দুর্নীতিবাজ ও মানিলন্ডারিংরা দেশের শত্রু

মাহবুবউদ্দিন চৌধুরী, লেখক কলামিস্ট

প্রকাশ : ০৬ জুলাই ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

দেশে একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ সরকারি চাকরীজীবীরা অবৈধ সম্পদ ও দুর্নীতির মহাৎসব চালিয়ে যাচ্ছে যা রোধ করা দুরূহ। আবার একশ্রেণির পুলিশের কর্মকর্তাদের অস্বাভাবিক সম্পদ অর্জন সম্পর্কে গণমাধ্যমে দুর্নীতির যে চিত্র এসেছে সেখানেও বিপত্তি। পুলিশ এসোসিয়েশন তাদের দুর্নীতি সম্পর্কে যে বিবৃতি দিয়েছে তা দুঃখজনক, বরং বিষয়টি নিয়ে পুলিশকে আরো ঘোলাটে করে ফেলেছে। যাই হোক, এই বিষয়টি নিয়ে আর আলোচনা না করে দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। শুধু পুলিশ কেন, এনবিআর-এর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও তার পরিবার যেভাবে অর্থ সম্পদের মালিক হয়েছেন তা দেশের জন্য অনেক ক্ষতিকারক। এমন কি দুর্নীতিবাজ, মানিলন্ডারিং ও ঋণগ্রহিতারাও দেশের শত্রু। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারীদের হুঁশিয়ারি করে বলেছিলেন- আমলানির্ভর নয়, রাজনৈতিক প্রজ্ঞার মাধ্যমে দেশ গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, কিছু মানুষ টাকা-পয়সা ও অবৈধ সম্পদের দিকে পা বাড়ায় আবার পরবর্তী সময়ে তারাই মামলা খেয়ে দেশ থেকে পালায়। তাহলে সেই অর্থ সম্পদ বানিয়ে লাভটা কি হলো। প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে। সে যে কেউ হোক না কেন, দুর্নীতি করলে কারও রক্ষা নেই।

বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও তার অধীনস্থ প্রায় সব সরকারি অফিস-আদালত, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ সরকারি সব অফিসগুলোতে রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি উইপোকার মতো দেশটাকে ফাঁপা করে দিচ্ছে, যা রোধ করা দুদুক কেন, কারো পক্ষে সম্ভব নয়। তবে যত দ্রুত সম্ভব দেশটাকে বাঁচাতে হলে সবাইকে একসাথে মিলেমিশে দুর্নীতি দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে। যেদিকে তাকাবেন সরকারি অফিস-আদালত বা মন্ত্রণালয় বা তার অধিনস্ত সব প্রতিষ্ঠানে ওপেন সিক্রেটের মতো দুর্নীতির ব্যাপকতা শতগুন বেড়েছে। বরং দুর্নীতি মাকড়সার জাল বা অক্টোপাসের মতো জেঁকে বসেছে, যা সরানো একেবারে দুষ্কর। সরকারি অফিসের পিয়ন-কেরানী বা ড্রাইভারদের দুর্নীতি এখন সবার মুখে মুখে, তারাও দুর্নীতির মাধ্যমে অনেক বিত্তশালী। দুদুকের কিছু কিছু দুর্নীতিবিরোধী কর্মকাণ্ডে দেখা যায় যে, সরকারি কর্মচারীদের একটি বড় অংশ কীভাবে দুর্নীতির মাধ্যমে দেশটাকে গ্রাস করছে। এই দুর্নীতিই আমাদের দেশের সন্তানদের আশা-ভরসা ও ভবিষ্যৎ ধ্বংস করতে বসেছে। বাংলাদেশের মানুষ দেশটাকে দুর্নীতিমুক্ত হিসেবে দেখতে চায়। সরকার এখনই যদি শক্ত হাতে দুর্নীতি রোধ করার চেষ্টা না করেন, তাহলে লাল ফিতা বা আমলাতান্ত্রিকতার দৌরাত্ম্য এমন পর্যায়ে চলে যাবে, তখন রশি টেনেও কোনো লাভ হবে না। শক্তি থাকা সত্ত্বেও দুর্নীতি যেভাবে দেশটাকে বোধশক্তিহীন করে ফেলছে এর বিরুদ্ধে কথা বলাও এখন বিপদ। তবে দুদককে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। যে কোনো তদন্ত রিপোর্ট কোনোভাবেই হিমাঘারে ফেলে রাখা যাবে না। এমতাবস্থায়, দুর্নীতি কমানোর জন্য সরকারি কর্মচারীদের ওপর নজরদারী বাড়াতে হবে। সময় সময় তাদের সম্পদের হিসাব নেওয়া ছাড়াও তার ও তাদের পরিবারের ব্যাংক ব্যালেন্স সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে হবে। অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার ব্যাপারে স্থানীয় চেয়ারম্যান মেম্বার ও স্থানীয় লোকজনদের সচেতন থাকতে হবে। দুর্নীতিবাজের সমাজ থেকে বয়কট করতে হবে। সরকারি কর্মচারীদের এসিআরগুলো নিয়মিত হালনাগাত করতে হবে। এরই মধ্যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আইএমএফ বলেছেন, দেশে ব্যবসায়িক পরিবেশের উন্নতির ক্ষেত্রে সুশাসনের উন্নয়ন এবং দুর্নীতি রোধে ব্যাপক অবদান রাখবে বলে মতপ্রকাশ করে। তারা আর্থিক খাতে নিয়ন্ত্রণ কাঠামো জোরদার ও সুশাসন নিশ্চিতে সংস্কার কার্যক্রম আরও ত্বরান্বিত করার সুপারিশ করে।

বলে রাখা ভালো, সরকারের সব সেক্টরে ক্ষমতা অপব্যবহার করে দুর্নীতির পৃষ্ঠপোষকতা করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে সরকারকে বিব্রত করা হয়ে থাকে। সম্পদের পরিমাণ নিয়মিত হালনাগাদের জন্য একটি মানসম্মত পন্থা অবলম্বন করে সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পদ ঘোষণার প্রক্রিয়াকে আধুনিক ও শক্তিশালী করা যেতে পারে। সরকারের প্রকল্প ও রাজস্বের অর্থের এক বিরাট অংশ ব্যাপকভাবে দুর্নীতি হয় যা দেখার কেউ নেই। এ ক্ষেত্রে সরকারের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর আরো বড় দুর্নীতির প্রতিষ্ঠান। তাদের রিপোর্ট সঠিকভাবে উপস্থাপন করা হয় না। মনে রাখা ভালো, দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের প্রসার ঘটিয়ে দেশের অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। দুর্নীতির অভিযোগে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বদলি, সাময়িক বরখাস্ত, বাধ্যতামূলক অবসরসহ কোনো বিভাগীয় ব্যবস্থা যথেষ্ট নয় বরং অপরাধীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে। সরকারের উদারতার জন্য সরকারি কর্মচারী ও পুলিশ, শিক্ষা, ভূমি, স্বাস্থ্য, জ্বালানি, গৃহায়ণ, রেলপথ ইত্যাদি মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি ও লুটপাট অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারি লোকজনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে শুধু দেশের জনগণ নয়, গণমাধ্যকেও এক বিরাট চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। দুর্নীতিকে কোনোভাবেই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া ঠিক হবে না। একটা দেশ এভাবে চলতে পারে না। দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি যে কোনো দলের বা সংস্থার হোক না কেন, তাদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়ন করতে হবে। যে কোনো উপায়ে সংশ্লিষ্ট অফিস প্রধানকে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কাছে থেকে তাদের সম্পদের হিসাব বিবরণী আইন অনুযায়ী সংরক্ষরণ বাধ্যতামূলক জরুরি হয়ে পরেছে। তবে যে কোনো উপায়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একই অফিসে ৩ বছরের বেশি অবস্থান করার সুযোগই হচ্ছে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়া। দুর্নীতির পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ খুবই উদ্বিগ্ন। আশা করি, সরকার ও রাষ্ট্র দেশ ও জাতির স্বার্থে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হতে দুর্নীতির উইপোকা দূর করার জন্য কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন- এটাই আশা করছি।