স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে শিক্ষিত বেকারদের সম্পৃক্ত করুন

অ্যাডভোকেট মো. রায়হান আলী

প্রকাশ : ১৩ জুলাই ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশ গঠন বর্তমান সময়ের একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এদেশের মানুষের তাজা রক্তের বিনিময়ে অর্জিত একখণ্ড স্বাধীন মানচিত্র। এদেশের মানুষের মুক্তির দিশারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হৃদয়ে আঁকা ছোট্ট একটি নাম বাংলাদেশ। ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ৬ষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত আলোচনা সভায় বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন, ‘আমাদের স্বাধীন দেশটির নাম হবে বাংলাদেশ’। এই একটি উচ্চারণ বাঙালিদের হৃদয়ে গাঁথা হয়ে গিয়েছিল। সেদিনই এদেশের মানুষ আরো দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে এদেশ স্বাধীনতার জন্য আরো প্রাণন্তর প্রচেষ্টায় সামিল হতে থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাস এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে প্রায় ৩০ লাখ শহীদ ও ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জ্বতের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন দেশ ও পতাকা। বঙ্গবন্ধুর গড়া এই স্বাধীন দেশটির মানুষের সুখ-দুঃখের সাথী হয়ে এদেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যার ধ্যান-ধারণা এদেশের মানুষের কল্যাণ। এদেশের মানুষের কল্যাণার্থে নানান প্রকার উন্নয়নমুখী কাজের পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন বর্তমান সরকার।

এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় বলেছিলেন, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশের পরবর্তী স্বপ্ন ‘ক্যাশলেস সোসাইটি’। আগামী দিনে বাংলাদেশের সব ফিন্যানশিয়াল ট্রানজেকশন ক্যাশলেস হয়ে যাবে, নগদ অর্থে লেনদেন হবে না।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলেছেন, তার সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে ডিজিটাল থেকে ‘স্মার্ট বাংলাদেশে’ রূপান্তরে কাজ করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা আগামী ৪১ সালে বাংলাদেশকে উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তুলব। আর সেই বাংলাদেশ হবে স্মার্ট বাংলাদেশ। ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে আমরা চলে যাবো। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার চারটি ভিত্তি সফলভাবে বাস্তবায়নে কাজ করছে। এগুলো হচ্ছে, স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট এবং স্মার্ট সোসাইটি। আমরা এখানেই থেমে থাকিনি, ২১০০ সালের ব-দ্বীপ কেমন হবে- সে পরিকল্পনাও নিয়েছি।

স্মার্ট বাংলাদেশে প্রযুক্তির মাধ্যমে সবকিছু হবে। সেখানে নাগরিকরা প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ হবে এবং এর মাধ্যমে সমগ্র অর্থনীতি পরিচালিত হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকার এবং সমাজকে স্মার্ট করে গড়ে তুলতে এর মধ্যেই বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পাদিত হয়েছে। বাংলাদেশকে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশে রূপান্তরে তরুণ প্রজন্মকে সৈনিক হিসেবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০৪১ সালের সৈনিক হিসেবে তোমাদের (তরুণদের) স্মার্ট নাগরিক হিসেবে প্রস্তুত হতে হবে।

রূপকল্প ২০৪১ বা বাংলাদেশ ভিশন ২০৪১ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রদত্ত এবং জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিল কর্তৃক প্রণীত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থানকে আরো দৃঢ় করে গড়ে তোলার জাতীয় কৌশলগত পরিকল্পনা। ২০২২ থেকে ২০৪৪ সাল, এই ২২ বছরের কৌশলগত পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অংশ হিসাবে, বাংলাদেশের লক্ষ্য শিল্পায়নের মাধ্যমে উচ্চ আয়ের দেশের মর্যাদা অর্জন। বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি বৃদ্ধি, মানবসম্পদ উন্নয়নের মাধ্যমে উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং বিনিয়োগের প্রসারকে উৎসাহ দেয়া রূপকল্প ২০৪১-এর উদ্দেশ্য। এ উদ্দেশ্যটি সফল হলে এদেশের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে আরেক ধাপ এগিয়ে যাবে। তাই এ মিশনটি সফলতা করার জন্য শুধু সরকার নয়, জনগণকেও একসঙ্গে কাজ করে যেতে হবে। দেশে হয়তোবা শিক্ষিতের হার বাড়ছে, শিক্ষিতের হারের তুলুনায় তাদের কর্মসংস্থানের হার বাড়ছে না। ফলে দিন দিন ক্রমেই শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। শিক্ষিত বেকারের সবচেয়ে বেশি অংশেই লেখাপড়া শেষ করে চাকরির পেছনে ছুটে বেড়ায়, তবে চাকরি না করে উদ্যোগতা হওয়ার মানসিকতা খুবই কম। ‘জাতীয় যুব পুরস্কার ২০১৯’ প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুব সমাজকে ‘চাকরি করব না, চাকরি দেব’ এই চিন্তা করার পরামর্শ দেন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-১৭-এর হিসেবে বলছে, দেশে কর্মক্ষম বেকারের সংখ্যা ২৭ লাখ। বিবিএস-এর হিসাব অনুযায়ী, দেশে শ্রমশক্তির মোট পরিমাণ ৫ কোটি ৬৭ লাখ। এর মধ্যে কাজ করছে ৫ কোটি ৫১ লাখ ৮০ হাজার জন। এর অর্থ বেকারের সংখ্যা মাত্র ২৬ লাখ ৮০ হাজার। দেশে বেকারের তথ্য সর্বশেষ ২০১৬ সালে শ্রমশক্তি জরিপ করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। সেটির ফল প্রকাশ করা হয় ১ বছর পর ২০১৭ সালে, কিন্তু ৫ বছর ধরে দেশে আর এই জরিপ হয়নি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপের মাধ্যমে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাগত হিসাবটার আপডেট জানতে হলে অপেক্ষা করতে হবে ২০২৪ সালের শেষ পর্যন্ত। বর্তমানে সংখ্যাটা হয়তোবা আরো অনেক হারে বেড়ে গেছে।

সঠিক মেধার মূল্যায়ন সঠিকভাবে করে শিক্ষিতদের সম্মানিত করে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করাই হলো রাষ্ট্রের কাজ। কিন্তু দিন দিন যেমন শিক্ষার হার বাড়ছে, তেমনি সঠিক কর্মসংস্থানের অভাবে বাড়ছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা। শিক্ষার হার যেভাবে বাড়ছে, সেভাবে কর্মক্ষেত্র বাড়ছে না। চাকরির বাজারের সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ফলে শিক্ষিত বেকারত্বের হার ঊর্ধ্বমুখী। বর্তমানে পাসের হার বাড়লেও আত্মকর্মসংস্থান ও বেকারত্ব দূরীকরণের কোনো সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সুভা গল্পে বাক-প্রতিবন্ধী সুভাকে তার মা গর্ভের কলঙ্ক বলেছেন। বেকাররা কি শিক্ষার কলঙ্ক! বিবিএসের পরিসংখ্যান বলছে, দেশে ২০১৭ সালে ১ বছরে মোট বেকারের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ বেড়ে গেছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৫ লাখ ৯০ হাজার। এক বছরেই তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬ লাখ ৭৭ হাজার। আর শতকরা হারে সবচেয়ে বেশি বেকারত্ব রয়েছে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে। প্রাথমিক শিক্ষা আছে, এমন লোকদের মধ্যে বেকারত্বের হার দুই দশমিক সাত শতাংশ, কিন্তু স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন এমন উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১১ দশমিক দুই শতাংশ। অর্থাৎ যিনি যত বেশি শিক্ষা গ্রহণ করছেন, তার বেকার হওয়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। এমন নয় যে, দেশে নতুন কর্মসংস্থান হচ্ছে না। সর্বশেষ জনশক্তি জরিপের তথ্য অনুসারে গত অর্থবছরে ১৩ লাখ মানুষের নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বেকারের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ বেড়ে গেছে। যাদের কর্মসংস্থান হয়েছে, তাদের মধ্যে অশিক্ষিত ও স্বল্পশিক্ষিতদের সংখ্যাই বেশি। উচ্চশিক্ষিতদের বেকারত্ব ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এর অর্থ হচ্ছে আমাদের দেশে যে পরিমাণে দক্ষ শ্রমশক্তি তৈরি হচ্ছে, তাকে কাজে লাগানোর উপযোগী পর্যাপ্ত ক্ষেত্র নেই। এটাও সত্য যে, দেশে বেকার ও শিক্ষিত বেকার দূরীকরণের নানামুখী পদক্ষেপে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে সরকার। শিক্ষিত বেকারদের দুরবস্থার কথা চিন্তা করা সরকারের আরো পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজন। একজন অভিভাবকের প্রধান লক্ষ্য থাকে সন্তানকে শিক্ষিত করে গড়ে তুলে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ তৈরিতে সহায়তা করা। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, গত বছর করোনার সময় থেকে কত যে শিক্ষিত ও মেধাবী ছেলে-মেয়েদের চাকরির নির্ধারিত বয়স চলে গেছে, তার ইয়ত্তা নেই। করোনায় স্বাভাবিক অফিস-আদালতগুলোর কাজ স্থবির হয়ে পড়ায় দেশের চাকরিপ্রার্থীরা পড়েছেন আরো বিপাকে। কারণ নিয়োগ পরীক্ষা না হওয়ায় চাকরিপ্রার্থীরা বয়স হারিয়েছেন। তথ্যমতে, এই করোনার সময় কমপক্ষে ২ লাখ চাকরিপ্রার্থী তাদের চাকরির বয়স হারিয়েছেন। দেশে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবি আজকের নয়, অনেক দিনের। করোনায় চাকরিপ্রার্থীরা বয়স হারানোর ফলে সেটা আরও জোরালো হয়েছে। সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ সাধারণ বয়সসীমা ৩০ বছর। মুক্তিযোদ্ধা, চিকিৎসক আর বিশেষ কোটার ক্ষেত্রে এই বয়সসীমা ৩২ বছর। সরকারি ছাড়াও আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানেও একই বয়সসীমা অনুসরণ করা হয়। আর চাকরি থেকে অবসরের সাধারণ বয়সসীমা ৫৯ বছর। মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রে তা ৬০ বছর। বিচারকদের ক্ষেত্রে ৬২ বছরের নির্দেশ আছে আদালতের। তবে তা কার্যকর হয়নি। বাংলাদেশ এখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের দেশ। জনসংখ্যার ১৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সি শতকরা ৬৮ ভাগ, যারা কর্মক্ষম। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু এখন ৭৩ বছর। তবে নারীদের গড় আয়ু ৭৫ বছর। পুরুষের ৭১ বছর। সরকারি চাকরিতে পদ খালি আছে ৩ লাখ ১৩ হাজার ৮৪৮টি। সরকারি চাকরিতে কর্মরত আছেন ১২ লাখ ১৭ হাজার ৬২ জন। বাংলাদেশে প্রতিবছর ২০ লাখের মতো নাগরিক চাকরির বাজারে প্রবেশ করেন। সরকারি নয়, এখন বেসরকারি খাতই হচ্ছে চাকরির বড় ক্ষেত্র। বিআইডিএসের গবেষণা অনুযায়ী, সার্বিকভাবে শিক্ষিতদের মধ্যে ৩৩ শতাংশের বেশি বেকার। আর এসএসসি, এইচএসসি, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে যারা প্রথম শ্রেণি পেয়েছেন, তাদের মধ্যে বেকারত্ব ১৯ থেকে সাড়ে ৩৪ শতাংশ। বিশেষ করে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে প্রথম শ্রেণিপ্রাপ্তদের মধ্যে ৩৪ দশমিক চার শতাংশই বেকার। স্নাতক পর্যায়ে এমন মেধাবীদের বেকারত্বের হার প্রায় ২৮ শতাংশ। এদিকে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়া প্রতি তিনজনের একজনই বেকার, আর উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে জিপিএ-৫ যারা পেয়েছেন তাদের মধ্যে ৩১ শতাংশের বেশি বেকার। সাধারণভাবে বাংলাদেশে প্রতি বছর যে ২০ লাখ মানুষ চাকরির বাজারে প্রবেশ করেন, তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ ১৬ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়। চার লাখ বেকার থাকেন। আর এই বেকারদের অধিকাংশই উচ্চশিক্ষিত। যেহেতু আমাদের লক্ষ্য এখন উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে স্মার্ট বাংলাদ গড়ার। তাই স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে শিক্ষিত বেকারদের সম্পৃক্তকরণে সংশ্লিষ্টদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা একান্ত জরুরি।

লেখক : আইনজীবী ও কলামিস্ট, জজ কোর্ট, খুলনা