ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বাঙালির দুর্নীতি দর্শন এবং দুর্নীতিবাজের বয়কট!

রাজু আহমেদ
বাঙালির দুর্নীতি দর্শন এবং দুর্নীতিবাজের বয়কট!

॥ এক ॥

গণমাধ্যমে প্রকাশিত সাম্প্রতিক দুর্নীতি কাণ্ড নিয়ে বাঙালির যে ঘৃণা ও জাগরণ তার অনুরূপ পার্সেপশানের অভাব, যখন কারো বাপ-ভাই সরাসরি দুর্নীতিতে জড়িত। তখন আমরা আপন লোকের অন্যায়কে ভিন্নভাবে সংজ্ঞায়নের চেষ্টা করি! আপন লোকের বাড়তি আয় তার যোগ্যতা আর দূরের লোকের বেতনবহির্ভূত আয় ঘুষ! সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর দুর্নীতি যে চোখে বিচার করা হয়, জনতার সেই একই চোখে বেসরকারি ব্যক্তিবর্গের দুর্নীতি পরিমাপ করা হয় না। আমাদের এই দ্বৈতনীতি দুর্নীতিকে কখনো কখনো উৎসাহিত করে এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতির দিকে টানে। যে মানুষ সার্বিকভাবে ঘুষ-দুর্নীতিকে চরমভাবে অপছন্দ করে সেই ব্যক্তিও তার নিজের কাজ ও স্বার্থ আদায়ের উদ্দেশ্যে ঘুষের লেনদেন করে। পরক্ষণেই গল্প-আড্ডায় বলে বাংলাদেশটা গেছে! এদেশে দুর্নীতি ছাড়া কিছুই হয় না। বেতন এবং আয়ের অসংলগ্নতা যেখানে-সেখানেই দুর্নীতি আছে। দুর্নীতি সরাসরি দেশের ক্ষতি করে এবং দেশের ক্ষতি মানে প্রত্যেক নাগরিকের প্রত্যক্ষ ক্ষতি। প্রত্যেক দুর্নীতিবাজ এই সমাজের কারো না কারো বাপ-ভাই। আপনজনের অন্যায় কর্মকাণ্ডকে যখন বৈধতা দেয়ার যুক্তি খুঁজি, তখন পরের দুর্নীতি নিয়ে কথা বলার নৈতিক যোগ্যতা হারাই। যেদিন ঘুষ এবং দুর্নীতিকে সার্বিকভাবে না বলতে পারব, সেদিন একটি অন্য ও অনন্য বাংলাদেশের দেখা পাব। এজন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ এবং ব্যক্তির সচেতনতা- দু’টোই আবশ্যক। চিহ্নিত দুর্নীতিবাজদের যদি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া যায়, তবে রাষ্ট্রের এই সংকট হ্রাস পেত। দুর্নীতির সঙ্গে যারা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত তারা সবাই সমাজ-সংসারের উচ্চ শিক্ষিত! আইনের ধারা এবং ধর্মের বিধান কিংবা নীতি-নৈতিকতার লেসন অর্ডিনারী জনতার চেয়ে তারা অনেক ভালোই জানে! তারাই মুখে মুখে, ফেসবুক, পত্রিকাণ্ডমিডিয়ায় মানুষজনকে সততার গল্প শোনায়, আমজনতাকে নসিহত করে! কাজেই এই মুখোশধারী দুর্নীতিবাজদের নসিহত করে কোনো লাভ নেই। তাদের আইন-আদালতের মাধ্যমে যতদ্রুত সম্ভব গুরুদণ্ড দিয়ে জাতীয়ভাবে নজির স্থাপন করতে হবে।

দুর্নীতির সঙ্গে যে বা যারাই জড়িত- আমরা চাই সবার শাস্তি হোক। শুদ্ধাচার নিয়ে যত আলাপ হয়, সভা-সেমিনার ও ক্রেষ্টের বিনিময় হয় তার অল্পসল্প সততাও যদি মন-মননে থাকত, তবে শুদ্ধাচারে পুরস্কার পাওয়া কোনো লোক নিশ্চয়ই একপয়সার দুর্নীতি করতে পারত না। কেবল আর্থিক অস্বচ্ছতাকেই শুধু দুর্নীতি বলার সুযোগ নাই বরং এর সঙ্গে ক্ষমতার অপব্যবহার, দায়িত্বের অবহেলা এবং স্বজনপ্রীতিও সমানভাবে দুর্নীতি। যারা কর্মকালে আয়বহির্ভূত সম্পদ বাইরে পাচার করে, কালো টাকা সঞ্চয় করে তাদের চিহ্নিত করার মত এজেন্সি নিশ্চয়ই দেশে আছে। সেগুলোকে আরো সক্রিয় করতে হবে। শর্ষের মধ্যের ভূত, কাঠের মধ্যের ঘুণেপোকা তাড়াতে হবে। সমাজ থেকে ক্ষতিকর কীট নির্মূল করতে পারলে তবেই সুফল মিলবে। স্বার্থান্বেষী রাজনীতিবিদ, অসাধু ব্যবসায়ী কিংবা আঙুল ফুলে বটগাছ হওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারী, এই জাতের সবাই দেশের পশ্চাৎপদতার জন্য দায়ী। স্বাধীনতার দীর্ঘবছর পরেও বিভিন্ন সেক্টরে স্থবিরতা ও রুগ্নতার একমাত্র কারণ কতিপয় তন্ত্রের লাগামহীন দুর্নীতি।

॥ দুই ॥

বিভিন্ন ইস্যুতে আমরা ইসরায়েলের পণ্য বর্জন করি, ভারতীয় আগ্রাসন উপেক্ষা করি কিংবা তরমুজ-আড়ং ইত্যাদি বর্জন করেছি কিংবা করার আন্দোলনে সহমত পুষেছি। একবার জাগ্রত হয়ে দুর্নীতিবাজদের বর্জন করতে পারি না? যারা দুর্নীতি করে তারা তো আমাদের অচেনা নয়। আমাদের ঘরে, গ্রামে কিংবা সমাজেই তারা বাস করে। আমার যে আত্মীয়, পাড়ার যে মোড়ল, সমাজের যে মুখোশধারী সাধু দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, যার আয় ও অর্জিত সম্পদের মধ্যে সামঞ্জস্য নাই তাকে বয়কট করলে দুর্নীতির সংকটের সমাধান শুরু হবে। কোটি টাকার দুর্নীতি যেমন জাতীয়ভাবে ক্ষতিকর তেমনি হাজার টাকার দুর্নীতিও স্থানীয় পর্যায়ে অহিতকর। কাজেই দু’টোকেই রুখে দিতে উদ্যোগী হতে হবে। দুর্নীতিবাজকে যদি ঘৃণা না করি তবে আমিও দুর্নীতিবাজ। দুর্নীতিবাজদের দুনিয়া যদি কঠিন করতে সমর্থন না জানাই, তবে আমিও দুর্নীতিবাজ। আজ যদি দুর্নীতির বিরুদ্ধে মৌন থাকি, তবে সেটা দুর্নীতিবাজদের প্রচ্ছন্ন মদদ প্রদান করে। এইক্ষেত্রে আমার দায় ও অপরাধও কম নয়।

আমাদের পরিচিত যে জুনিয়র দুর্নীতিবাজ গং ও গ্যাং-রা আছে তাদের বয়কট করতে না পারলে মুক্তি মিলবে না। আইনি পদক্ষেপ আরো দ্রুততর হতে হবে। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে জিহাদে রাষ্ট্রের সদিচ্ছা আরো প্রকট ও প্রবল করতে হবে। সর্বত্র দুর্নীতিবাজদের যে সিন্ডিকেট তার শেকল ভেঙে দিতে পারলে তবেই ফলপ্রসূ উদ্যোগ হবে। বিশ্বাস হতে না পারে, ভিনদেশী পেপসি কোলা বয়কট করার চেয়ে দেশীয় দুর্নীতিবাজ বয়কট করা ধর্মীয় ও বৌদ্ধিক যুক্তিতে বেশি জরুরি ও যৌক্তিক। তরুণ প্রজন্মের কাছে একটি স্বচ্ছ বাংলাদেশের মডেল উপহার দিতে যা যা করণীয় ও বর্জনীয় তা নিশ্চিত করা জরুরি। গ্রামের চৌকিদার থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ আমলা, খুচরা ডিম ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে গ্রুপস অব ইন্ড্রাসট্রিজের মালিক কিংবা পাতি নেতা থেকে শুরু করে রাঘববোয়াল পর্যন্ত- শুদ্ধি অভিযান চালাতে হবে। শুধু মনে রাখতে হবে, কোন বডির মাথা সুস্থ থাকলে বাকি অর্গান এমনি এমনি সচল ও সুস্থ থাকে কিংবা থাকতে বাধ্য হয়।

শিক্ষিতদের মধ্যে দেশপ্রেম ও সততাণ্ডনৈতিকতার যে ঘাটতি সেই সংকট একদিনে সৃষ্টি হয়নি। এর থেকে উত্তরণ নিয়ে রাষ্ট্রকে কাজ করতে হবে। অবৈধ অর্থ কামাইয়ের যে মনোভাব তা আইনের মাধ্যমে রুখে দিতে হবে। দুর্নীতি শ্রেনিবদ্ধভাবে ইন্টার-ডিপেন্ডেন্ট। কাজেই একমাথার দুর্নীতি বন্ধ হলে আরেক মাথায় দুর্নীতি সীমিত হতে বাধ্য। দুর্নীতিবাজদের দৌরাত্ম্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান- সর্বত্রই রমরমা! সভাপতি আর নেতৃত্বের অনেকক্ষেত্রে তারাই! যারা রাষ্ট্রের সম্মৃদ্ধি শুষে কানাডায় বেগমপাড়া বানিয়েছে, সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকের ভল্ট ভরিয়ে রেখেছে কিংবা সুযোগ পেলেই দেশছেড়ে সবসহ ভিনদেশে লোপাট হচ্ছে। এই অবক্ষয় রুখে দিতে হবে। কারো অসংলগ্ন সম্পদ দেখলেই সেটার বিরুদ্ধে তদন্ত হতে হবে, সামাজিক কৈফিয়ত জাগ্রত করাতে হবে এবং পারিবারিক চাপ অব্যাহত রাখতে হবে। বাবা কোথা থেকে এতো টাকা পায় সেটা সন্তানের জানা উচিত! নয়তো সারাজীবন বাবাকে কাছে পাওয়া যাবে না! যুগ যুগ জেলের গেটেও সাক্ষাৎ করতে হবে!

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত