ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বাংলায় মহররম উদযাপনের ইতিহাস

মাহমুদ সালেহীন খান
বাংলায় মহররম উদযাপনের ইতিহাস

মহররম পুরান ঢাকার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ। মহররমের প্রথম ১০ দিন এখনো জমজমাট থাকে সারারাত। মুঘল আমলে বাংলার শাসকশ্রেণি শিয়া ইসলামের অনুসারী হওয়ায় ঐতিহাসিকভাবেই বাংলার মুসলমানদের সংস্কৃতিতে মহররম একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। ইতিহাস ঘাঁটলে পাওয়া যায়, শাসকদের তত্ত্বাবধানে সরাসরি মহররম তথা আশুরা উদযাপিত হতো। মুর্শিদাবাদ ও ঢাকায় মহররম উপলক্ষে জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনের ইতিহাস অপ্রতুল নয়। শাসকশ্রেণির সমাজ ও সংস্কৃতি দ্বারা জনগণ সবসময়ই প্রভাবিত হয়। বাংলার মুসলমানদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। মধ্যযুগের মুসলিম সাহিত্যিকদের রচনা থেকে এ ব্যাপারে ধারণা পাওয়া যায়। প্রথমে বলা যাক ঢাকার কথা।

মহররম পুরান ঢাকার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ। মহররমের প্রথম ১০ দিন এখনো জমজমাট থাকে সারারাত। পুরান ঢাকায় মহররম উদযাপনের ১০০ বছর আগের বিবরণ পাওয়া যায় অধ্যাপক আহমদ হাসান দানীর বিখ্যাত গ্রন্থ উঅঈঈঅ-তে। উর্দু ‘জাদু’ পত্রিকায় হাকিম আহসানের বিবরণী ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন অধ্যাপক দানী। সেখান থেকে জানা যায়, প্রথম তিন দিন সারা রাতব্যাপী হোসেনী দালানের চারিদিকে মোমবাতি জ্বালানো হতো; চতুর্থ দিন বসতো মর্সিয়া গানের আসর; পঞ্চম দিন ভিস্তিরা (যারা বংশগতভাবে পানির মশক বহন করেন তাদের ভিস্তি বলা হয়)। দলবদ্ধভাবে সবাই একরকম পোশাক পরে মিছিল নিয়ে রাস্তায় বের হতেন; ষষ্ঠ দিন ভিস্তিরা লাঠি নিয়ে আসতেন হোসেনী দালানে, এসে লাঠিগুলো মাঠে সারিবদ্ধভাবে রাখতেন আর লাঠির নিচে জ্বলে উঠত মোমবাতি, তারপর সমবেত জনতার মধ্যে তাবারুক বিলানো হতো; সপ্তম দিনে হতো হাজারো মানুষের জুলুস তথা বর্ণাঢ্য মিছিল। অষ্টম দিনে বিভিন্ন মহল্লা থেকে নারীরা হোসেনী দালানে আসতেন জারি গান গাইতে। তখন পুরুষরা হোসেনী দালান ত্যাগ করতেন। নবম দিন মাগরিবের পর হাতি এবং ভিস্তিদেরকে নিয়ে বিবি কা রওজা থেকে বের হতো বর্ণাঢ্য মিছিল। দশম দিন সকলে মহল্লা থেকে তাজিয়া মিছিল নিয়ে আজিমপুরের হুসাইনাবাদ এলাকার একটি মাঠে সবাই সমবেত হতেন।

অধ্যাপক কবীর চৌধুরী লিখেছেন, ‘যে উৎসবের কথা বলতে যাচ্ছিলাম তা হলো মহররমের মিছিল। শিয়া সম্প্রদায়ের মুসলমানরাই এতে অংশ নিত। মিছিল শুরু হতো হোসেনী দালান এলাকা থেকে। রূপালী কাজ করা নানারকম ঝালর দেওয়া জাফরী কাটা গম্বুজবিশিষ্ট, কতকটা তাজমহলের আকারের, তাজিয়া বানানো হতো। স্বাস্থ্যবান বলিষ্ঠ দেহ পেশিবহুল তেজী একটা সাদা ঘোড়াকে দুলদুল সাজানো হতো।’

কেবল ঢাকাতেই নয়, একই চিত্রের দেখা মেলে কলকাতাতেও। কথাশিল্পী আবু রুশদ লিখেছেন, ‘মহররম এর বাহ্যিক ও প্রকাশ্য উদযাপন শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, আর আমরা ছিলাম ঘোরতরভাবে সুন্নি, তবুও মহররমে যে উত্তেজনার সঞ্চার হতো তা প্রত্যেক দর্শকই উপভোগ করত। আমার নজর কিন্তু সরবত আর খিচুড়ি বিতরণের দিকেও থাকত। বড় বড় লরিতে খিচুড়ি ও সরবতের প্রচুর সরবরাহ থাকত, যে যত পান করতে পারো বা খেতে পারো। আমি সরবত প্রচুর খেতাম, তবে খিচুড়ির কথা এখন ঠিক মনে নেই। আমরা অভ্যন্তরে মহররম পালন করতাম রঙিন কাগজে-মোড়া বাঁশের লাঠি কল্পিত শত্রুর দিকে ঘুরিয়ে।’

কলকাতার মহররম উদযাপনের আরো একটি চিত্র পাওয়া যায় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের স্মৃতিকথায়। তিনি লিখেছেন, ‘মুহররমের মিছিল দেখতে আমার খুব ভালো লাগতো। এটা যে শোকোচ্ছ্বাস-প্রকাশের বিষয়, তা অজানা ছিল না। চোখের সামনেই তো দেখতাম, মিছিলের অংশগ্রহণকারীরা ‘হায় হাসান, হায় হোসেন’ বলে অনবরত বুক চাপড়ে এবং কেউ কেউ ছোটো চাকু বা অনুরূপ ধারালো কিছু দিয়ে বুকে আঘাত করে রক্তাক্ত করে ফেলছে। বেদনা ও বিস্ময়, সহানুভূতি ও সম্ভ্রমের সঙ্গে তাদের অবলোকন করতাম, কিন্তু আমার মনোহরণ করতো তাজিয়া। কতো রঙের, কতো আকারের বিচিত্র সব তাজিয়া থাকতো আর থাকতো নানা উপকরণ দিয়ে বানানো কিংবা সত্যিকার ঘোড়া-সুসজ্জিত দুলদুল- আর রঙিন পোশাকপরা তার সওয়ার।’

কলকাতা আর ঢাকার মতো শহরের মধ্যে মহররমের উদযাপন সীমাবদ্ধ থাকবে এমন ধারণা করলে ভুল হবে। সিলেট, বরিশাল, ময়মনসিংহ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, এমনকি গাইবান্ধাতেও মহররম উদযাপনের চিত্র পাওয়া যায়। সিলেটের স্থানীয় অধিবাসী সৈয়দ মুর্তাজা আলীর জবানে শুনি, ‘সিলেটে খুব জাঁকজমকের সাথে মুহররম পালন করা হত। সিলেট শহরে শিয়া সম্প্রদায়ের কোনো লোক সেকালে ছিলেন না। এই উৎসব পালন করতেন সুন্নিরা। মুহররমের দশ দিনের শেষ দিকে রাত্রে শহরের ভিন্ন ভিন্ন মহল্লা থেকে লাঠিয়ালরা তাদের খলিফার (নেতার) নেতৃত্বে বন্দর বাজারের চৌমাথার কাছে সমবেত হয়ে লাঠি ও আগুনের মশাল দিয়ে খেলা দেখাতেন। আগুনের মশালকে আমরা ‘বানুঢী’ বলতাম। মুহররমের দশম দিন রাত্রে ঈদগাহ সংলগ্ন ময়দানে এই খেলা হতো। তখন অনেক তাঁবুও আনা হতো।’

মহররম উপলক্ষে এই ধরনের খেলার প্রচলন ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও। চিত্রটি ফুটে উঠেছে কবি আল মাহমুদের স্মৃতিতে, ‘মহরম মাসের পহেলা তারিখ থেকেই আমাদের গায়ে লাঠিখেলা ও কিরিচ চালনার ধুম পড়ে যেত। ঢাকের শব্দে মুখর হয়ে উঠত মাগরিবের নামাজের পরবর্তী সময়টা। আমার দাদা ছিলেন গাঁয়ের যুবকদের লাঠিখেলার ওস্তাদ। আমার বাপ-চাচারা সবাই লাঠিখেলা জানতেন। গাঁয়ের সবচেয়ে তুখোড় লাঠিয়াল ছিলেন দক্ষিণপাড়ার আবদুস সালাম ও আবদুল খালেক নামের দুই ভাই। অনেকটা যেন হযরত ইমাম হাসান ও ইমাম হোসেনের প্রতীকী আবেগ সৃষ্টি করতেন এরা লাঠি, দা ও কিরিচের মহড়ায়। এরা দুই ভাই এমন আবেগ ও দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে লাঠিখেলার আসরটি জমিয়ে তুলতেন, মনে হতো ঢোলের শব্দও হায় হোসেন, হায় হোসেন শব্দে কান্না করেছে।’

আবার চট্টগ্রামে হতো ‘চুয়া খেলা’ নামে আরেক ধরনের খেলা। ইতিহাসবিদ আবদুল করিমের বর্ণনায়, ‘দশই মহররমের কয়েকদিন আগে থেকেই বন্ধুরা বলাবলি করছিল চুয়া খেলা দেখতে হবে। বাঁশের চোঙ্গাকে চুয়া বলা হয়, এই খেলা চোঙ্গার সাহায্যে হয় বলে ইহাকে চুয়া খেলা বলা হতো। খেলায় দুই দল অংশ নেয়, বাঁশের চোঙ্গায় বারুদ ভরে আগুন দিয়ে চোঙ্গা ছুঁড়ে দেওয়া হয়, একদল অন্য দলের দিকে ছুঁড়ে, ওই দল আত্মরক্ষা করে আবার বিপক্ষ দলের দিকে তাদের চোঙ্গা ছুঁড়ে দেয়। চোঙ্গা তীব্র গতিতে কিছু ডানে কিছু বামে কিছু উপরে দিয়ে কিছু নিচ দিয়ে ছুটে যায়, শুধু যে প্রতিপক্ষকে আঘাত করে তা নয়, চতুর্দিকে বাড়িতে এবং দর্শকদেরও আঘাত করতে পারে। সুতরাং ইহা একটি বিভীষিকাময় খেলা, তবুও অংশগ্রহণকারী এবং দর্শকদের কমতি হতো না।’

তবে ভিন্ন চিত্র দেখা যায় বরিশাল ও ময়মনসিংহে। বরিশালের শায়েস্তাবাদের নওয়াব পরিবারের মেয়ে কবি সুফিয়া কামাল তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘মহররমের দশদিন এলাকার প্রজারাবাড়িতে রাঁধত না। সারা দিন রোজা রাখার পর খিচুড়ি ও শরবত খাবার জন্য দলে দলে সমবেত হতেন। সন্ধ্যায় কোরআন তেলাওয়াত, দরুদ পাঠ আর মর্সিয়া জারি গানের সুরে আকাশ বাতাস বিষাদে আচ্ছন্ন হয়ে উঠত। ‘শহীদে কারবালা’ ‘জঙ্গনামা’ পুঁথিও পড়া হতো। নিকটের-দূরের গাঁয়ের পণ্ডিতরা এসে সরকারি বাড়িতে পুঁথিপড়া শুনিয়ে ইনাম বখশিস নিয়ে যেতেন। জমিদার বাড়িকে সবাই বলত সরকারি বাড়ি বা নওয়াববাড়ি।’

মহররম উপলক্ষে জেয়াফতের আয়োজনের বিস্তৃত বর্ণনা পাওয়া যায় আবুল মনসুর আহমদের স্মৃতিতেও। তিনি লিখেছেন, ‘আমার জ্ঞান হইয়াছে অবধি দেখিয়াছি প্রতি বছর মোহররমের সময় আমাদের বাড়িতে খুব বড়ো একটা জিয়াফত হইত। মোহররমের চাঁদ দেখিয়াই আমাদের বাড়ির মেয়ে-পুরুষ সকলে নফল রোজা রাখিতে শুরু করিতেন। কাতলের দিন খুব বড়ো পাঁচগেরামী মেহমান হইতো। তাতে অনেক গরু-খাসি জবেহ হইত। বাড়ির সামনের উঠান ও ময়দান লোকে লোকারণ্য হইয়া যাইত। সাদা পোশাক-পাগড়িপরা বহু মৌলভি-মওলানা তাতে যোগ দিতেন। লোক খাওয়ানো ছাড়া গরিব-মিসকিনের মধ্যে অনেক পয়সা-কড়ি বিতরণ করা হইত। দাওয়াতি লোক ছাড়াও বিনা-দাওয়াতি গরিব-মিসকিন জমা হইত অনেক। আনদায কমবেশি পাঁচ হাজার লোক খাইত।’

উপরের উদ্ধৃতিগুলো থেকে দেখা যাচ্ছে, মহররম উদযাপনের বিভিন্ন পদ্ধতি ছিল। পদ্ধতিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ছিল তাজিয়া নিয়ে মিছিল করা। এটা অনেকটা উৎসবে পরিণত হয়েছে। যেমনটা বলেছেন আনিসুজ্জামান ও আবু রুশদ। আবু রুশদের শরবত আর খিচুড়ি খাওয়ার আনন্দ এবং আনিসুজ্জামানের রঙিন জমকালো দুলদুলের বিস্ময়কর বয়ানের মাধ্যমে মহররমের উৎসবমুখর দিকটা স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে।

চট্টগ্রামের চোঙ্গা খেলা ‘বিভীষিকাময়’ হলেও ‘অংশগ্রহণকারী ও দর্শকদের কমতি’ না থাকায় বোঝা যায়, এই খেলায় কত তীব্র আকর্ষণ বোধ করতেন স্থানীয়রা। সুফিয়া কামাল ও আবুল মনসুর আহমদের বর্ণনায় যে জেয়াফতের চিত্র দেখি, তাতে গরিব ও অসহায় মানুষের জন্য সেই জেয়াফত একটি বর্ণাঢ্য উৎসব ছিল। যেখানে মানুষ স্বাভাবিক খাবারের সংকটে ভুগতো, সেখানে টানা ৫-১০ দিন এলাহী খাবার-দাবারে শরিক হওয়া চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। এতে মহররম উদযাপনের মানবিক দিকটা প্রকটিত।

আবার দেখা যাচ্ছে, এই উপলক্ষে মিলাদণ্ডদোয়া-দরুদ পড়ে মাওলানা সাহেবরা কিছু বকশিশ পাচ্ছেন। এতে তাদের আর্থিক সহায়তা হচ্ছে। সবমিলিয়ে বলা যায়, মহররম উদযাপনের রং, ঢং শত বছর আগে এত বিচিত্র বর্ণিল সাজে ছিল বাংলায় যে এর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব সমকালে ছিল বিপুল। সে প্রভাব এতটাই প্রকট ছিল যে, শতবর্ষ পরেও বাংলায় এরূপ চিত্র দেখা যায় মহররম মাসে। বলা যায়, শত বছর পূর্বের বাংলায় মহররমের যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য ছিল, তা এখনো অক্ষুণ্ণ আছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত