ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

তরুণদের আধুনিক প্রযুক্তি আশীর্বাদ না অভিশাপ!

অ্যাডভোকেট মো. রায়হান আলী
তরুণদের আধুনিক প্রযুক্তি আশীর্বাদ না অভিশাপ!

ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রতারণা-জালিয়াতিসহ নানান প্রকার অপরাধ বর্তমানে ঊর্ধ্বমুখী। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অন্যতম ও জনপ্রিয় মাধ্যম হলো ফেসবুক। বর্তমানে শিশু কিশোর থেকে শুরু করে বৃদ্ধরাও এই ফেসবুক ব্যবহার করছে। সহজেই মন্তব্য পোস্ট করাসহ অনায়াসেই এই মাধ্যম ব্যবহারের ফলে কোনো সংবাদ নিমিশেই পৃথিবীর এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্ত চলে যায়। দিন দিন বেড়েই চলছে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা। শহর গ্রাম সর্বোত্তই বাড়ছে ব্যবহারকারী। দিন দিন আপডেট হচ্ছে ফেসবুক ব্যবহার।

উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে ‘সারা বিশ্বে বর্তমানে এই ওয়েবসাইটটি ব্যবহার করছেন ২.৯৩ বিলিয়ন সক্রিয় ব্যবহারকারী’। ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ তারিখের জনকণ্ঠের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে- ‘২০২৩ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ৪ কোটি ৬৫ লাখ ৪৮ হাজার ৩০০ জন। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ কোটি ৩৯ লাখ ৫৫ হাজার ১০০ জনে।

অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েছে ১ কোটি ৭৪ লাখ ৬ হাজার ৮০০ জন’। এছাড়া ২০১৭ সালের ১৬ এপ্রিল প্রথম আলোর প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, দেশ হিসেবে যদিও শীর্ষ ১০ ফেসবুক ব্যবহারকারীর তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই। এ তালিকায় দেশ হিসেবে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ফেসবুক ব্যবহারকারী রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। দেশটিতে প্রায় ২১ কোটি ৯০ লাখ মানুষ এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয়। তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ভারত, সেখানকার ২১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করছেন। এরপর রয়েছে ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া ও মেক্সিকো।

বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর তথ্য সম্পর্কে সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগ সূত্র বলছে, বর্তমানে দেশে প্রায় ২ কোটি ৩৩ লাখ মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করছেন। দেশে যত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহৃত হচ্ছে এর মধ্যে ৯৯ শতাংশই ফেসবুক। বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মধ্যে ১ কোটি ৭০ লাখ পুরুষ আর ৬৩ লাখ নারী। ফেসবুক ব্যবহারকারীদের ৯৩ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ৩৪ বছরের মধ্যে। এর মধ্যে মোবাইল ডিভাইস থেকে ২ কোটি ২৬ লাখ মানুষ ফেসবুকে ঢুকছেন। উই আর সোশ্যালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের প্রায় অর্ধেক মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে।

বিশ্বের প্রায় সাড়ে ৭০০ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী রয়েছে ৩৭৭ কোটি; আর এদের মধ্যে ২৭৮ কোটি ব্যবহারকারী কোনো না কোনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে সক্রিয়। জানতে চাইলে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়শেন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) পরিচালক রিয়াদ হোসেন প্রথম আলোকে জানান, ‘এ হিসাবে কিছু গোলমাল থাকতে পারে। কারণ, ফেসবুকে পুরো বাংলাদেশের ব্যবহারকারী ২ কোটি ৩০ লাখের মতো বলে ফেসবুক সূত্রেই জানা যায়। ঢাকার সব বাসিন্দা ফেসবুক ব্যবহার করলেও সংখ্যাটা এত বেশি হবে বলে মনে হয় না। তবে শহর হিসেবে ঢাকা সারা পৃথিবীর মধ্যে ফেসবুক ব্যবহারে এগিয়ে আছে বলেই মনে হয়’।

ফেসবুকের এমন সহজ ব্যবহার সুবিধার পাশাপাশি অসুবিধা দেখা দিচ্ছে। আমরা বেশিরভাগ ফেসবুক ব্যবহারকারীই এটা ব্যবহারে সঠিক নিয়ম জানি না। ফলে প্রতিনিয়তই বাড়ছে সাইবার অপরাধ। অনেকে প্রতারণা ও সহজে মতপ্রকাশ করতে গিয়ে ফেসে যাচ্ছেন সাইবার অপরাধে। কিশোর-কিশোরী ও শিক্ষার্থী, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন বয়সিরা জড়িয়ে যাচ্ছেন সাইবার অপরাধে। সবচেয়ে সহজভাবে যে অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছেন, সেটা হলো ফেসবুক ব্যবহাকারীরা সাইবার অপরাধ সম্পর্কে ভালো জ্ঞান না থাকায় অনায়াসেই কিংবা অজান্তেই জড়িয়ে যাচ্ছেন এ ধরনের অপরাধে।

ফেসবুক সহজ মাধ্যমেও চলতে নানান প্রতারণা- ভুয়া ফেসবুক আইডি, আইডি হ্যাকড, ব্ল্যাকমেইলিং, মোবাইল হ্যারাসমেন্ট, আপত্তিকর কনটেন্ট ছড়ানোসহ বিভিন্ন সাইবার অপরাধ সংঘটিত হয়। তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, ভুক্তভোগীর ছবি, মোবাইল নম্বর, বাসার ঠিকানা, এনআইডি বা যে কোনো পরিচিতি তথ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে (প্রকৃত বা এডিট করে) পোস্ট করে বা কমেন্ট করে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।

একটা বাস্তবতা তুলে ধরি কয়েকদিন আগে এক ক্লাইন্টের মামলা পরিচালনার দায়িত্ব পেলাম। দায়িত্ব পেয়ে কাগজপত্র পর্যালোচনা ও ক্লাইন্টের কাছে শুনে দেখি আসামীর অপরাধ হলো- আসামিকে মামলার ১ নম্বর আসামি ফেসবুকে ট্যাগ করে একটা মানহানিকর মন্তব্য পোস্ট করেছেন বাদীর বিরুদ্ধে। এতে করে মূল পোস্টকারী ও যাকে ট্যাগ করে পোস্ট করা হয়েছে সেও আসামি হয়েছে। মামলাটিতে পিবিআই তদন্ত করে পোস্টকারী ও ট্যাগকৃত ফেসবুক আইডির মালিক উভয়কেই প্রাথমিকভাবে অভিযুক্ত করে পুলিশ রিপোর্ট দিয়েছে। মামলার ধারা দিয়েছে- ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ এর ২৫/২৯ ধারা।

আসুন দেখি, ২৫ ধারায় কি বলা আছে দেখি-২৫ (১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি ও ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে, এইরূপ কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ করেন, যা আক্রমণাত্মক বা ভীতি প্রদর্শক অথবা মিথ্যা বলিয়া জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও, কোনো ব্যক্তিকে বিরক্ত, অপমান, অপদস্থ বা হেয়প্রতিপন্ন করার অভিপ্রায়ে কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ বা প্রচার করেন। বা রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বা সুনাম ক্ষুণ্ণ করার, বা বিভ্রান্তি ছড়াইবার, বা উদ্দেশ্যে, অপপ্রচার বা মিথ্যা বলে জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও, কোনো তথ্য সম্পূর্ণ বা আংশিক বিকৃত আকারে প্রকাশ, বা প্রচার করেন বা করতে সহায়তা করেন, তাহলে ওই ব্যক্তির এ ধরনের কাজ হবে একটি অপরাধ। যদি কোনো ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর অধীন কোনো অপরাধ সংঘটন করেন, তাহলে তিনি অনধিক ২ (দুই) বৎসর কারাদণ্ডে বা অনধিক ৩ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’ ২৯ ধারায় মানহানির বিষয়টি রয়েছে। এই ধারা অনুযায়ী, মানহানিকর তথ্য প্রকাশ বা প্রচার করলে সর্বোচ্চ ৩ বছর কারাদণ্ড বা পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হবে। একই অপরাধ দ্বিতীয়বার করলে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হবে।

ইন্টারনেট সেবা এখন অনেক প্রেক্ষাপটে আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ইন্টারনেট শিশু-কিশোর থেকে বয়োবৃদ্ধরাও ব্যবহার করে থাকে। বিআইজিডির গবেষণায় দেখা গেছে, ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সিরা অন্যান্য বয়সের ব্যক্তিদের তুলনায় বেশি ইন্টারনেট ব্যবহার করে এবং এ বিষয়ে তাদের দক্ষতাও আছে। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান নবম। গবেষণা বলছে, একজন মানুষ দিনে অন্তত ২ হাজার ৬৬৪ বার তার নিজের মোবাইল ফোনের স্ক্রিন স্পর্শ করে। আর এই স্ক্রিন স্পর্শ করার কারণ ফোনের নোটিফিকেশন চেক, কোনো এসএমএস এলো কিনা ইত্যাদির দিকে মনোনিবেশ করে। অল্পবয়সিরা লেখাপড়ার প্রতি মনোনিবেশ না করে দিনে দিনে ঝুঁকে যাচ্ছে ইন্টারনেটের অপব্যবহারে। ফেসবুক বা ইন্টারনেট সংযুক্ত অ্যাপগুলো ব্যবহারে সতর্ক না হলে অজান্তেই সাইবার অপরাধে করতে হবে। বিশেষ করে ফেসবুক ব্যবহারে লাইক, কমেন্ট, শেয়ার কিংবা বন্ধুদের ট্যাগ করে পোস্ট করার ক্ষেত্রে অত্যান্ত সতর্ক থাকতে হবে।

সাইবার অপরাধ একটি দেশ ও জাতির জন্য হুমকিস্বরূপ। সাইবার অপরাধের রাশ টেনে ধরতে সরকারকে আরো উদ্যোগ বাড়াতে হবে। সরকারের পাশাপাশি সাধারণ জনগণকেও আরো সচেতন হতে হবে। ইন্টারনেট ব্যবহার যখন আমাদের নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় তখন এই ইন্টারনেট ও ফেসবুকের সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে আমাদের আরো বেশি জানতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত