ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

রাসেলস ভাইপার : আতঙ্ক, গুজব ও বাস্তবতা

ড. কবিরুল বাশার
রাসেলস ভাইপার : আতঙ্ক, গুজব ও বাস্তবতা

ছাগলকাণ্ডের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাসেলস ভাইপার তার অবস্থান শক্ত রেখে চলেছে বাংলাদেশের সোশ্যাল মিডিয়ায়। সম্প্রতি বাংলাদেশে পদ্মাসহ বিভিন্ন নদী তীরবর্তী অঞ্চলগুলোয় রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সাপের উপদ্রব বেড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে বলে সোশ্যাল মিডিয়া এবং গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হচ্ছে। ফেসবুকে বিষয়টি নিয়ে অনেকে নানাভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার করছেন যে, সাপটি কামড় দিলে অতিদ্রুত মানুষের মৃত্যু হয়। পদ্মা অববাহিকার বিভিন্ন চরাঞ্চল ও এলাকাজুড়ে রাসেলস ভাইপারের চরম আতঙ্কে রয়েছে মানুষ। সবার মুখে মুখে একই আলোচনা রাসেলস ভাইপার। প্রাণিবিদ্যার শিক্ষক হওয়ার কারণে অনেকেই আমার কাছে বিষয়টি জানতে চেয়েছেন। সবাইকে আমি জিজ্ঞেস করেছি আপনারা সাপটিকে স্বচক্ষে দেখেছেন কি না। সবারই উত্তর তারা নিজে এর আক্রমণের শিকার হননি, তবে অনেকেই হয়েছে বা সাপটি দেখেছেন বলে তারা শুনেছেন। বিভিন্ন এলাকায় লোকজন যে কোনো সাপ মেরে রাসেলস ভাইপার বলে বাহাবা কুড়ানোর জন্য পোস্ট করছেন ফেসবুকে। এরই মধ্যে ফরিদপুরের একজন রাজনীতিবিদ প্রতিটি রাসেলস ভাইপার সাপ মারার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। এই সাপটি নিয়ে যে যেভাবে পারছেন তথ্য এবং গুজব ছড়িয়ে যাচ্ছেন। সাপ নিয়ে যারা গবেষণা করেন এমন ব্যক্তি ও সংগঠন এরইমধ্যে বিভিন্ন তথ্য ও উপাত্ত দিয়ে জনগণকে সচেতন করার চেষ্টা করছেন কিন্তু সেই পোস্টগুলো খুব বেশি শেয়ার বা ভাইরাল হচ্ছে না।

ফেসবুকে প্রচার করা বেশিরভাগ পোস্টে দেখা যায়, সাপের প্রায় একই ছবি বা ভিডিও। ২১ জুন সকাল থেকে কয়েকটি ফেসবুক আইডি ও পেজে প্রচারিত হয়, ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার পাঠাননগর ইউনিয়নের সোনাপুর গ্রামে রাসেল ভাইপারের আগমন ঘটেছে। এই পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ফেনী জেলার বিভিন্ন স্থানে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। খবর নিয়ে জানা যায়, শরীয়তপুর জেলায় রাসেলস ভাইপার সাপের উপদ্রবের একটি ভিডিও সোনাপুরে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সোনাপুর গ্রামে রাসেলস ভাইপার সাপ দেখা যাওয়ার তথ্যটি সঠিক নয় বলে নিশ্চিত করেছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন বুঝে বা না বুঝে কিছু ব্যক্তি অন্য জায়গার ঘটনা ফেনীর বলে চালিয়ে দিয়েছেন। রাসেলস ভাইপার আতঙ্কের কারণে বিভিন্ন জায়গায় অনেকেই অন্যান্য বিষধর কিংবা নির্বিষ সাপের সাথে রাসেলস ভাইপারকে মিলিয়ে ফেলছেন। অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে যেকোনো সাপ মেরে তার ছবি তুলে বা ভিডিও করে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করছেন। সাপ খাদ্যশৃংখলের অন্যতম একটি প্রাণী এভাবে সাপের পরিচয় না জেনে নির্বিচারে নির্বিষ এবং বিষধর সাপ মারার ফলে তা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। বাংলাদেশে বর্ষাকালে প্রায় প্রতি বছরই সাপের উপদ্রব বেড়ে যায়। ভাটি অঞ্চলের নিচু দেশ হওয়ার কারণে বর্ষায় বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয় এবং সাপের আবাসভূমিতে পানি ঢুকে যায়। সব ধরনের সাপই বর্ষাকালে বিভিন্ন উঁচু এলাকা এবং ঘরবাড়ির কাছাকাছি আশ্রয় নেয়। আর এই সময়ে লোকজন না দেখে, না বুঝে সাপের সংস্পর্শে আসে আর তখনই মানুষ আক্রান্ত হয়।

শুধুমাত্র রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া নয়, বাংলাদেশে প্রায় ৯৪ প্রজাতির সাপ আছে এবং এই সাপের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ সাপ নির্বিষ। বাংলাদেশের প্রাপ্ত বিষধর সাপসমূহ মূলত এলাপিডি পরিবারভুক্ত। এ ছাড়া কিছু ভাইপারিডি এবং সামুদ্রিক হাইড্রোফিডি পরিবারভুক্ত সাপও দেখা যায়। রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া বা উলুবোড়া ভাইপারিডি পরিবারভুক্ত ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম বিষধর সাপ এবং উপমহাদেশের প্রধান চারটি বিষধর সাপের একটি। প্যাট্রিক রাসেল ১৭৯৬ সালে তার ‘অ্যান অ্যাকাউন্ট অব ইন্ডিয়ান সারপেন্টস, কালেক্টেড অন দ্য কোস্ট অব করোমান্ডেল’ বইয়ে চন্দ্রবোড়া সম্পর্কে লিখেছিলেন ও তার নাম অনুসারে এটি রাসেলস ভাইপার নামে পরিচিত হয়। রাসেলস ভাইপারের দেহ মোটাসোটা, লেজ ছোট ও সরু। প্রাপ্তবয়স্ক সাপের দেহের দৈর্ঘ্য সাধারণত ৪৭-৬৫ ইঞ্চি পর্যন্ত হতে পারে। তবে পাহাড়ি এবং দ্বীপ অঞ্চলে এর ব্যতিক্রম দেখা যায়। এদের মাথা ত্রিকোণাকৃতি বা অনেকটা ইংরেজি বর্ণমালা ‘ঠ’ এর মতো দেখতে, এদের মাথা ঘাড় থেকেও চওড়া হয়, এদের নাসারন্ধ্র ছোট এবং চোখের মণি খাড়া হয়। এই সাপকে অন্যান্য সাপ থেকে আলাদা করে চেনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এদের ফ্যাকাসে কমলা বাদামি রঙের পিঠের উপর লালচে বাদামি রঙের ডিম্বাকৃতি বা চাকতির মতো কালো বর্ণের সীমানাযুক্ত বড় বড় বৃত্ত, যা মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত তিনটি সারিতে শেকলের মতো চলে গেছে। এই সাপের শরীরে চাকতির মতো কালো রঙের সীমানাযুক্ত বৃত্তগুলো কিছুটা চাঁদের মতো দেখতে হওয়ায় বাংলায় এই সাপকে চন্দ্রবোড়া বলা হয়। রাসেলস ভাইপার ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও নেপালে পাওয়া যায়। এটি পশ্চিমবঙ্গের বেশিরভাগ জেলায়, বিশেষ করে নদীয়া, বর্ধমান, উত্তর চব্বিশ পরগনা ও বাঁকুড়া জেলার গ্রাম অঞ্চলে ভয়ের অন্যতম কারণ। আগে শুধুমাত্র বাংলাদেশের রাজশাহী অঞ্চলে এই সাপ দেখা যেত। যে কারণে এটি বরেন্দ্র অঞ্চলের সাপ বলেই পরিচিত ছিল। অনেকে ধারণা করেন, বর্ষা বা বন্যায় কিংবা গঙ্গা, পদ্মা নদীর পানিতে ভেসে ভারত থেকে এসব সাপ বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ইতোপূর্বে চন্দ্রবোড়া সাপ নিয়ে একটি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশিত হলেও বর্তমান সময়ে দেশের ঠিক কতগুলো জেলায় এদের অস্তিত্ব রয়েছে তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, নওগাঁ, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর পাবনা, শরীয়তপুর, মুন্সিগঞ্জ, মাদারীপুর, বাজিতপুর থেকে শুরু করে ঢাকার পার্শ্ববর্তী দোহার, নবাবগঞ্জ ও সাভারেও চন্দ্রবোড়ার দংশনের ঘটনা ঘটেছে বলে বিভিন্ন মাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। রাসেলস ভাইপার সাপের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, এরা অন্য সাপের মতো ডিম দেয় না। সরাসরি বাচ্চা প্রসব করে থাকে। সদ্য প্রসূত বাচ্চা আট থেকে ১০ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। বাচ্চা প্রদানের ক্ষেত্রেও চন্দ্রবোড়া ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। এই সাপটি বছরের যে কোনো সময় প্রজনন করে। তবে মে-আগস্ট মাসে প্রজনন সবচেয়ে বেশি ঘটে। একটি স্ত্রী সাপ গর্ভধারণ শেষে ২০-৪০টি বাচ্চা দেয়। তবে কোনো কোনো রাসেলস ভাইপার সাপের ৮০টি পর্যন্ত বাচ্চা দেওয়ার প্রমাণ আছে।

১৯৮৭ সালে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত প্রথিতযশা জীববিজ্ঞানী এবং সর্প বিশেষজ্ঞ ড. মো. আলী রেজা খানের ‘বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী’ বইয়ে দেশের বেশ কিছু স্থানে চন্দ্রবোড়া সাপের অস্তিত্বের কথা লেখা হয়েছে। সেইখানে তিনি লিখেছেন, উত্তরবঙ্গে দেশের অন্য এলাকা থেকে বেশি পাওয়া যায়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর থেকে বেশ কয়েকটা চন্দ্রবোড়া ধরা হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। দক্ষিণবঙ্গের কুষ্টিয়া, যশোর এবং খুলনাতেও বেশ পাওয়া যায়। কেবল ঢাকা বিভাগের যমুনার পূর্বদিকে এদের সন্ধান তিনি পেয়েছিলেন বলে লিখেছেন। একসময় সুন্দরবনের কিছু অংশ, মধুপুরের শালবন এবং দেশের অন্যান্য কিছু স্থানে এদের উপস্থিতি ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে দেশের প্রকৃতি থেকে চন্দ্রবোড়া আস্তে আস্তে হারিয়ে যেতে শুরু করে। দীর্ঘ বিরতির পর ২০০৯ সালে দেশের প্রকৃতিতে আবার এদের দেখা মেলে। চন্দ্রবোড়া ভারত ও বাংলাদেশে মহাবিপন্ন প্রাণীর তালিকায় রয়েছে। আইইউসিএনের ২০১৫ সালের লাল তালিকা অনুযায়ী চন্দ্রবোড়া বাংলাদেশে সংকটাপন্ন প্রাণী। এখন অনেকের মনে প্রশ্ন, হারিয়ে যাওয়া চন্দ্রবোড়া কী করে আবার সাড়ম্বরে ফিরে এলো প্রকৃতির কোলে? দেশের প্রকৃতি এখন যেখানে অনেকটাই বন্যপ্রাণী এবং সাপশূন্য। বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতিতে এদের অবদান সম্পর্কে সম্মুখ জ্ঞান না থাকায় যুগের পর যুগ মানুষ বন্যপ্রাণীদের নিছক উৎপীড়ন মনে করেছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত