শিক্ষা তাদের অধিকার : মায়েদের অধিকার হোক ছায়া-শিক্ষক হওয়ার

মো. তাহমিদ রহমান

প্রকাশ : ০৩ জুলাই ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

শিক্ষার অধিকার একটি মৌলিক অধিকার। যে কোনো মানুষ শিক্ষার যথাযথ সুযোগ পেলে তার জীবনকে সবদিক থেকে উন্নত করতে পারে। শিক্ষার মাধ্যমে জীবন বিকাশের পথগুলো উন্মুক্ত হয়। স্বাধীনতার পরে গত কয়েক দশক ধরে সর্বস্তরে শিক্ষার সুযোগ পৌঁছে দিতে সরকারিভাবে বেশ কিছু নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন (অটিজম, ডাউন-সিনড্রোম, সেরিব্রাল-পালসি এবং বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন) শিশুরা আজও বহুলাংশে শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। শিক্ষার যে আক্ষরিক অথবা অন্তর্নিহিত অর্থ তা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অপ্রতুল। যে কোনো শিশুর বেড়ে ওঠার পথপরিক্রমায় সামাজিকীকরণে যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সেগুলোর মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অন্যতম। তবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করতে হলে আগে তাদের বিশেষ শিক্ষার দ্বারা নানাবিধ প্রশিক্ষণ, থেরাপি ও আচরণগত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উপযোগী করে গড়ে তুলতে হয়। ফলশ্রুতিতে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন এসব শিশু পরবর্তীতে শিক্ষার মূলস্রোতে শামিল হতে পারে। বিশেষ শিক্ষার মাধ্যমে উপযোগী করে অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে মূলস্রোতীকরণ করতে হলে জীবনব্যাপী ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন হয়। যেহেতু অটিজম একটি স্নায়ু বিকাশজনিত সমস্যা তাই পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নিতে বিশেষ করে শিক্ষা ও সামাজিকীকরণে এসব শিক্ষার্থীদের পিতা-মাতাকে জীবনব্যাপী কার্যক্রম চালাতে হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিশেষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অক্লান্ত পরিশ্রম করে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের যখন মূলধারার প্রাথমিক শিক্ষার জন্য উপযোগী করে গড়ে তুলে ঠিক তখনই নতুন এক বাধার সৃষ্টি হয়। ক্ষেত্রবিশেষে এ বাধা সৃষ্টি হয় জ্ঞানের অজ্ঞতা থেকে, সামাজিক কুসংস্কার থেকে, সৃষ্টিশীল নয় এমন মন-মানসিকতা সম্পন্ন ব্যক্তিদের কাছ থেকে। যেহেতু এসব শিশুদের সময়ের সাথে সাথে শিক্ষা ও আচরণগত ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন হয় তাই অনেক সময় প্রাথমিক শিক্ষাধারার সাথে অভ্যস্ত হতে প্রয়োজন হয় ঝযধফড়ি ঞবধপযবৎ তথা ছায়া শিক্ষকের। এক্ষেত্রে প্রথম বাধা হয়ে দাঁড়ায় জানার সীমাবদ্ধতাসম্পন্ন কিছু অভিভাবক। তাদের বদ্ধমূল কুসংস্কারমনা ধারণা থাকে বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশু শ্রেণিকক্ষে অবস্থান করলে তাদের সন্তানও এটার দ্বারা আক্রান্ত হবে অথচ চিকিৎসা বিজ্ঞান বলছে এটি কোনো রোগ নয় সুতরাং আক্রান্ত হওয়ার প্রশ্নই আসা উচিত নয়। দ্বিতীয় নেতিবাচক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় শ্রেণিশিক্ষক, ঝামেলা কাঁধে আসবে এই কুচিন্তা থেকে বিভিন্ন পরিস্থিতি সৃষ্টি করে তাদের শিক্ষার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করে। আরো ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি করে কিন্ডারগার্ডেন প্রতিষ্ঠানসমূহ। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানসমূহ যেহেতু ব্যক্তি মালিকানায় গড়ে ওঠে তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা সরাসরি অভিভাবকদের না করে দেয়। অনেক সময় প্রভাবশালী অভিভাবকের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী ভর্তি করালেও শ্রেণিশিক্ষকের মাধ্যমে পাঠ ব্যবস্থাপনায় ছায়া শিক্ষক নিয়ে নানা ধরনের অজুহাত সৃষ্টি করে। প্রায় ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে রাজি হলেও ভর্তি ফি, সেশন ফি, মাসিক বেতন ইত্যাদি পাঁচ থেকে সাত গুণ অর্থ দাবি করে। যেহেতু শিক্ষার মাধ্যমে মানবশিশু সামাজিক উন্নয়ন লাভ করে রাষ্ট্রের সুনাগরিক হয়ে পরবর্তী জীবনে সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন দায়িত্ব পালনে নিযুক্ত হয়। তাই সংবিধানের ১৫নং অনুচ্ছেদে সব নাগরিকের শিক্ষালাভের সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশ সংবিধানের ১৯-এর (১), ২৭, ২৮-এর (১, ৩, ৪) এবং ২৯-এর (১) নং অনুচ্ছেদে দেশের সব নাগরিকের জন্য সমতা বিধানের কথা উল্লেখ আছে। রাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার সম্মিলিত উন্নয়ন করার লক্ষ্যে দেশের পশ্চাৎপদ, দরিদ্র, এতিম, প্রতিবন্ধী ও অনগ্রসর মানুষের কল্যাণে বর্তমান সরকার ব্যাপক ও বহুমুখী কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। আমাদের মাথায় রাখতে হবে অনগ্রসর জনসংখ্যার অন্যতম হলো স্নায়ু বিকাশজনিত প্রতিবন্ধিতা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মানুষ। তাই এসব শিশুদের শিক্ষার অধিকার বঞ্চিত করে রাখা মানে সরাসরি রাষ্ট্রের সংবিধানকে লঙ্ঘন করা। স্নায়ু বিকাশজনিত সমস্যা তথা অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের শিক্ষার সুযোগ ও অধিকার প্রদান করা এবং এসব শিশুদের মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থার সাথে একীভূত করা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব। সাংবিধানিক এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বর্তমান সরকার নিউরো ডেভেলপমেন্ট প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন-২০১৩ প্রণয়নের মাধ্যমে এক যুগান্তকারী ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। সমন্বিত বিশেষ শিক্ষানীতিমালা- ২০০৯ কে দীর্ঘ পথপরিক্রমায় সময়োপযোগী করে ২০১৯ সালের অক্টোবরে চূড়ান্ত অনুমোদন করা হয়েছে। এর মূল উদ্দেশ্য যেসব প্রতিবন্ধী শিশু (মাঝারি ও চরম মাত্রার) বিশেষত এনডিডি, অর্থাৎ অটিজম, সেরিব্রাল-পালসি, ডাউন-সিনড্রোম ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন তাদের জীবন দক্ষতার পাশাপাশি নমনীয়ভাবে মূলধারার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা। এছাড়াও সমাজের সব ক্ষেত্রে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের ভবিষ্যৎ জীবন নিরাপদ ও নির্বাহ করতে বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন ২০০১-এ প্রতিবন্ধিতা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য যে সাতটি সেবার কথা উল্লেখ করেছে তার মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে প্রতিবন্ধিতা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তিদের শিক্ষা সেবা। দেশের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-২০৩০ এর অন্যতম এজেন্ডা হচ্ছে সবার জন্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা। পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপের তথ্য বলছে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫৩.২ শতাংশ থাকলেও মাধ্যমিকের তা কমে ৩৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের হার আরো কম। দেশের সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের উপযোগী পরিবেশ ও ন্যায্য সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছিল ২০১৩ সালে করা প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইনে। হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সেই ব্যবস্থা করা হয়নি। এমনকি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের সাধারণ স্কুলগুলোতে ভর্তিই নেওয়া হয় না। স্কুলগুলোতে প্রতিবন্ধিতা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন এসব শিক্ষার্থীদের ভর্তিতে বাধার সৃষ্টি হলে অভিভাবকদের প্রতিকার পেতে কি করণীয় সে বিষয়ে প্রচার-প্রচারণাও নেই বললেই চলে। সরকারিভাবে প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষার জন্য কিছু ব্যবস্থা আছে তবে তা সীমিত। প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে পরিচালিত হয় কিন্তু তাদের শিক্ষা কার্যক্রম শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনেই পরিচালিত হওয়া উচিত। সমাজসেবা অধিদপ্তরের স্কুলে পড়লেও প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের দিনশেষে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনেই পরীক্ষা দিতে হয়। শিক্ষানীতিতে অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার কথা বলা হলেও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে মাঠ পর্যায়ে তা এখনো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। শিক্ষা অধিকার, কিন্তু এখনো দেশে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের শিক্ষার বিষয়টি কল্যাণের দৃষ্টিতে দেখা হয়! সৌভাগ্যক্রমে ব্যক্তি উদ্যোগে কিছু বিশেষায়িত স্কুল গড়ে উঠেছে যা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের চাহিদা পূরণের সক্ষমতা রাখে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন এসব শিশুদের বিশেষ শিক্ষার মাধ্যমে উপযোগী করে যখন মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থায় অবতীর্ণ হয় তখন প্রয়োজনীয়তার নিরিখে মাতা-পিতা অথবা দায়িত্বশীল বিশেষ শিক্ষক সেই শিক্ষার্থীর জন্য ছায়া শিক্ষকের ভূমিকা পালন করতে পারে না। ফলশ্রুতিতে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে ওঠা এসব বিশেষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের জাতীয় সম্পদের পরিণত করতে, মূলধারার স্কুলগুলোতে শিক্ষা গ্রহণের উপযোগী করে গড়ে তুলতে দীর্ঘদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করলেও, মূলধারায় পদার্পণ করতে এসে শুধুমাত্র অসহযোগিতার মানসিকতা ও হীন চিন্তার আঘাতে অসংখ্য প্রতিভা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে অভিভাবকদের কণ্ঠস্বর সোচ্চার হতে হবে। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের অধিকার ও আইনগত প্রতিকার সম্পর্কে সবাইকে জানাতে হবে। আপনার বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুকে ঘরে লুকিয়ে না রেখে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিতে হবে এবং সমাজব্যবস্থাকে জানিয়ে দিতে হবে সে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু কিন্তু সেও বাংলাদেশের একজন সম্মানিত নাগরিক। তার অধিকার আছে লেখাপড়া করার, জীবিকা নির্বাহ করার, স্বাভাবিকভাবে জীবনযাপন অতিবাহিত করার। এরইমধ্যে রাষ্ট্রব্যবস্থা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য নানাবিধ কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছে।

২০১৫ সালের ২৯ মে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত প্রজ্ঞাপন স্মারক নং ৩৭.০০.০০০০.০৭২.৪৩.০৩৬.১৪.৪৯৫ এর নির্দেশনা মোতাবেক মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডসমূহ বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন পরীক্ষার্থীদের পাবলিক পরীক্ষায় (এসএসসি ও এইচএসসি) অংশগ্রহণের সুবিধার জন্য অন্যান্য পরিক্ষার্থীর তুলনায় ১০ শতাংশ (৩০ মিনিট) অতিরিক্ত সময় প্রদান করে। উল্লেখ্য, যে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন পরীক্ষার্থীরা শিক্ষক/অভিভাবক/সাহায্যকারী অর্থাৎ ছায়া শিক্ষকের বিশেষ ব্যবস্থাপনা সহায়তায় পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারে। যেহেতু বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থায় খাপখাওয়াতে রাষ্ট্র বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তারই পরিপ্রেক্ষিতে পিতা-মাতা অথবা দায়িত্বপ্রাপ্ত কেয়ারগিভার বা বিশেষ শিক্ষককে প্রয়োজনের নিরিখে শ্রেণি শিখন কার্যক্রমে ছায়া শিক্ষকের ভূমিকা পালনের অধিকার প্রদানে আইন প্রণয়ন সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে। শ্রেণি শিখন কার্যক্রমে এই আইন প্রণয়ন ও যথাযথ প্রয়োগ করতে পারলেই আমরা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের নিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থার সফল বাস্তবায়ন দেখতে পারব।

লেখক: প্রভাষক (তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি) নূরুল আমিন মজুমদার ডিগ্রি কলেজ, লাকসাম, কুমিল্লা