন্দিত হচ্ছে না, আমি উত্তরে বলেছি, রবি ঠাকুর আর নজরুলের যুগে তো হাতে হাতে এন্ড্রয়েড ফোন ছিল না, ইন্টারনেট ব্যবহার ছিল না, পাঠক তখন কাগজের মলাটবদ্ধ বই পড়ছে, পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি সাহিত্য বইগুলো লুকিয়ে লুকিয়েও পড়ছে, এখন আমরা একটা ঘোর অমাবস্যার মতো দিন পার করছি। আগের মতো সেই জৌলুস নেই, কারো বাড়িতে ৫টা বই নেই। অথচ এক বিদেশি ট্রাক ড্রাইভার আবর্জনায় কুড়িয়ে পাওয়া বই দিয়ে ময়লার ট্রাক ড্রাইভারের বিশাল লাইব্রেরি। শিক্ষিত হলেই যে কেউ শিক্ষার মর্ম বুঝবে তার কোনো মানে নেই। না হলে কেন রাস্তায় পড়ে থাকবে বই। আবার বিশাল ডিগ্রি না থেকেও কেউ হতে পারেন প্রকৃত শিক্ষিত। তেমনই একজন হোসে আলবার্তো গুটিরেজ। ফেলে দেওয়া বই দিয়েই বানিয়ে ফেলেছেন আস্ত একটা লাইব্রেরি। আলবার্তো গুটিরেজ পেশায় ময়লা বহনকারী ট্রাকের ড্রাইভার। রাতের বেলা কাজে বেরোতেন। কাজ করার সময় তিনি খেয়াল করলেন, আবর্জনার সঙ্গে বইও পড়ে রয়েছে। তা সংগ্রহ করেই বানিয়ে ফেলেছেন লাইব্রেরি। কলম্বিয়ার এই মানুষটির জীবনে ফোটেনি শিক্ষার আলো, আর সেই তিনিই সমাজে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে বানিয়ে ফেলেছেন ফেলে দেওয়া বইয়ের লাইব্রেরি। লিও টলস্টয়ের আন্না কারেনিনা বইটি যখন গুটিরেজ আবর্জনার মধ্যে খুঁজে পেলেন তিনি অবাক হয়েছিলেন। এত গুরুত্বপূর্ণ বই কিনা স্থান পেয়েছে ডাস্টবিনে! ভেবেছিলেন এই বইয়ের স্থান তো এখানে নয়। গুটিরেজ নিজে ময়লাকর্মী হতে পারেন। কিন্তু, তিনি ঠিকই টলস্টয়কে জানেন। তাই তিনি বইটি সংগ্রহ করেন। এরপর তিনি বিভিন্ন আবর্জনার স্তূপ থেকে খুঁজে পেয়েছেন বিশ্বের নানা ক্লাসিক বই। গুটিরেজ বইগুলো সংগ্রহ করতে থাকলেন। সেই ১৯৯৭ সাল থেকে শুরু। এখনো তিনি এই কাজ করে যাচ্ছেন। অদ্ভুত হলেও সত্যি এবং আশ্চর্যের এই যে তার সংগ্রহশালায় বইয়ের সংখ্যা ছাড়িয়ে এখন দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজারে! তিনি মনে করেন উত্তরাধিকার সূত্রে আমরা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সবচেয়ে মূল্যবান যা রেখে যেতে পারি তা-ই হলো আসল শিক্ষা।

কলম্বিয়ার বোগাটায় একটি দরিদ্র অঞ্চলে থাকেন গুটিরেজ। এই এলাকার কিশোররা পড়ার সুযোগ পায় কম। অল্প বয়সে তাদের কাজের সন্ধানে নেমে পড়তে হয়। এমনই এক এলাকায় গুটিরেজ এখন শিক্ষার আলো ছড়িয়ে যাচ্ছেন। তার থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে অন্যান্য ময়লাবাহী ট্রাক ড্রাইভাররা এখন বই পেলে তাকে এসে দিয়ে যান। তিনি শিক্ষা উপকরণ দিয়েছেন ২৩৫টি স্কুল, কমিউনিটিকে। তার সংগৃহীত বইগুলো দিয়ে তিনি একটি কমিউনিটি লাইব্রেরি গড়ে তুলেছেন।

৫৫ বছর বয়সি গুটিরেজ গত কুড়ি বছর এই কাজ করে চলেছেন। সংগৃহীত বই তিনি দান করেন বিভিন্ন লাইব্রেরিতে। তার সংগ্রহের বইয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে ৪৫০টির বেশি লাইব্রেরি, রিডিং সেন্টার, স্কুলের পাঠকক্ষ। তিনি স্বপ্ন দেখেন একদিন তিনি গোটা কলম্বিয়াকে বই দিয়ে পরিপূর্ণ করবেন।

তবে একটা বিষয় স্বীকার করছি কাগজের মলাটবদ্ধ বই না পড়লেই, ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারে আগের থেকে পাঠক বেশি পাঠ করে, কিন্তু সেখানে সঠিক জায়গায় প্রবেশ করছে না, আজে বাজে কিছু চিন্তা করে মন্দ জগতে অশ্লীল ভিডিও দেখে বিপন্ন হচ্ছে পাঠক সমাজ। বিশেষজ্ঞের মতে মোবাইলে ছোট স্কিনে এক নাগাড়ে পড়তে পড়তে চোখেরও সমস্যা হতে পারে। সবচেয়ে উত্তম মলাটবদ্ধ বই পড়া। রাজধানী ঢাকা থেকে জাতীয় দৈনিক পেপার, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, বিভিন্ন ম্যাগাজিনসহ সাহিত্য সাময়িকী বিভাগ রয়েছে, বাংলা সাহিত্যের সব লেখাই পাঠকের জন্য প্রকাশিত হচ্ছে, ফেসবুকের ঢাকনা খুললেই দেখতে পাচ্ছি, অনেকের লেখা। পড়ছি ও পেপারে বা প্রিন্ট কপি সংগ্রহ করে, যেহেতু আমি কবিতার প্রেমিক সবসময় গুরুত্ব সহকারে পাঠ করি কবিতা। দীর্ঘ সাহিত্য সাধনার জীবনে কত কবিকে শুকনো পাতার মতো ঝরে যেতে দেখলাম। স্রোতের মতো ভেসে আসা কিছু কবি রাতারাতি কবি বনে যাওয়ার বাসনা নিয়ে লাফালাফি দাপাদাপি করে, সংগঠন গড়ে কয়েক দিন পর পর সাহিত্যের আসর জমানো। শ্বাশত চিরায়ত বাণী হচ্ছে সংগঠন করে কবি উপাধি পাওয়ার যায় না, সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক মার্জিনে মন্তব্যের বলেছেন; পড়, পড়, পড় এই তিনটি শব্দ লেখা ভালো হোক বা মন্দ হোক দু-ধরনের লেখা পড়তে হবে তাহলে বুঝতে সহজ হবে। যারা লেখালেখিতে একদম তরুণ তাদের জন্য’ মার্জিনে মন্তব্য’ বইটি সংগ্রহ করে পড়তে পারেন। কোনো এক অমর একুশে গ্রন্থ মেলায় কবি বঙ্গ রাখালের সাথে আড্ডা দিচ্ছি, পাশ থেকে কেউ একজন বলল; পাঠক বই কিনছে না কেন? কবি বঙ্গ রাখাল বলল: বই তো ইন্ডিয়ার হারবাল নয় মানুষের কাজে আসবে। তবে যার প্রয়োজন সে ঠিকই খুঁজে খুঁজে সংগ্রহ করবে। এতে নিরাশ বা হতাশার গান গাওয়াই উত্তম। বাংলা সাহিত্যের জন্মলগ্ন থেকে কবি, লেখকদের পাগল বলে তিরস্কার করা হয়। সত্যি পাগল বিহীন এ খণ্ডে কিছুই সৃষ্টি হয়নি, বাংলা সাহিত্যের সৃজনশীল কবি লেখক রা আঁধার পাড়ি দিয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে জ্বলে উঠুক কলমের কালো কালি। বাংলা সাহিত্যের জয় হোক।