ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

অধার্মিকরাও ধার্মিক সেজেছে!

রাজু আহমেদ
অধার্মিকরাও ধার্মিক সেজেছে!

খোদ বায়তুল মোকারমের খতিব সাহেবের ততগুলো সেজদার ছবি গণমাধ্যমে জাতির দেখার সৌভাগ্য হয়নি যতগুলো সেজদার ছবি ড্রাইভার সৈয়দ আবেদ আলী দিয়েছেন। গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে, প্লেনে, সমুদ্র সৈকতের বালুর বেলাভূমিতে কিংবা হাঁটতে হাঁটতে- ডজন খানেক সেজদার ছবি ভাইরাল হয়েছে। এসব দেখতে দেখতে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর বহুল আলোচিত লালসালু উপন্যাসের পরিচিত মুখ মজিদের চরিত্রই মানসপটে ভেসে উঠছে। প্রশ্নপ্রত্র ফাঁস করে যত টাকা পেয়েছেন তা সবই আল্লাহর রাস্তায় দান করে দিয়েছেন! ভণ্ড মজিদও বোধহয় এতবড় ভণ্ডামীপূর্ণ কথা বলেননি। ঘৃণ্যতর অপরাধ করেও সহজ সরল স্বীকারোক্তিতে ধর্মের আশ্রয় পাওয়ার কী জঘন্য চেষ্টা। ছাগলকাণ্ডের হোতাও নাকি তার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের গ্রুপে রোজ রোজ কোরআন-হাদিসের উদ্ধৃতি ছড়িয়ে দিয়ে ন্যায়নীতির কথা শোনাতেন। আবার কেউ কেউ অধীনদের শুদ্ধাচার-সততার বয়ান দিয়ে দিয়ে লুটপাট-লোপাটের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছে। শস্যের চেয়ে চুরি বেশি, ধর্মের আগাছা বেশি- সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর এই উক্তির যে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বাল্যকালে পড়েছিলাম তা আজ হাতে-কলমে দেখছি। হুমায়ুন আজাদ বলেছেন, সমাজে দুর্নীতি বেড়ে গেলে ধর্মচর্চা বেড়ে যায়। অতীত ও বর্তমানের দুর্নীতিবাজদের ক্ষেত্রে এ উক্তি অনেকাংশেই সত্য হিসেবে ধরা দিয়েছে। অফিসের ঘুষখোর কর্মকর্তার মুখে লম্বা দাড়ি। অবৈধতার ভিত্তিমূলে দাঁড়িয়ে সততা ও সাধুতার নসিহত। অন্যায়-জুলুম করে আবার সিজদাতে কপালে দাগ ফেলে দেওয়া- দুর্নীতিবাজরা এই পথে কেন হাঁটে? এর অনেকগুলো কারণ হতে পারে। প্রথমত : চোর জানে সে চোর কিন্তু অন্য কেউ যাতে বুঝতে না পারে, চোর সেজন্য আলাদা খোলস গ্রহণ করে যাতে মানুষ তাকে মুনসি মনে করে। লেবাসধারী শয়তানের এ তরিকা অনেকটাই সফল! দ্বিতীয়ত : অপরাধ করতে করতে অপরাধীর মনে ভয়ের সঞ্চার হয়। সেজন্য দুর্নীতিবাজ অপরাধ এবং ধর্মকর্ম সমান্তরালে করে। নয়তো ঘুষ-দুর্নীতি করে কিছু টাকা কামিয়ে সেখান থেকে আট-দশ লাখ খরচ করে হজ করা, লাখ লাখ টাকা দান-সদকা করার কোনো যৌক্তিক ভিত্তি নেই। যখন দুর্নীতিবাজ ভাবে দান-সদকা তাকে মুক্তি দেবে তখন সে দ্বিতীয়বার বোকামি করে! সে আল্লাহকে বলে, আমি তোমার রাস্তায় অনেক কিছু দান করলাম! আল্লাহ বলে, তোমার দান থেকে কিছুই গ্রহণ করা হলো না! দোযখ বলে এসো, আমাদের দেখা হবে। পরের হক মেরে স্বর্গ প্রতিষ্ঠা করলেও সুখ মিলবে না এবং কোনো তওবাতে পাপ কাটা যাবে না যতদিন যারা অধিকার হারা হয়েছে তারা ক্ষমা না করবে। ভণ্ডদের এই যে সাধুত্ব-দরবেশের মুখোশ এতে সাধারণ, সহজ-সরল মানুষ বিব্রত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যারা প্রকৃতপক্ষেই ধার্মিক তাদের দিকেও সন্দেহের আঙুল ওঠে। কেননা সহজাতভাবেই সরল মানুষের ধর্মপ্রাণ লোকদের জন্য কোমল অনুভূতি থাকে। ভণ্ড-ভাঁওতাবাজরা তাদের আসল চরিত্রের আড়ালে সেই সফেদ মুখোশ জড়িয়ে রাষ্ট্রীয় অর্থ তছরুপ করে। মানুষকে জিম্মি করে অর্থ আদায় করে, সরকারি ও দরকারি সেবার চড়া বিনিময়মূল্য নির্ধারণ করে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিরীহ জনতাকে শোষণ করে এবং ন্যায্য অধিকারহারা করে। বাইরের জগতে জামাতে নামাজ আদায়ের বাহানা দেখায়, জোরকদমে এগিয়ে গিয়ে দান-দক্ষিণা করে এবং লোক দেখানো সেজদায় মস্তক অবনত করে। মনের মধ্যে থাকে অবৈধভাবে শতকোটি টাকা কামাইয়ের বাসনা, গাড়ি-বাড়ির নেশা এবং নারীর প্রেষণা। অন্যায় করতে করতে মানুষ অন্ধ হয়ে যায়। তখন সে যোগ্যদের স্বপ্ন খুন করে, প্রাপ্যকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করে এবং প্রকৃতির থেকে কেড়ে লয়। মনে মনে মজিদ সেজে থাকাদের অল্প গল্পই লোকালয়ে বের হয়। ড্রাইভার সৈয়দ আবেদ আলীতে চাপা পড়ে তার মালিক। কিংবা যারা মতিউরদের মালিক বানাল সেই বাহনদের অনেকেই গল্পের চিত্রায়নের বাইরে থেকে যায়। নির্ধারিত বেতনে চাকরি করে যারা অতিরিক্ত ফুটানি করে, কর্মকালেই আলিশান বাড়ি কিংবা সম্পদের মালিক হয়ে যায় এবং প্রস্থান-আগমনের এলাকায় সীমাহীন প্রতাপ ছড়ায়- তাদের ক’জনের বিরুদ্ধে আগাম ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? ক্ষতিয়ে দেখা হয়েছে সম্পদের উৎস? ঈদ-কোরবানিতে, কালে-ভদ্রে দু’চারজন নগ্ন হলেই দেশজুড়ে সোরগোল হয় অথচ কত কত মজিদ সমাজ-সংসার লুটেপুটে খাচ্ছে, দেশের বারোটা বাজাচ্ছে তাদের নিয়ে তদন্ত পর্যন্ত হয় না। কোনো দপ্তরের শরীর পঁচে গেলে সে দপ্তরের মাথাও ভালো নেই। আর মাথায় যদি ব্যধি হয় সেটা শেকড় পর্যন্ত পৌঁছায়। হলফ করে বলতে পারি, ধর্মীয় আদেশে এই দেশে যারা হঠাৎ দাঁড়ি রেখেছে, ধর্ম-কর্ম শুরু করেছে তাদের খুব অংশই ধর্মকে ভালোবেসে এসব করছে। বরং বেশিরভাগ তার মূল চরিত্র আড়াল করতে ধর্মকে ব্যবহার করছে। জগতের সব পাপ করতে করতে এরা উপাসনালয়ের দিকে যায়। ঘুষের টাকা পকেটে রেখে, দুর্নীতির অর্থে খাবার খেয়ে অনেকেই লোক দেখাতে সিজদা করে। মসজিদণ্ডমাহফিলের সভাপতি হয়। সমাজ তাদের দানবীর বলে। অথচ আয়ের উৎসের কথা কেউ জিজ্ঞাসা করে না। দুর্নীতিবাজদের যা অপরাধ তারচেয়ে কম দায় আমাদের নয়। কোনো স্ত্রী তার স্বামীকে জিজ্ঞেস করে, তোমার এতো অর্থ-সম্পদের উৎস কী? সৈয়দ আবেদ আলীদের সন্তানরা একবারও তার বাবাকে জিজ্ঞেস করেছে, বাবা, ড্রাইভারি করে এতো গাড়ি-বাড়ি কেমনে জুটিয়েছে? অথচ বাবার অবৈধ টাকায় সন্তান মানবতার ফেরিওয়ালা হয়েছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত