মুসলিম সংস্কৃতি খেলাধুলায় সুস্বাস্থ্য ও মনোভাব গড়ে ওঠে
মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান, কলামিস্ট ও গবেষক
প্রকাশ : ১৫ জুলাই ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
ইসলামী সভ্যতায় মুসলমানদের কথা মনে হলেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে চিরায়ত কিছু দৃশ্য। জিহাদের ময়দানে তারা অশ্বের খুরে ধুলো উড়িয়ে ছুটে যাচ্ছে; তাদের হাতে চিকচিক করছে তীর-তরবারি। দিকে দিকে তারা প্রতিষ্ঠা করছে মাদ্রাসা, নেতৃত্ব দিচ্ছে মসজিদে, কলমের কালিতে গড়ে তুলছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিশাল ভাণ্ডার। চোখে ভাসে দিগন্ত-বিস্তৃত তাদের ইসলামী সাম্রাজ্যের মোহনীয় সব দৃশ্য। কিন্তু এর বাইরেও তাদের আরেকটি রূপ আছে, আরেকটি অনুশীলন আছে। যেমন- অবসরে নির্মল বিনোদন গ্রহণ, মেধা ও স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী খেলাধুলা করা। মুসলমানদের এই রূপটি ইতিহাসের একটি অবহেলিত অংশ, অচর্চিত অনুশীলন। মুসলমানদের পূর্ণ রূপটি তুলে ধরতে গেলে খণ্ডিত এই অংশকে এড়িয়ে যাবার সুযোগ নেই।
মুসলমানরা খেলাধুলা করতেন সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে, সুনির্মিত নিয়মে। রাসুল (সা.) ছিলেন আরবের সবচেয়ে বড় কুস্তিগীর, উটের দৌড় প্রতিযোগিতায় তার উট কখনো জিততো, কখনো হারতো। অনেক তাবেঈন ইমাম ছিলেন তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে দক্ষ দাবাড়ু। আলেমণ্ডউলামা, উমারা-শাসকগণ সাঁতার কাটতেন, গলফ খেলতেন, শিকার করতেন। এই লেখায় ইতিহাসের আলোচিত সেই বিষয়টি পাদপ্রদীপে আনার চেষ্টা করবো।
খেলাধুলার উত্তরাধিকার : জাহেলি যুগ থেকেই অনেক খেলাধুলায় অভ্যস্ত ছিল আরবরা। আরবি অভিধানে এমন কয়েক ডজন খেলার নাম উল্লেখ করা হয়েছে। ভাষাবিদ ইবনে সিদা উন্দুলুসি ‘আল মুখাসসাস’ গ্রন্থে একটি অধ্যায়ের নামকরণ করেছেন ‘খেলাধুলার নাম’ শিরোনামে। এই অধ্যায়ে তিনি ৪২টি খেলার নাম উল্লেখ করেছেন। তারপর ইবনে মানযুর ‘লিসানুল আরবে’ আরো কিছু খেলার নাম বৃদ্ধি করেছেন। তারমধ্যে কিছু খেলার বিবরণও দিয়েছেন। ঐতিহাসিক ফাকিহি ‘আখবারু মাক্কা’ গ্রন্থে একটি অধ্যায় লিখেছেন ‘জাহেলি ও ইসলামি যুগে মক্কাবাসীদের খেলাধুলা, পরবর্তীতে বর্জন’ শিরোনামে। তাতে তিনি বলেছেন, মক্কায় এসে হজরত ওমর রা. দেখলেন, মক্কাবাসীরা কাঠের টুকরো দিয়ে এক ধরনের খেলা খেলছে। খেলনাটির নাম ‘কুররাক’। তিনি বললেন, ‘রাসুল সা. যদি এই খেলার অনুমতি না দিতেন, আমিও অনুমতি দিতাম না।’ কুররাক খেলাটি ছিল আরবের বহু পুরাতন একটি খেলা। ২৫২ হিজরি/৮৬৬খৃ. পর্যন্ত এই খেলার প্রচলন ছিল।
মেধার জোরে খেলতে হয়, আরবীয় এমন পুরাতন একটি খেলা হলো ‘কিরক’। ইরাকের ছেলেরা এখনো খেলাটি খেলে। খেলায় একটি চতুষ্কোণ ঘর আঁকতে হয়, তার ভেতরে আরো একটি চতুষ্কোণ ঘর, তার ভেতরে আরো একটি চতুষ্কোণ ঘর। এখন রেখা টেনে সবগুলো কোণ মিলিয়ে দিতে হয়। খেলাটি খেলতে হয় দুজনে। প্রত্যেকের হাতে থাকবে তিনটি গুটি। গুটি বসাতে হয় কোণে। প্রত্যেকেই চেষ্টা করবে, তার তিনটি গুটি যেন একই রেখায় সমান্তরালভাবে আনতে পারে। যে আনতে পারবে, জিত তারই।
‘কিতাবুল গরিবিন ফিল কুরআন ওয়াল হাদিস’ গ্রন্থে আবু উবায়েদ হারবি বলেছেন, এই কিরক খেলা সম্পর্কে আবু হুরায়রা (রা.) বলেছেন, ‘রাসুল সা. এই গুটিখেলা দেখতেন। কিন্তু খেলতে না করতেন না।’
আরবদের প্রসিদ্ধ খেলা ছিল কুস্তি। ইয়াজিদ ইবনে রুকানার সঙ্গে রাসুল (সা.)-এর কুস্তি খেলার ঘটনা তো প্রসিদ্ধ। ‘আল বিদায়া ওয়ান নিহায়াতে’ ইবনে কাসির (রহ.) ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে জায়্যিদ সনদে বর্ণিত একটি হাদিস উল্লেখ করেছেন। তার সারমর্ম হলো- রাসুল (সা.) ইবনে রুকানাকে কুস্তিতে টানা তিনবার পরাজিত করেন। তৃতীয়বার ইবনে রুকানা বললো, ‘মুহাম্মদ! আপনার পূর্বে আমার পিঠ কেউ কখনো মাটিতে লাগাতে পারেনি।’
খেলার প্রকার : রাসুল (সা.) যখন মদীনায় হিজরত করলেন, মদীনায় প্রতিষ্ঠিত হলো ইসলামী রাষ্ট্র, তখনকার মদীনায় দুই ধরনের খেলার প্রচলন ছিলো। এক- আনুষ্ঠানিক খেলা। দুই- প্রতিযোগিতামূলক খেলা। কখনো এ দুই ধরনের খেলা একই সঙ্গে হতো।
আনুষ্ঠানিক খেলার প্রসিদ্ধ উদাহরণ বুখারী শরীফে উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা (রা.) এর একটি হাদিস- দেখি, একদিন রাসুল (সা.) আমার দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। একজন হাবশিরা মসজিদে খেলছে। রাসুল (সা.) চাদর দিয়ে আমাকে ঢেকে রেখেছেন। আর আমি হাবশিদের খেলা দেখছিলাম।’ কোনো রেওয়ায়াতে এসেছে- তারা বর্শা দিয়ে খেলছিলো।
এর থেকে স্পষ্ট- এই খেলাটি মদীনার আনসারদের মধ্যে প্রচলিত ছিলো। আবু দাউদ (র.) হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। হিজরত করে রাসুল সা. যখন মদীনায় আসেন, হাবশিরা আনন্দে বর্শা দিয়ে খেলছিল। ‘মিরআতুয যামান’ গ্রন্থে সিবত ইবনুল জাওযি বলেন, হিজরত করে রাসুল (সা.) যখন মদীনায় আসেন, হাবশিরা আনন্দে বর্শা দিয়ে খেলছিল। সেদিনের মতো আনন্দিত তারা আর কখনো হয়নি।
এই বর্শা বর্শা খেলা ছিল মূলত যুদ্ধের প্রস্তুতি। সহিহ বুখারীর ব্যাখ্যাগ্রন্থে কিরমানি ইবনুল মুনাইইর থেকে একটি বক্তব্য কোট করেছেন- এটাকে খেলা বলা হতো। মূলত এটা ছিল যুদ্ধের প্রস্তুতি। তারা আঘাত করার ভঙ্গি করত, কিন্তু আঘাত করত না। এই হাদিস থেকে হাদিসের ব্যাখ্যাকাররা খেলা দেখার ফিকহি হুকুম বের করেছেন। এই হাদিসের ভিত্তিতে সহিহ বুখারীর ব্যাখ্যাগ্রন্থে ইবনে বাত্তাল কুরতুবি বলেছেন, যে খেলা মুবাহ, সে খেলা দেখা জায়েজ।’ তিনি মনে করেন, ‘বর্শা দিয়ে খেলা সুন্নাত। কারণ এটা যুদ্ধপ্রস্তুতি।
খেলা যখন পেশা : প্রতিযোগিতার খেলা নয়, বরং এই আনুষ্ঠানিক খেলাকে কেউ কেউ পেশা হিসাবে গ্রহণ করেছেন। ইবনু আবি শায়বা ‘আল মুসান্নাফে’ বর্ণনা করেন, ‘ইবনে আব্বাস (রা.) যখন তার দুই ছেলের খতনা করান, খেলা দেখানোর জন্য কয়েকজন খেলোয়াড় ডেকে এনেছিলেন। খোলা শেষে তিনি তাদের দিয়েছিলেন চার দিরহাম। কেউ বলেন তিন দিরহাম।
পরবর্তীতে খলিফা এবং সুলতানরা এসব খেলোয়াড়দের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিতেন। সপ্তম হিজরি শতাব্দী/১৩০০ খৃষ্টাব্দের শুরুতে তাতার দূতের সামনে সামরিক কুচকাওয়াজের আয়োজন করেছিলেন আব্বাসি খলিফা। বিখ্যাত পর্যটক ইবনে জুবাইর মক্কাবাসীদের এমনই এক খেলার কথা সফরনামায় উল্লেখ করেছেন। তিনি দেখলেন- মক্কাবাসীরা দলে দলে অস্ত্রসজ্জিত হয়ে বের হচ্ছে। কেউ ঘোড়ায় চড়ে, কেউ পায়ে হেঁটে। তারা একটি ময়দানে উপস্থিত হলো। শুরু হলো ভয়ংকর এক খেলা। বর্শাকে শূন্যে ছুঁড়ে মুহূর্তেই কেমন নিপুণ কুশলতায় হাতে নিচ্ছে। কেউ শূন্যে ছুঁড়ছে তরবারি; আবার এমনভাবে তরবারির বাট ধরে ফেলছে, মনেই হচ্ছে না তরবারি হাত থেকে আলাদা হয়েছে।
কখনো কখনো যুদ্ধজয়ের খুশীতেও এই ধরনের খেলার আয়োজন করা হতো। ‘কানযুদ দুরারে’ ঐতিহাসিক ইবনুদ দাওয়াদারি লিখেন, ৬৪৭ হিজরি/১২৪৯ খৃষ্টাব্দে আইয়ুবিরা যখন মিশরে বিজয়ী হলো, তারা শহরে প্রবেশ করছিল ঘোড়ায় চড়ে বর্শা দিয়ে খেলতে খেলতে। ‘হাওয়াদিসু দিমাশক আল ইয়াওমিয়্যাহ’ গ্রন্থে হাল্লাক বুদাইরি লিখেন, ‘১১৫৬ হিজরি/১৭৬২ খৃস্টাব্দে দামেশকের গভর্নর সুলাইমান পাশা তার ছেলের খতনা উপলক্ষে আনন্দ উদযাপন শুরু করেন। সমস্ত খেলোয়াড় তাতে উপস্থিত হয়েছিল। তাদের স্বাধীনতা দেয়া হয়েছিল- তাদের ইচ্ছামতো তারা খেলতে পারে। টানা সাতদিন-সাতরাত এই উদযাপন চলে।’
ব্যাপক অংশগ্রহণ : মুসলমানদের এসব খেলাধুলায় সবাই অংশগ্রহণ করত। এমনকি ফকিহরাও। সুলতানরা রাষ্ট্রে আবশ্যকীয় একটা অংশ হিসেবে নিতেন খেলাধুলাকে। জাহিয ‘আত তাজ’ কিতাবে তাই বলেছেন। ইবনে রজব হাম্বলি ‘যাইলু তাবাকাতিল হানাবিলা’ গ্রন্থে বলেন, হাম্বলি মাজহাবের একজন যাহেদ আবু মনসুর আবদুল আজিজ ইবনে সাবেত বাগদাদি। তার সংস্পর্শে থাকতে ভালো লাগত। একদিন আমরা ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.)-এর কবর জিয়ারত করতে বের হই। পথে একটি নদী পড়ে। আমাদের সঙ্গে থাকা ফকিহরা নদীতে নেমে সাঁতার কাটতে শুরু করেন। তারা শায়খ আবু মনসুরকে ডাকতে থাকেন, আপনিও আমাদের সঙ্গে নেমে আসুন। শায়খ কাপড় খুলে নেমে তাদের সঙ্গে সাঁতরাতে লাগলেন।’
বাচ্চাদের জন্যও আলাদা কিছু খেলা ছিলো। সহিহ মুসলিমে এসেছে, ‘রাসুল (সা.)-এর প্রথম বক্ষ বিদীর্ণের ঘটনা ঘটে শৈশবে। তখন তিনি বাচ্চাদের সঙ্গে খেলছিলেন।’ ‘সিয়ারু আলামিন নুবালা’তে ইমাম যাহাবি লিখেন, ‘আবু হুরায়রা (রা.) বাচ্চাদের প্রতি কোমল ছিলেন। তিনি খেলারত বাচ্চাদের কাছে এমনভাবে এসে দাঁড়াতেন, তারা টের পেতো না। যতক্ষণ না তিনি নিজে বুঝতে দিতেন পায়ে শব্দ করে। তখন বাচ্চারা পালাতো।’ আর মেয়েরা খেলতো পুতুল খেলা।
রাসুলের যুগ থেকেই মুসলমানদের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক খেলাধূলার প্রতি ব্যাপক আগ্রহ ছিলো। তবে ইসলাম জুয়ার দ্বার রুদ্ধ করে দিয়েছে। যেখানে অর্থ ব্যয় হয়, কিন্তু সমাজের কোনো উপকার হয় না। তবে ইসলাম কিছু খেলার প্রতিযোগিতা নিষেধ করেনি। যেমন- সাঁতার। এর মাধ্যমে মানুষের শারীরিক উপকার হয়।
এছাড়াও রয়েছে তীরন্দাজি, দৌড় প্রতিযোগিতা, উট এবং ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা। রাসুল (সা.) এসব প্রতিযোগিতায় নিজে অংশগ্রহণ করতেন, অংশগ্রহণকারীদের উৎসাহ দিতেন। তিনি হাফিয়া থেকে সানিয়াতুল বিদা পর্যন্ত ১০ কিমি. ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন। তিনি একবার তীরন্দাজিতে রত একদল লোকের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি উৎসাহ দিয়ে তাদের বললেন, ‘হে বনি ইসমাইল! তোমরা তীরন্দাজি চর্চা করো। তোমাদের পিতাও ছিলেন তীরন্দাজ।’
রাসুল (সা.)-এর প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের হাদিস থেকে আহলে ইলমরা বলেন, যেসব খেলাধুলায় মেধা উন্নত হয়, যুদ্ধের প্রস্তুতি হয়, কৌশল শেখা যায়, সেসব খেলা জায়েজ। আল্লামা মাহমুদ শুকরি আলুসির ‘মুখতাসারুত তুহফাতিল ইসনা আশারিয়া’ গ্রন্থে এমনটাই বলেছেন।