পোশাকে সভ্য মানুষ, মনে?

অলোক আচার্য, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

প্রকাশ : ১৬ জুলাই ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

একটি সমাজ কোনদিকে ধাবিত হবে তা নির্ভর করে সেই সমাজের মানুষের গতিপ্রকৃতির ওপর। সমাজে ভোগবাদিতা যখন মূখ্য উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায় তখন মানবতা গৌণ হয়ে দেখা দেয়। তখন সেই সমাজের মূল উদ্দেশ্য থাকে যে কোনোভাবে সম্পদ অর্জন এবং ঠিক একই সময়ে মানুষের ভাগ্যে দুর্দশা নেমে আসে। ভোগবাদী সমাজের পরিণতি আসলে কি হয় শেষ পর্যন্ত? আজকের সমাজ এবং সমাজে প্রচলিত ব্যবস্থার দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়, সমাজের সর্বত্র ভোগবাদি মনোভাব। সমাজ থেকে প্রবাহিত হয়ে ভোগবাদি মনোভাব রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে পড়ছে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও একই রকম পরিণতি লক্ষ্যণীয়। মুখে মুখে মানবতার বুলি ছাড়লেও বাস্তবতা হলো যার যার মতো ভোগবিলাসে মত্ত। জীবনকে যে যতটা উপভোগ করতে পারে এবং তা যে কোনো উপায়েই হোক। এই ভোগবিলাসিতা থেকে মানুষকে ফেরানো খুবই কঠিন। কারণ আরামপ্রিয়তা মানুষকে আরো আরামপ্রিয় করে তোলে। এর কারণেই সমাজে এক শ্রেণির মানুষ সম্পদের পাহাড় গড়ছে অন্যদিকে এক শ্রেণি সম্পদহীন হচ্ছে। অথচ সমাজের শান্তির জন্য সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন প্রয়োজন ছিল। মানুষ সৃষ্টির শুরু থেকেই সভ্যতার যাত্রা সামনের দিকে ধাবমান। সময়ের চাকায় পেছনে যাবার সুযোগ নেই। তাই আমরা এগিয়ে চলেছি। তাই সামনের দিকে অন্তহীন যাত্রায় এগিয়ে চলেছে এ মানব সভ্যতা। এই অন্তহীন যাত্রা কোথায় শেষ হবে তা আমাদের জানা নেই। আমাদের কর্মে ও মননে প্রতি পদক্ষেপে মানুষ নিজের শ্রেষ্ঠত্বের স্বাক্ষর রেখে চলেছে। সৃষ্টির অন্য প্রাণী থেকে মানুষ শ্রেষ্ঠ এটা তার কর্ম দিয়েই প্রমাণ করেছে। সভ্যতা বিকাশের পথে মানুষের ভেতর হিংসা, ক্রোধ, লোভ-লালসাও বিকশিত হতে লাগল। নিজেদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব চরমে উঠলো। বহু সভ্যতা মানুষের দুষ্কর্মে ধ্বংস হয়েছে। গড়ে উঠেছে নতুন কোনো সভ্যতা। চাপা পরেছে সেই সব উন্নত সভ্যতার সব নিদর্শন। এভাবে মানব সভ্যতা বিকশিত হতে হতে আজকের এই আধুনিক বা অতি আধুনিক সভ্যতায় এসে উপনীত হয়েছে। এই সমাজকে সভ্য সমাজ বলা হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো এই সভ্য সমাজ প্রকৃতপক্ষে কতটা সভ্য হতে পেরেছে। আদিম যুগে পশুদের সঙ্গে বসবাস করতে করতে সভ্য হতে বহু বছর সময় নিয়েছে। আজ পশুরা বনে আর মানুষ শহরে। তবে মানুষ কিন্তু পশুত্বকে দমন করতে পারেনি। মনের ভেতর পশুটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আমাদের প্রতিদিনকার কর্মকাণ্ড, আদব-কায়দা, আচার-আচরণ প্রভৃতি বিশ্লেষণ করে বিচার করা উচিত এই সভ্যতা, এই সমাজ সত্যিকার অর্থে সভ্য কি-না। আমাদের কর্মকাণ্ড সেই বর্বর ও অসভ্য সময়েই ইঙ্গিত বহন করে চলেছে। মিথ্যাই নিজেদের সভ্য বলে গলা উঁচু করে কথা বলা।

যে সমাজে প্রতিনিয়ত ধর্ষিত হয় শিশু থেকে বৃদ্ধা, যে সমাজে মেয়েদের নিরাপত্তা বলে কোনো জায়গা অবশিষ্ট নেই, মেয়েদের জন্য কোনো ব্যক্তি নিরাপদ নয়, যে সমাজে সবাই সবাইকে ঠকানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে থাকি, দুহাত পেতে বাইরে ভিক্ষুকের ছদ্মবেশে কর্মক্ষম মানুষ হাত পেতে ভিক্ষা করতে সম্মানবোধ করে আর ভেতরে সুট্যেড-বুট্যেড মানুষেরা ঘুষ নামক ভিক্ষা নিয়ে জীবনধারণ করে, মানুষ মানুষকে মারার জন্য নিত্য নতুন অস্ত্র তৈরি করে, ধর্মে-ধর্মে, বর্ণে-বর্ণে প্রতিনিয়ত রেষারেষি, শিক্ষার নাম করে বাণিজ্যের দুয়ার খুলে বসে থাকে, আতংক আর অস্থিরতায় সময় পার করতে হয় সে সমাজকে কেবল বড় বড় দালানাকোঠা, ব্যবসা বাণিজ্য প্রবৃদ্ধির মাণদণ্ডে আধুনিক সভ্য সমাজ বলা যায় কি না তা ভেবে দেখতে হবে। সমাজের উৎকর্ষ সাধন কেবল পোশাকে-আশাকে হয়েছে, মননে-মানবিকতায় হয়নি। সভ্যতা এগিয়েছে কিন্তু মানসিকতা পিছিয়েছে। সভ্যতার শুরুতে মানুষের পোশাক ছিল না। লজ্জা নিবারণের জন্য গাছের বাকল ব্যবহার করতো। এখন বাহ্যিক লজ্জা নিবারণের জন্য স্যুট ব্যুট আবিষ্কার হয়েছে। কিন্তু চক্ষু লজ্জা প্রায় নেই বললেই চলে। এখন ইচ্ছা করলেই মিথ্যা বলা যায়, কারো সঙ্গে প্রতারণা করা যায়, কাউকে মঞ্চে দাড়িয়ে মিথ্যা আশ্বাসের বাণি শোনানো যায়। এ লজ্জা ঢাকার কোনো পোশাক নেই। এদেশে একটা বালিশ কিনতে হাজার হাজার টাকা খরচ দেখানো হয়, কেরানীর চাকরি করে বড় বড় বাড়ি গাড়ির মালিক হওয়া যায়। অন্য চিত্রও আছে। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি শেষে পান্তা ভাত দিয়ে রাতের খাওয়া শেষ করা মানুষগুলোও এ সভ্যতারই মানুষ। ভদ্র পোশাক পরা মানুষগুলো যারা সভ্যতার দোহাই দিয়ে অবলীলায় অসভ্য কার্যক্রম করে যাচ্ছে তাদের ভেতর থেকে আজও সেই আদিমতা ধুয়ে মুছে যায় নি। মনুষ্যত্বের কোনো বিচারেই এদের মানুষ বলা ঠিক হবে না।

এই সমাজকে সে দৃষ্টিকোণ থেকে সভ্য বলতে দ্বিধা হয়। সভ্য হলে সামিয়ার মতো নিষ্পাপ শিশুরা ধর্ষণের শিকার হবে? কেনই বা শ্রদ্ধার শিখরে থাকা শিক্ষক সিরিয়াল ধর্ষক হবে? তাই আজ ভাবতে বাধ্য করছে এটা সভ্যতার উত্তরণ আ অবনমন। পোশাক স্বর্বস্ব সমাজে এসব কুৎসিত মনের মানুষগুলো ভালো মানুষের আশেপাশেই ঘুরে বেড়ায়। তাদের আলাদা করে চেনার কোনো উপায় নেই। এসব ঘটনা একদিনের নয় বা কোনো একটি ঘটনাতেই এসব শেষ হয়ে যাচ্ছে না। একের পর এক ঘটনা আমাদের সামাজিক মূল্যবোধকে দুর্বল করে ফেলেছে। বারবার সভ্যতার দোহাই দিয়ে নিজেদের জাত উঁচু করার চেষ্টা করছি। তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে সব অস্বিকার করার চেষ্টা করছি। অথচ আজকের এই সভ্যতার পেছনে কত যুদ্ধ বিগ্রহ জড়িয়ে রয়েছে। কত সভ্যতার মানুষের রক্ত লেগে রয়েছে তার হিসাব নেই। আজ আমরা এমন একটি সভ্যতায় পা রেখেছি যেখানে মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু মানুষ। সবচেয়ে হিংস্র কে এ প্রশ্নের উত্তরও হবে মানুষ। সবচেয়ে লোভী আর অহংকারী প্রাণীটির নামও মানুষ। মানুষকে ঠকিয়ে বড় হওয়ার চেষ্টা করে এই আধুনিক সভ্যতার মানুষগুলোই।

বিবেক-বোধ, জ্ঞান, সংযম, প্রেম সবকিছু বর্জন করে আঁকড়ে ধরে আছি মিথ্যে অহমিকাকে। যান্ত্রিক সভ্যতার উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে মানবিক সভ্যতা বিলীন হতে আরম্ভ করেছে। দিন যত এগিয়ে যাচ্ছে এই মানবতার সংকট তত ঘনিভূত হচ্ছে। নিত্য নতুন ডিজাইনের পোশাক গায়ে দিয়ে রাস্তায় বের হচ্ছি কিন্তু প্রকৃত লজ্জার মাথা খেয়ে বসে আছি। আজ ঘুষখোর, চাঁদাবাজ, লম্পট বললেও কেউ তেমন একটা রাগ করে না। ঘুষ খাওয়ার মধ্যেই যেন আনন্দ নিহিত! যেখানে মন নেই, রুচি নেই, মনুষ্যত্ব নেই, বিবেক নেই, ঘৃণা নেই, মানবিকতা নেই সেখানে কোন সভ্যতার উত্তরণ ঘটছে জানি না।

প্রতিদিন পত্রিকার পাতায়, টেলিভিশনের খবরে সমাজের অস্থির চিত্র দেখি। দেখতে দেখতে চোখ সয়ে গেছে। মনের বোধের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। বিবেকের কোনো মূল্য নেই। আবেগ দিয়ে কিছুই হয় না। সেসব ভয়ংকর চিত্র দেখেও কোনো অনুভূতি হয় না। মনটা অজানা আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। কিছুই করার থাকে না। সভ্যতার বিকাশ সাধন হয়েছে ঠিকই কিন্তু সেই যাত্রা তো ফের উল্টোদিকে টানছে না আমাদের। পশুর সঙ্গে বসবাস করতে করতে পশুর আচরণ বেশ রপ্ত করতে পেরেছে মানুষ জাতি। পশুর মতোই হিংস্রতা, পশুর মতোই লোভ, আপন-পর, ছোট-বড় বোধশূন্য। একটু যদি ভাবি তাহলে একমত হবেন যে পশুর চেয়েও ক্ষেত্রবিশেষে হিংস্রতায় আমরাই এগিয়েছি। সময়ের উল্টোযাত্রায় আজ আমরা সবাই শামিল হয়েছি। অল্প ক’জন ভালো মানুষ এ সমাজে আজ বড় বেকায়দায়। তারা এই আড়ম্বরপূর্ণ সমাজ নিয়ে কিছুটা বিরক্ত। বিপরীতে যারা অন্যের কাঁধে ভর করে নানা অপকৌশলের আশ্রয় নিয়ে পকেট মোটা করে বসে আছে তারাই সমাজের হর্তাকর্তা। তাদের মুখের কথাই আইন। তাদের কথায় সবাই ওঠবস করে। তাদের দেখলে রাস্তাঘাটে সালামের হিড়িক লেগে যায়। কেউ ভয়ে আবার কেউ তোষামদ করে চলছে প্রতিনিয়ত। তেল দেয়াই যে এ সমাজের ওপরে ওঠার সবচেয়ে কার্যকর ওষুধ। যে যত দক্ষ হাতে তেল দিতে পারবে সে তত ওপরে উঠতে পারবে। তারপর একদিন তাকেও তেল দেয়া শুরু হবে। এই তেলে কোনো ভেজাল নেই। এরা কিছু না বুঝলেও সব বোঝেন, কিছু না করলেও ফরমাশ দিতে ওস্তাদ, তারাই সমাজের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। এসব কর্তার চোটপাটে বাকিরা ভর্তা হবার যোগাড় সেদিকে কারো লক্ষ নেই! এরাই আজ সভ্যতার অগ্রগতি মাপার বড় মাপকাঠি। ভোগবাদী সমাজে শেষ পর্যন্ত এটাই হয়। অপ্রাপ্তি আর অসহায়ের আর্তনাদ শুনতে হয়। এ থেকে উত্তরণের জন্য মানবতার ডাক শুনতে হয়। বিবেককে জাগ্রত করতে হয়। ভোগবাদী মনোভাব থেকে বের হয়ে সমাজের মানুষের জন্য চিন্তা করতে হয়। তাহলে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পারি।