ছাড় দেয়া যাবে না দুর্নীতিবাজদের

মূলোৎপাটন করতে হবে

প্রকাশ : ০৯ জুলাই ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দুর্নীতি সম্পর্কে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছিলেন, ‘কোনো অফিস-আদালতে দুর্নীতি হলে এবং আপনাদের কাছে কেউ ঘুষ চাইলে সঙ্গে সঙ্গে তিন পয়সার একটি পোস্টকার্ডে লিখে আমাকে জানাবেন। আমি দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করব, যাতে দুর্নীতি চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়।’ সরকারি প্রতিষ্ঠান কিংবা সেবা খাতগুলোর মধ্যে অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে চিহ্নিত স্বাস্থ্য খাত। গত করোনা দুর্যোগে এর উৎকট রূপ দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। এর পূর্বাপর এই খাতে কদাচার-দুরাচার-অনাচারের যেসব চিত্র উঠে এসেছে, তাতে সংগত কারণেই প্রশ্ন দাঁড়ায়, দুর্নীতিবাজদের বেপরোয়া হয়ে ওঠার উৎস কী? গণপরিবহনের অন্যতম জন-আকর্ষিত রেল খাতের চিত্রও প্রায় একইরকম। ব্যতিক্রম নয়, শিক্ষা খাতও। অর্থাৎ প্রতিটি খাতেই কম-বেশি দুর্নীতিবাজদের আস্ফালন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যে রাজনীতি জনকল্যাণ নিশ্চিত করার অন্যতম মুখ্য মাধ্যম সেই রাজনীতিও দুর্নীতির রাহুগ্রাসমুক্ত নয়। আমরা দেখেছি, এরই মধ্যে দুর্নীতির দায়ে অনেক রাজনীতিকই দণ্ডিত হয়েছেন কিংবা আরো অনেকের বিরুদ্ধেই মামলা চলমান রয়েছে। বিষয়টি যেন হয়ে দাঁড়িয়েছে এ রকম যে, ‘সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দেব কোথা’।

আর্থিক খাতের দিকে দৃষ্টি দিলেও একইরকম পরিস্থিতি দেখা যায়। আমরা জানি, সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে আর্থিক খাতে কেলেঙ্কারির যেসব চিত্র উঠে এসেছে, তা খণ্ডিত চিত্র হলেও অখণ্ড চিত্রও প্রীতিকর নয়। দুর্নীতি দমনের লক্ষ্যে দেশে প্রতিষ্ঠিত দুর্নীতি দমন কমিশনের কার্যক্রমে দৃশ্যত তোড়জোড় পরিলক্ষিত হলেও আখেরে এর ফল কতটা মিলছে প্রশ্ন আছে এ নিয়েও। আমাদের এটাও স্মরণে আছে, দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক একজন চেয়ারম্যান খেদোক্তি করে বলেছিলেন, ‘দুর্নীতি দমন কমিশন নখণ্ডদন্তহীন বাঘ’। তার বক্তব্য আমরা আমলে নিলে সংগতই এ প্রশ্নও দাঁড়ায়, অবস্থা যদি তাই হয় তাহলে দুর্নীতি দমনে সরকারের অঙ্গীকারে কার্যত কতটা সুফল মিলবে। নিকট অতীতে এই সম্পাদকীয় স্তম্ভেই আমরা বলেছি, দুর্নীতি নির্মূলে সর্বাগ্রে রাজনীতিকদের ঐকমত্যের বিকল্প নেই। রাজনীতিকরা যদি জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকেন, জবাবদিহি করেন এবং তাদের কার্যক্রম স্বচ্ছ হয় তাহলে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে দুর্নীতি হ্রাস পেতে বাধ্য। দুর্নীতি যে রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য ভয়াবহ ব্যাধিসম- এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নতুন করে প্রয়োজন পড়ে না। আমরা এই প্রেক্ষাপটে অস্ট্রিয়ান লেখক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এবং সাংবাদিক কার্ল ক্রাউসকে স্মরণ করি। তিনি বলেছিলেন, ‘দুর্নীতি উন্নয়ন ও সুশাসনের শত্রু। এর নাগপাশ থেকে রাষ্ট্র ও সমাজকে মুক্ত করতেই হবে। আর এজন্য সরকার এবং জনগণ এই উভয়পক্ষকেই যূথবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।’

আমাদের মনে পড়ছে খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিনের কথাও। তিনি বলেছিলেন, ‘চারিদিকে রুচির দুর্ভিক্ষ! একটা স্বাধীন দেশে সুচিন্তা আর সুরুচির দুর্ভিক্ষ! এই দুর্ভিক্ষের কোনো ছবি হয় না।’ দূরদর্শী কালজয়ী প্রয়াত এই চিত্রশিল্পীর মন্তব্য কতটা যথার্থ এরও সাক্ষ্য মিলছে অহরহ। দুর্নীতি নির্মূলে সরকারের যেখানে ‘শূন্য সহিষ্ণুতা’র অঙ্গীকার রয়েছে সেখানে সংবাদমাধ্যমে প্রায় নিত্য অনিয়ম-দুর্নীতির যে চিত্র উঠে আসছে তা বিস্ময়কর যুগপৎ প্রশ্নবোধক। দুর্নীতির কারণেই অর্থ পাচার হচ্ছে, আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে রক্ষকরা ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার বার্তাও উঠে আসছে। এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন দাঁড়ায়, তাহলে দুর্নীতির রাস টেনে ধরা কীভাবে সম্ভব? আমরা মনে করি, দুর্নীতি রোধে এবং মানবাধিকারের সুরক্ষায় জনমত আমলে নেওয়া প্রয়োজন। দুর্নীতিবাজরা নিরুৎসাহিত হন- এমন কঠোর বিধিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। নিঃসন্দেহে দুর্নীতি রাষ্ট্রের অন্যতম সংকট। এর প্রতিবিধান অবশ্যই দৃষ্টান্তযোগ্য করতে হবে এবং দুষ্টচক্রের মূলোৎপাটনে কোনো রকম উদাসীনতার সুযোগ নেই। দুর্নীতির মূলোৎপাটন করতে হবে একেবারে গভীর থেকে অর্থাৎ নজর দিতে হবে উৎসে।