মোকাবিলায় ব্যর্থতা কাম্য নয়

সারা বছরই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব

প্রকাশ : ১৪ জুলাই ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ইতিপূর্বে বাংলাদেশে গ্রীষ্ম ও বর্ষার শেষে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ঘটলেও এখন সারা বছরই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে রাজধানীসহ সারা দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধির সাথে সাথে ঘন ঘন এর ধরন পাল্টানোর বিষয়টি এখন রোগতত্ত্ব বিশেষজ্ঞদের কাছে মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইসিডিডিআরবি’র এক গবেষণা জরিপে ঢাকায় ডেঙ্গুর সবেচেয়ে মারাত্মক ধরন ডেন-২ এর ক্রমবৃদ্ধির প্রমাণ পাওয়া গেছে। ঢাকাসহ দেশের কয়েকটি বিভাগীয় শহর, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজারের টেকনাফ, রামু, উখিয়া, সাতক্ষীরার শ্যামনগর থেকে কয়েকশ’ ডেঙ্গু রোগীর রক্তের নমুনা পরীক্ষা করে এদের মধ্যে শতকরা প্রায় ৭৪ ভাগের মধ্যে ডেঙ্গুর ডেন-২ ধরা পড়ে। ডেঙ্গুর ডেন-২ সবচেয়ে মারাত্মক ও প্রাণঘাতী বলে চিহ্নিত। ডেঙ্গু ঘন ঘন ধরন পাল্টানোর কারণে এর মোকাবিলা ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা জটিল আকার ধারণ করছে। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার চেয়ে এডিস মশার বিস্তার রোধে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের দিকে মনোনিবেশ করাই বেশি কার্যকর বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে এ ক্ষেত্রে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন কিছু সাফল্যের দাবি করলেও মাঠের বাস্তবতায় তাদের এসব দাবি ধোপে টেকে না। সেইসাথে সাম্প্রতিক সময়ের আরেকটি উদ্বেগজনক বাস্তবতা হচ্ছে, ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব এখন আর ঢাকায় সীমাবদ্ধ নেই। চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই ঢাকার বাইরের বলে জানা যায়।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ঢাকার সিটি কর্পোরেশনের মেয়রদ্বয় নানাবিধ উদ্যোগের কথা জানিয়েছিলেন, দক্ষিণের মেয়র পরিচ্ছন্নতা ও মশক নিধনে গতানুগতিক উদ্যোগে মনোযোগের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনদের সমন্বিত উদ্যোগের উপর জোর দিয়েছিলেন। অন্যদিকে ঢাকা উত্তরের মেয়র এডিস মশা নিধন ও লার্ভা চিহ্নিতকরণে শতকোটি টাকা ব্যয়ে ড্রোন ব্যবহার করেও তেমন কোনো সাফল্য দেখাতে পারেননি। ভুল সময়ে ভেজাল ওষুধ ও কেমিক্যালে মশক নিধনের বাজেট অনেকটাই অপচয়-অপব্যবহারে চলে যাচ্ছে। ঢাকায় হাজার হাজার মানুষের ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়া এবং শত শত মানুষের মৃত্যুর ঘটনা সাম্প্রতিক কয়েক বছরের বাস্তবতা। দুই দশক আগেও এমনটি দেখা যায়নি। শহরের বাহ্যিক অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের সাথে সাথে পরিবেশগত ঝুঁকি এবং পানি, বায়ু ও মশাবাহিত রোগের প্রকোপ বাড়ছে। এসব প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় শত শত কোটি টাকা ব্যয় করা হলেও কোনো উদ্যোগেই সফলতা পাওয়া যায়নি। ঢাকা দক্ষিণের মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নুর তাপস এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার জন্য সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের অসহযোগিতার অভিযোগ তুলেছেন, সেই সাথে নির্মাণাধীন ভবন ও প্রতিষ্ঠানের পরিচ্ছন্নতা এবং মশার লার্ভা দমনে ব্যর্থতার জন্য ভ্রাম্যমাণ আদালতের তৎপরতা বাড়িয়েছে দুই সিটি কর্পোরেশন।

মশক নিধনে সিটি কর্পোরেশনের ব্যর্থতা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ঢাকাসহ দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতে অপরিকল্পিত আবাসন ও নগরায়ন, নদনদীর দূষণ, খাল ও জলাভূমি দখল ও ভরাটের পরিবেশগত বিপর্যয়ের সম্মুখীন প্রতিটি জনপদ। এডিস মশার বিস্তার, বায়ু দূষণ এবং পানি দূষণের সাথে সিটি কর্পোরেশন, রাজউক, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলো দুর্নীতি ও ব্যর্থতার দায় এড়াতে পারবে না। রাতারাতি এই বাস্তবতা পাল্টে দেয়া হয়তো সম্ভব নয়। তবে ডেঙ্গুর মতো প্রাণঘাতী রোগের প্রাদুর্ভাব মোকাবিলা খুব বড় দুঃসাধ্য কাজ নয়। এ ক্ষেত্রে নাগরিকদের সচেতন উদ্যোগ ও সক্রিয় ভূমিকা জরুরি। সিটি কর্পোরেশন ও স্থানীয় সরকারের পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম এবং মশক নিধনে ওষুধ ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ে দুর্নীতি-অস্বচ্ছতার বিরুদ্ধে কার্যকর নজরদারি ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। সেই সাথে ডেঙ্গুর নতুন নতুন ধরন শনাক্তকরণ এবং মশক নিধনে নিজস্ব গবেষণা প্রকল্প বাড়ানোর পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে গবেষণা যোগাযোগ, প্রযুক্তিগত ও তথ্য সহযোগিতা বাড়ানোর কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। বর্ষার পর ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। ঢাকাসহ দেশের সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গুর চিকিৎসা সহজলভ্য করার নির্দেশনা ও প্রস্তুতি থাকতে হবে। ডেঙ্গুর লার্ভা উৎপত্তির স্থান সম্পর্কে নগরবাসীকে আরো সচেতন করে তোলার উদ্যোগের পাশাপাশি নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালনার মধ্য দিয়ে এ বিষয়ে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও ভবন মালিকদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। পানিবদ্ধতা, পয়োঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ও উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে অস্বাভাবিক সময়ক্ষেপণ ও অব্যবস্থাপনা কমিয়ে আনতে পারলে দূষণ মোকাবিলা ও এডিস মশার বিস্তার অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব।