ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সাপের ছোবলে ভয় নয়

চিকিৎসা ও সচেতনতা জরুরি
সাপের ছোবলে ভয় নয়

এখন বর্ষা মৌসুম চলছে। এ সময়ে চারিদিকে নদ-নদীর পানি বাড়তে থাকে এর ফলে প্রাণীদের আবাসস্থলের সংকট দেখা দেয়। জীবন বাঁচাতে সাপসহ অন্যান্য প্রাণী লোকালয়ে চলে আসে। বিশেষ করে বন্যার সময় কোনো এলাকা নিমগ্ন হলে ও বনজঙ্গল ডুবে গেলে সাপ, পোকা ইত্যাদি মানুষের আবাস্থলে এসে পড়ে। এ সময় অনেকে সাপের কামড়ের শিকার হয়। বন্যার সময় সাপ-পোকার আচরণ স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ভয়ংকর হয়ে থাকে। ফলে এ সময় বিশেষ সতর্কতা প্রয়োজন। বিষধর সাপের কামড় জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এ সাপের উপরের দাঁতের গোড়ায় যে বিষথলি থাকে, কামড়ের সাথে সাথে সে বিষ ক্ষতের মাধ্যমে রক্তনালীতে প্রবেশ করে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। সাপের বিষের বিষাক্ত উপাদানগুলো স্নায়ুকোষকে আক্রমণ করে, হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া প্রতিহত করে এবং মৃত্যু ঘটায়।

আমাদের এ অঞ্চলে প্রায় ৮০ প্রজাতির সাপের মধ্যে ১২ প্রজাতির সামুদ্রিক সাপসহ ২৭ প্রজাতির বিষধর সাপ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ৬ প্রজাতির বিষধর সাপের দংশন চিকিৎসা শাস্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো হচ্ছে গোখরা, পদ্মগোখরা, কেউটে, সবুজ সাপ, চন্দ্রবোড়া এবং সামুদ্রিক সাপ। দংশিত স্থানে কামড়ের দাগ দেখে সাপটি বিষধর কিনা তা শনাক্ত করা সম্ভব। সব বিষধর সাপের সামনে দুটি বিষদাঁত থাকে, যা অন্যান্য দাঁত থেকে বড়, তীক্ষ্ম ও বাঁকানো। সাপে কামড়ালে যদি কামড়ানো স্থানে দুটি তীক্ষ্ম গভীর দাগ থাকে, তাহলে বুঝতে হবে সেটি বিষধর সাপের কামড়। আর যদি ছোট ছোট একসারি দাগ থাকে, তবে সেটি বিষধর নয়।

সুস্পষ্টভাবে শনাক্ত করা না গেলে অর্থাৎ সাপটি বিষধর কি না, এ নিয়ে সন্দেহ থাকলেও কালক্ষেপণ না করে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। সাপ না দেখলেও দংশনের পারিপার্শ্বিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে দংশনকারী সাপের ধরন অনুমান করা যেতে পারে। যেমন রাতে ঘুমের মধ্যে মাটিতে শোয়া অবস্থায় সাপে কামড়ালে, তা কেউটে সাপের দংশন হতে পারে, মিঠে পানিতে মাছ ধরার সময় জেলেদের দংশনকারী সাপ সম্ভবত গোখরা, জঙ্গলে কিংবা বাগানে কাজ করার সময় সাধারণত সবুজ সাপ দংশন করে থাকে এবং কৃষকের ধান কাটার সময় সাপের কামড় খেলে তা সম্ভবত রাসেলর ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া। গোখরার দংশনে ৬ থেকে ৮ মিনিটের মধ্যে বিষক্রিয়া দেখা দেয়। দংশিত স্থান লাল হয় ও চাপ দিলে ব্যথা লাগে। কিছুক্ষণ পর সেখানে জ্বালাপোড়া অনুভূত হয়। কেউটে সাপে কামড়ালে দংশিত স্থান ফুলে ওঠে না এবং দংশনের স্থানে কোনো খোঁচার দাগ দৃশ্যমান নাও হতে পারে। দংশিত স্থানে সামান্য ব্যথা, চুলকানি এবং অবশ বা ঝিনঝিন ভাব হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে, প্রথমদিকে সর্পদংশনের সন্দেহ নাও হতে পারে। দংশনের ফলে সৃষ্ট উপসর্গগুলো বিলম্বে দেখা দিতে পারে। কেউটে সাপ গোখরার চেয়ে ৬ থেকে ৮ গুণ বেশি বিষধর।

সাপের ছোবলে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। কিছুতেই ঘাবড়ানো যাবে না। কারণ, সব সাপের কামড় বিষধর সাপের নয়। আবার বিষধর সাপে কামড়ালেও দংশনের সময় পর্যাপ্ত পরিমাণে বিষ ঢেলে দিতে না পারলে বিষক্রিয়া নাও হতে পারে। সাপেকাটা রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নেয়াসহ আগে থেকে কিছু প্রাথমিক চিকিৎসা থাকা প্রয়োজন। এগুলো জেনে রাখা ভালো।

কারো পায়ে বা হাতে সাপে কাটলে কাছাকাছি কোথাও বসে পড়ে কামড়ের স্থানের কিছুটা উপরে গামছা বা ওড়না বা অনুরূপ কাপড়ের টুকরো দিয়ে কেবল একটি গিঁট দিন। পায়ে কামড়ালে উরুতে, হাতে কামড়ালে কনুইয়ের উপরে এমনভাবে গিঁট দিতে হবে, যেন খুব আঁটসাঁট বা ঢিলে কোনোটিই না হয়। দড়ি অথবা সুতা দিয়ে শক্ত করে গিঁট দেয়া যাবে না। গিঁট দেয়ার কাপড়ের টুকরো দেড় ইঞ্চির মতো চওড়া হলে ভালো হয়। হাতের কাছে গামছা, ওড়না বা কাপড়ের টুকরা না থাকলে পরনের কাপড়ের কিছুটা অংশ ছিঁড়ে বাঁধতে হবে। কিছুতেই বিলম্ব করা যাবে না। বাঁধনটি যেন অস্থিসন্ধিতে যেমন- কনুই, কবজি বা গোড়ালি এবং গলা বা মাথায় না হয়। যদি বাঁধনটি খুব শক্ত হয়ে যায় তবে একটু ঢিলা করে দিতে হবে, যাতে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে না পড়ে।

বাঁধনটি প্রতি ৩০ মিনিট অন্তর ৩০ সেকেন্ডের জন্য কিংবা ১ ঘণ্টা অন্তর ১ মিনিটের জন্য আলগা করে দিতে হবে। ২ ঘণ্টার বেশি সময় বাঁধন রাখা উচিত নয়। এতে রক্ত সঞ্চালনে ব্যাঘাতের ফলে পচন হওয়া, মাংসপেশী অবশ হওয়া, গিঁট দেয়া অঙ্গে বিষ জমে থেকে বিষক্রিয়ার তীব্রতা বৃদ্ধি পাওয়া ইত্যাদি পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সাপে কাটার সময় রোগীর কাছে কেউ থাকলে তার দায়িত্ব হবে সাথে সাথে রোগীকে শুইয়ে দিয়ে এসব পরিচর্যা করা। রোগীর নড়াচড়া সম্পূর্ণরূপে বন্ধ রখতে হবে। হাড় ভেঙে গেলে যেভাবে স্পিøন্টের সাহায্যে নড়াচড়া প্রতিরোধ করা হয়, দংশিত হাত-পা তেমনভাবে রাখতে হবে। নড়াচড়া করা যাবে না। নড়াচড়ায় মাংসপেশীর সংকোচনের ফলে বিষ দ্রুত রক্তের মাধ্যমে শরীরে ছড়িয়ে বিষক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। কাজেই, দংশিত হাত-পা এমনভাবে কাঠের টুকরো, বাঁশের চটা বা কঞ্চির সাথে কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে বাঁধতে হবে, যাতে নড়াচড়া না হয়। বাঁধন দেয়ার সময় সাপের কামড়ের স্থান পরিষ্কার ভেজা কাপড় দিয়ে মুছে ব্যান্ডেজ দিয়ে আবৃত রাখতে হবে। আক্রান্ত স্থান কাটা, সুঁই ফোটানো বা কোনো কিছুর প্রলেপ দেয়া যাবে না।

সাপ ভয়ংকর হলেও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা এবং অনেক রোগের ঔষধ প্রস্তুতের জন্য সাপের প্রয়োজন রয়েছে। সাপ সাধারণভাবে আক্রমণকারী নয়, বরং মানুষ দেখলে পালিয়ে যায়। সাধারণত কেউ উত্ত্যক্ত করলে, তাড়িত হলে, দুর্ঘটনাবশত পদদলিত হলে বা গায়ে হাত পড়লে এরা দংশন করে।

তাই অকারণে সাপকে না মারাই উত্তম, কোথাও সাপ দেখলে তাকে নিজের মতো করে চলে যেতে দেয়াই ভালো। ঝোপঝাড়, জঙ্গলের ভিতর খুব সাবধানে হাঁটতে হবে, কোনো গর্তে হাত দেয়া যাবে না। রাতে পথ চলার সময় আলো ও লাঠি নিয়ে চলাচল করা উচিত। পানিতে মাছ ধরার সময় জালে হাত দেয়ার আগে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। বিষধর সাপের কামড়ের আধুনিক চিকিৎসা আছে, তাই ঝাড়-ফুক, তাবিজ-কবজ বা কবিরাজ-ওঝার কাছে সময় নষ্ট না করে রোগীকে দ্রুত নিকটতম জেলা বা উপজেলা হাসপাতাল অথবা সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত