অভিযোগের দায় পিএসসি এড়াতে পারে না
পিএসসিকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে
প্রকাশ : ১১ জুলাই ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
বিভিন্ন কোটা পদ্ধতির কারণে সরকারি চাকরিতে সাধারণ মেধাবীদের নিয়োগের সুযোগ অত্যন্ত সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। প্রায় ৫৬ ভাগ কোটাভিত্তিক নিয়োগ প্রক্রিয়ার পর যে সুযোগ থাকে, তার বেশিরভাগেরই নিয়ন্ত্রণ থাকে প্রশাসনের একশ্রেণির দুর্নীতিবাজদের হাতে। বছরের পর বছর ধরে বঞ্চনার শিকার হয়ে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা যখন কোটা প্রথা বাতিলের দাবিতে রাজপথে নেমে এসেছে, ঠিক তখন বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে জড়িত কতিপয় ব্যক্তির সীমাহীন দুর্নীতির খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া চক্রের সাথে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যানসহ সরকারের প্রভাবশালী আমলাদের জড়িত থাকা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানের সাবেক এক গাড়িচালকের কোটি কোটি টাকার সম্পদের উৎস খুঁজতে গিয়ে প্রাথমিকভাবে বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনার সাথে তার সম্পৃক্ততার তথ্য বেরিয়ে এসেছে। বিসিএস পরীক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ সরকারি নিয়োগ পরীক্ষায় দুর্নীতির সাথে চেয়ারম্যানের একজন গাড়িচালকের সম্পৃক্ততা চেয়ারম্যানের দিকেও সন্দেহের তীর থাকা অস্বাভাবিক নয়। গত ৫ জুলাই অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী নিয়োগ পরীক্ষার আগে পিএসসির উপ-পরিচালক আবু জাফর ও জাহাঙ্গির আলম ২ কোটি টাকার বিনিময়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে টাকার বিনিময়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার যে অভিযোগ উঠেছে, তার দায় পিএসসি এড়াতে পারে না।
দশকের পর দশক ধরে সরকারি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি, অসাধুতা, জালিয়াতি চললেও এ নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্টদের কোনো বিচলন দেখা যায়নি। কোটার বাইরে সাধারণ মেধাবীদের সরকারি চাকরিতে প্রবেশের যেটুকু সুযোগ অবশিষ্ট আছে, প্রশ্নপত্র ফাঁস ও নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতিম স্বজনপ্রীতি, রাজনৈতিক পক্ষপাতের মধ্য দিয়ে তাও রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু ধারায় প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে মেধাবিদের স্থান দেয়ার পথ রুদ্ধ করে সংরক্ষিত কোটা, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে যাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে, তাদের বেশিরভাগই দুর্নীতিবাজ, অসৎ এবং অযোগ্য হিসেবে এখন প্রমাণিত হচ্ছে। গণমাধ্যমে রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর পিএসসি চেয়ারম্যানের সাবেক ড্রাইভারসহ ইতিমধ্যে যে ১৭ জনকে আটক করা হয়েছে, তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়াও একইভাবে হয় দুর্নীতির মাধ্যমে কিংবা প্রশ্নপত্র ফাঁসের লেনদেনের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়েছিল কি না, তা এখন খতিয়ে দেখা জরুরি। এদের নিয়োগের পেছনে কারা সেটাও খুঁজে বের করা প্রয়োজন। শুধু এদের গ্রেফতার করে এদের পেছনের কুশীলবরা পার পেয়ে যাবে, তা হতে পারে না। বিসিএস বা সরকারি কর্মকমিশনের দায়িত্ব ও লক্ষ্য হচ্ছে, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে মেধাবী ও যোগ্য প্রার্থীকে নিয়োগ দেয়া। দেখা যাচ্ছে, এখানেই বড় ধরনের দুর্নীতি হচ্ছে। ইতোমধ্যে কমিশনের দুর্নীতির মাধ্যমে যারা নিয়োগ পেয়েছে, তাদের অনেকেরই দুর্নীতিতে জড়িয়ে থাকা অস্বাভাবিক নয়। সরকারি কর্মকমিশন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও শিক্ষক নিয়োগ পর্যন্ত সর্বত্র অনিয়ম-দুর্নীতি, দলবাজি ও স্বজনপ্রীতির মাশুল দিতে হচ্ছে পুরো জাতিকে।
শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা কোটা বাতিলের যে আন্দোলন করছে, বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং এর সাথে জড়িত দুর্নীতিবাজদের তথ্য বেরিয়ে আসার মধ্য দিয়ে এ আন্দোলনের যৌক্তিকতা প্রমাণিত হয়েছে।
বলা বাহুল্য, কোটা প্রথা ও দুর্নীতির মাধ্যমে যারা প্রশাসনে রয়েছে, তাদের বেশিরভাগই কোনো না কোনোভাবে দুর্নীতির আশ্রয় ও প্রশ্রয়দাতা। কিছু কর্মকর্তার দুর্নীতির খবরকে পর্যবেক্ষকরা ‘টিপস অব আইসবার্গ’ বা হিমশৈলীর চূড়া হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এদের বাইরেও আরো অনেক দুর্নীতিবাজ রয়েছে। দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া অযোগ্য ব্যক্তিদের মাধ্যমে দক্ষ প্রশাসন ও আমলাতন্ত্র গড়ে তোলা সম্ভব নয়। একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের অনুসন্ধানি প্রতিবেদনে বিগত ৩০টি বিসিএস পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের চাঞ্চল্যকর তথ্য ও শত শত কোটি টাকা লেনদেনের খবর প্রকাশ কললেও এতদিন ধরে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কি করেছে? এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর নিস্ক্রিয়তার পেছনে তাদের যোগসাজশ ও ভাগ-বাটোয়ারার সম্পর্ক ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে।
কোটা ও দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি অফিস-আদালতে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়ে অনেকে বেপরোয়া দুর্নীতি, লুটপাট ও দেশের স্বার্থবিরোধী অপকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে হাসপাতালের পর্দা, আবাসিক ভবনের বালিশ ক্রয়ে অবিশ্বাস্য দুর্নীতি এদের মধ্য থেকেই হয়েছে। দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তারা এভাবেই রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের অপূরণীয় ক্ষতি করে চলেছে। প্রশাসনে এখন শুদ্ধি অভিযান জোরদার করা প্রয়োজন। বিসিএসে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রকৃত মেধাবীরা যাতে সুযোগ পায়, এজন্য পিএসসিকে ঢেলে সাজাতে হবে। সৎ, দক্ষ, মেধাবীদের এখানে নিয়োগ দিতে হবে। পুরো প্রতিষ্ঠানটিকে স্বচ্ছ করতে হবে। নিয়োগ বাণিজ্য, প্রশ্নফাঁস ও স্বজনপ্রীতির পথ চিরতরে বন্ধ করার কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ধরনের কর্মের সাথে জড়িত সবার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।