স্টারমারের কাঁধে পাহাড় সমান দায়িত্ব

অলোক আচার্য, প্রাবন্ধিক ও কলামিষ্ট

প্রকাশ : ০৮ জুলাই ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বিশ্বজুড়েই রাজনৈতিক অঙ্গনে পরিবর্তন হচ্ছে। ফ্রান্সে পরিবর্তন হয়েছে। ইংল্যান্ডে ক্ষমতা গেছে লেবার পার্টির দখলে। ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয় পেয়েছে সংস্কারপন্থি। আগাম নির্বাচন ঘোষণার পর থেকেই সুরটা কনজারভেটিভ পার্টির বিপরীতে। বিভিন্ন জরিপ বলছিল কনজারভেটিভ দলের শোচনীয় পরাজয় হতে যাচ্ছে। সুনাক যত আস্থা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন শেষ পর্যন্ত সেই পরিস্থিতি ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন। প্রায় দেড় দশক পর নির্বাচনে জিতে ইংল্যান্ডে ক্ষমতায় এল লেবার পার্টি। দলটির বিভিন্ন সিদ্ধান্ত সমালোচিত হয়েছে। চার নির্বাচনে হার মানার পর কিয়ার স্টারমারের নেতৃত্বে দলটি দীর্ঘ ১৪ বছর পর ক্ষমতায় ফিরে এসেছে কিয়ের স্টারমার। ৪ বছর আগে কট্টর বামপন্থি রাজনীতিবিদ জেরেমি করবিনের জায়গায় লেবার পার্টির নেতৃত্বে আসেন স্যার কিয়ের স্টারমার। ১৯৬২ সালে লন্ডনের অক্সটেডে স্টারমারের জন্ম। ৬১ বছর বয়সি এই রাজনীতিক রাজনীতিতে আসার আগে ছিলেন একজন মানবাধিকার আইনজীবী। তিনি পাবলিক প্রসিকিউশনের ডিরেক্টর এবং ক্রাউন প্রসিকিউশন সার্ভিসের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৫ সালে স্টারমার প্রথমবার সংসদে যান। লন্ডনের হবর্ন অ্যান্ড সেন্ট প্যানক্রাসের সংসদ সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। কট্টর বাম রাজনীতিবিদ জেরেমি করবিনের নেতৃত্বে লেবার পার্টি তখন বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করছে। অভিবাসনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সরকারের কার্যকলাপ নজরে রাখার জন্য স্টারমারকে ‘শ্যাডো হোম সেক্রেটারি’ (ছায়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছিল। যার অর্থ স্টারমার ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের সবচেয়ে সিনিয়র প্রসিকিউটর সরকারি কৌঁসুলি ছিলেন। ২০১৪ সালে তাকে নাইট উপাধি দেওয়া হয়েছিল। মূল ধারার রাজনীতিতে আসার আগে স্টারমার ছিলেন পুরোদস্তুর মানবাধিকার আইনজীবী। যুক্তরাজ্যের পাবলিক প্রসিকিউশন দপ্তরের পরিচালকের পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০২০ সালে জেরেমি করবিনের হাত থেকে লেবার পার্টির দায়িত্ব নেন। যদিও ২০১৫ সালে তিনি নির্বাচিত সংসদ সদস্য। ৬১ বছর বয়সি স্টারমারের জন্ম লন্ডনে। বাবা ছিলেন মেকানিক আর মা সেবিকা। পড়াশোনা করেছেন রিগেট গ্রামার স্কুল, লিডস ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিয়ে করেছেন অকুপেশনাল থেরাপিস্ট ভিক্টোরিয়া স্টারমার- তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে সংসার। অর্জিত হয়েছে ২০০ বছরের মধ্যে লেবার পার্টির সবচেয়ে বড় বিজয়। ৬৫০ আসনের ব্রিটিশ পার্লামেন্টে লেবার পার্টি জিতেছে ৪১২ আসনে। কনজারভেটিভ পার্টি পেয়েছে ১২১ আসন। এই বিজয়কে বলা হচ্ছে ভূমিধস জয়। তবে ভূমিধস জয় পেলেও সামনে রয়েছে পাহাড় সমান চ্যালেঞ্জও। ইউরোপজুড়ে যখন ডান এবং কট্টর জাতীয়তাবাদীদের উত্থান চলছে, তখন ব্রিটেনে লেবার পার্টির জয় উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে বিশ্বসমাজের অবস্থানকে কিছুটা হলেও উৎসাহিত করবে। কনজারভেটিভদের লিজ ট্রাস, জেকব রিস-মগ, পেনি মর্ডান্ট এবং গ্রান্ট শ্যাপসের মতো বেশ কয়েকজন জনপ্রিয় নেতা তাদের আসন হারিয়েছেন। কনজারভেটিভ দলের জন্য একমাত্র সুসংবাদ হলো লেবার পার্টির ভূমিধস বিজয়ের পরেও তাদের ভোটারের সংখ্যা ২০১৯ সালের নির্বাচনের চেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়েনি। তবে কনজারভেটিভ দলের পরাজয়ের পেছনের কারণ বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে। দলের অভ্যন্তরীণ বিশ্লেষণও হয়েছে এবং বিশ্লেষকরাও বিষয়টি নিয়ে ভেবে দেখেছেন। নির্বাচনে রক্ষণশীলদের ভরাডুবির কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে ব্রিটিশ অর্থনীতির টালমাটাল অবস্থাকে। বিষয়টিকে কিয়ার স্টারমারের লেবার পার্টি সরকারের জন্যও সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বড় ধরনের সংস্কার ছাড়া দ্রুত এ চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ঘটনাটা যেন হঠাৎ করেই। আবার হঠাৎ করেই আগাম দেশটিতে আগাম নির্বাচনের ঘোষণাটাও যেন বিশ্ব রাজনীতিবিদদের একটু অবাকই করে। দেশটিতে ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও দিন এগিয়ে এ বছরের ৪ জুলাই নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন। ঋষি সুনাকের দল কনজারভেটিভ পার্টি গত ১৪ বছর ধরে দেশটির ক্ষমতায় থেকে অবশেষে বিদায় নিয়েছে। যখন দলটি হেরে গেল তখন দলের জনসমর্থনের অবস্থা তথবৈচ। সুনাক আগাম নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে নিজের সরকারের বিভিন্ন অর্জনের কথা তুলে ধরেন। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ব্যাপক জয় পেয়েছে সংসদে বিরোধী দলে থাকা লেবার পার্টি। দলটির নেতা স্যার কিয়ার স্টারমারও আগাম জাতীয় নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। কনজারভেটিভ পার্টির ১৪ বছরের শাসন বিশেষ করে শেষ দিকে কঠিন অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছে যুক্তরাজ্য। সাম্প্রতিক সময়ে আয়ে স্থবিরতা, জীবনযাত্রার মানে পতন ও ব্যবসায়িক বিনিয়োগ কমে যাওয়ার মতো বিষয়গুলো পরিস্থিতিকে আরো কঠিন করে তোলে। লেবার পার্টির সামনেও ব্যাপক চ্যালেঞ্জ। তাদের রয়েছে উচ্চাবিলাসী পরিকল্পনা। লেবার পার্টির উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে ৭৩০ কোটি পাউন্ড বা ৯৩০ কোটি ডলারের ন্যাশনাল ওয়েলথ ফান্ডে বিনিয়োগ। বিস্তৃত শিল্পকৌশল হিসেবে এর আওতায় রয়েছে অবকাঠামো নির্মাণ ও গ্রিন এনার্জি ট্রানজিশন। নতুন সরকারি কোম্পানি গ্রেট ব্রিটিশ এনার্জি নিয়ে সরকারের রয়েছে বড় পরিকল্পনা। এর মধ্যে ২০৩০ সালের মধ্যে যুক্তরাজ্যের এনার্জি গ্রিডকে ডিকার্বনাইজ করার লক্ষ্য তাদের। এতে বিনিয়োগ হবে ৮৩০ কোটি পাউন্ড বা ১ হাজার ৬০ কোটি ডলার। এ অর্থের কিছু অংশ আসবে জ্বালানি কোম্পানিগুলো থেকে পাওয়া উইন্ডফল ট্যাক্সের মাধ্যমে। তবে এসব বাস্তবায়ন করা যে বেশ কষ্টসাধ্য হবে সে কথা নতুন কিছু না। বিজয়ী দলটির নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছে-ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করার পাশাপাশি নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে জোর দেবে তারা। চিকিৎসকদের সংখ্যা ও নার্সদের বেতন বাড়ানো হবে।

প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়ানোর পাশাপাশি রুয়ান্ডা পরিকল্পনা বাতিল করা হবে যা অত্যন্ত সমালোচিত হয়েছিল। ২০৪৫ সালের মধ্যে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানো ও প্রতিটি স্কুলে পেশাদার মানসিক চিকিৎসক যুক্ত করা হবে। যাই হোক দেশটির ক্ষমতায় এখন লেবার পার্টি। যে দলটি দীর্ঘ ১৪ বছর পর ক্ষমতায় এসেছে। জনগণের আস্থা নিয়েই তারা ক্ষমতায় এসেছে। কনজারভেটিভ পার্টি যেখানে যেখানে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন দিতে ব্যর্থ হয়েছে সেখানে তাদের সফল হতে হবে। নতুন প্রধানমন্ত্রীও সেটি ভালোভাবেই জানেন। তিনি তার এক ভাষণে বলেছেন, একটি একটি করে ইটের মতো’ করে তিনি দেশকে গড়ে তুলবেন। কিন্তু পরে বলেছেন, এ জন্য সময় প্রয়োজন। বিষয়টি কঠিন চ্যালেঞ্জেরও বটে। তার কথায়, একটি দেশ পরিবর্তন করা শুধু একটি সুইচ অফ-অন করার মতো বিষয় নয়... বিশ্ব এখন আরও অস্থির। এতে কিছুটা সময় লাগবে... তবে সন্দেহ নেই পরিবর্তনের কাজ অবিলম্বেই শুরু হবে। সংবাদমাধ্যম মিরর জানিয়েছে, স্টারমার বড় ধরনের ১১টি পরিবর্তন আনার চ্যালেঞ্জ নেবেন।

এর মধ্যে প্রথমেই রয়েছে স্বাস্থ্য খাত। এ খাতে তিনি ৪০ হাজারের বেশি স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দেবেন। এরপরই তার নজর রয়েছে শিক্ষাব্যবস্থা, এই খাতেও নতুন লোকবল নিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন নতুন প্রধানমন্ত্রী। তিন নম্বর প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে আবাসন খাত। স্টারমারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, আইনে ব্যাপক পরিবর্তন এনে নতুন প্রকল্প তৈরি করা হবে। সামাজিক পরিষেবা চাঙা করতে তিনি নতুন ন্যাশনাল কেয়ার সার্ভিস স্থাপনের কথা বলেছেন। এরপর যেসব খাতে তিনি সংস্কার আনার কথা বলেছেন, তার মধ্যে রয়েছে শ্রম, কর ও অবসর ভাতা, শ্রমিকদের সুরক্ষা, ছুরি হামলা ঠেকাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া। নিজে এক সময় ফুটবলার ছিলেন, হয়তো এ কারণে ব্রিটেনের ফুটবলের দিকে তিনি বিশেষ নজর দেবেন। এ ছাড়া আলোচিত পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে এক বছরের মধ্যে ডিজেলচালিত নতুন গাড়ি নিষিদ্ধ করবেন, পরিবেশ ও সৌরশক্তির দিকে বিশেষ গুরুত্ব ও অভিবাসী নিয়ন্ত্রণে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। এতকিছু দেখে অনুমান করতে কষ্ট হয় না, যে স্টারমারের কাঁধে এখন বিশাল দায়িত্ব।