অভিমত

ভার্চুয়াল দুনিয়া আত্মকেন্দ্রিকতা ও শো-আপের হাটবাজার বসিয়েছে!

রাজু আহমেদ

প্রকাশ : ৩০ জুন ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

অভিযোগ- মোবাইলে বেশি সময় দিচ্ছি/দিচ্ছ! দু’ভাবে হতে পারে- হয় কেউ আমায় সময় দিচ্ছে না কিংবা আমি কাউকে তার প্রাপ্য সময় দিচ্ছি না। মোবাইল আসক্তি ভালো এটা বলার সাধ্য কোনো সাধুরও নেই। প্রিয়জনের সাথে যে সময় ভাগাভাগি করার কথা সেই সময়টুকু সেখান থেকে চুরি/ডাকাতি করে মোবাইল তথা প্রযুক্তির আসক্তিতে ফুরিয়ে ফেলছি। অবসরে মোবাইল চালানো, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সময় দেওয়ার নামে কী ভয়ানকভাবে অসামাজিক হচ্ছি তা আন্দাজের চাইতেও সাংঘাতিক। পড়ার সময়ে, কাজের সময়ে, আড্ডার সময়ে, পাশাপাশি বসে মোটকথা সবসময় মোবাইল আমাদেরকে গিলে নিচ্ছে! কয়েক মুহূর্তের জন্য অনলাইনের নাগাল না পেলে পাগল পাগল লাগে। এটাকে রোগ হিসেবে স্বীকৃতি না দিলে শোক করার মতো সুস্থ মানুষও আর অবশিষ্ট থাকবে না। সমাজের মাথা এবং পা- দু’কুল থেকেই পচন শুরু হয়েছে।

মোবাইলে তথা অনলাইনের জগতে বেশি সময় দিয়ে সন্তানকে বঞ্চিত করা হচ্ছে, প্রিয়জন উপেক্ষিত থাকছে এবং আত্মীয়স্বজন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। শিশু থেকে বৃদ্ধ- কে এই নেশার বাইরে? তথ্যপ্রযুক্তি আমাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে না-কি অভিশাপ হয়েছে তা মূল্যায়ন করার সময় এসেছে। তরুণ-তরুণী, দম্পতি কিংবা যে কোনো সম্পর্কে বিচ্ছেদণ্ডব্যবচ্ছেদ, হতাশা-নিদ্রাহীনতা এবং মস্তিষ্কের ক্ষমতা কমে যাওয়ার পেছনে কলকাঠি নাড়ছে এই প্রযুক্তি! কুচিন্তার প্রভাবও এই এখান থেকেই শাখা-প্রশাখায় বাড়ছে। স্ক্রিনে চোখ রাখতে রাখতে অবস্থা এমন হয়েছে যে আমাদের ধৈর্য কমে গেছে, বিশ্বাস হারিয়ে গেছে এবং মস্তিষ্কে কোনো বিষয়ে একটু চাপ সৃষ্টি করলেই সেটা আমরা ছুড়ে ফেলি। কঠিন পৃষ্ঠা পড়ি না, শ্রমসাপেক্ষ কাজ করি না। যে মোবাইল-ইন্টারনেটকে মানুষের নিয়ন্ত্রণ করার কথা ছিল সেই কানেকশান-ডিভাইস এখন মানুষের অভ্যাসকে নিয়ন্ত্রণ করছে।

স্বামী-স্ত্রী একই দেয়ালে, পাশাপাশি বালিশে শুয়ে আছে অথচ দু’জনের মধ্যে কোনো যোগাযোগ নেই! মনোযোগ ধরে রেখেছে স্ক্রিনে-অনলাইনে। সন্তান সন্তানদের জেনারেশনের সাথে অনলাইনে হায়-হ্যালো করছে, নৈতিকতার অধঃপতনে ডুবছে আর অভিভাবকরাও বাধ্য হয়ে সেসব দেখছে এবং পরাজয় মানছে। পাড়াপড়শির সাথে সামনাসামনি কোনো যোগাযোগ নেই, যাওয়া আসা, ওঠাণ্ডবসা নেই! সবুজবাতি নির্ভরতায় হাই-হ্যালোতেই সম্পর্ক গণ্ডিবদ্ধ হয়ে গেছে। মানুষ যে কি পরিমান আত্মকেন্দ্রিক এবং শো-আপের মতলববাজিতে জড়িয়েছে তা সামাজিক মাধ্যম নামের অসামাজিক কাণ্ডকারখানায় বোঝা যাচ্ছে। সম্পদ থেকে বঞ্চিত করে আর কতটুকু ঠকানো যায়? ভালোবাসা থেকে, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ থেকে এবং স্নেহ-আদর থেকে মানুষ মানুষকে সবচেয়ে বেশি ঠকাচ্ছে এই সামাজিক মাধ্যমের অকল্যাণে!

সমাজ সংসারের বিপত্তি, গুজব মিথ্যাচারের আপত্তিকে বেগবান ও বাজারীকরণ করছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। ব্যক্তিজীবনের সৌন্দর্য ম্লান করছে, ব্যক্তিত্ববোধ নিলামে তুলছে এবং জাতীয় জীবনে অরুচি চাপিয়ে দিচ্ছে! তবে কী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কোনো কল্যাণ এবং ইতিবাচক দিক ব্যক্তিজীবনে নেই? আছে, আলবাৎ আছে। যে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে, যারা তাদের দায়িত্বের স্ব স্ব স্তরবিন্যস্ত করতে পেরেছে তাদের জীবনে এসবের আলাদা প্রভাব নেই। সন্তানের সাথে সময় কাটানো, দাম্পত্যের খোশগল্প এবং পারিবারিক ও সমাজজীবনের দায়িত্ব পালনে যারা আপস করেনি তাদের জীবনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অসামাজিক প্রভাব নেই। ভোগ তাদের নৈতিকতার অধঃপতন ও পদস্খলন ঘটাতে পারেনি। অন্তত নিয়ন্ত্রণ নিরাপদ জীবনযাপনে তারা নিজেদের সুখী ভাবতে ও রাখতে পেরেছে। মোবাইল এবং অনলাইন নেটওয়ার্কিং ব্যবহার- অপব্যবহারে লাভ উপকার এবং ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা সমাজের বাস্তবতায় বিচার করলে হতাশ হতে হবে। ক্ষতির খতিয়ান লম্বা হবে!

তবে উপায়? সংসদ সদস্য ডা. প্রাণ গোপাল মহোদয় এরইমধ্যে সংসদে বলেছেন! রাত্রে ইন্টারনেটের কানেকশান নিস্ক্রিয় করতে হবে। এতে আমাদের আর্থিক লস হবে বটে তবে নৈতিক, চারিত্রিক এবং প্রজন্মের আগামীর সম্ভাবনা বিবেচনায় নিলে আমরা মস্তরূপে লাভবান হবো। সংসার সমাজ রক্ষা করতে হবে। তরুণ প্রজন্ম সুরক্ষিত না থাকলে, দাম্পত্যে ভিত মজবুত না থাকলে এতোসব আয়োজন, মহড়া, অর্থের সমাগম এসবে কীসের জন্য, কার কল্যাণে? সন্তানের হাতে মোবাইল তুলে দেওয়ার নির্দিষ্ট বয়সসীমা থাকতেও তা কঠোরভাবে মানতে হবে। কর্মকালে মোবাইল ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের নির্দেশিকা দিতে হবে। দু’জনের গল্পে, স্কুল-কলেজের অভ্যন্তরে এবং পাঠের সময়ে মোবাইল ব্যবহার ছাপিয়ে যেনো অপব্যবহার না হয় তা লক্ষ্য রাখতে হবে। মঙ্গলজনক যা কিছু তা ধ্বংস হওয়া সহজ তবে গড়ে তোলা কঠিন। আমাদের সম্ভাবনাময়ী আগামী থাকুক, উদ্যম প্রজন্ম থাকুক এবং প্রত্যেক সম্পর্ক মধুর থাকুক- প্রয়োজনে সে আয়োজন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে অসামাজিক হয়ে করতে হবে। কেবল প্রাণে বাঁচার কোনো মানে নেই, মননেও বাঁচতে হবে। ভাণ্ডে গর্ব করার মতো কতক গুণ থাকতে হবে।