সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা গত রোববার পদযাত্রা কর্মসূচির মাধ্যমে প্রেসিডেন্টের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে। সরকারি চাকরির সব গ্রেডের কোটার যৌক্তিক সংস্কার চেয়েছে তারা। এজন্য ২৪ ঘণ্টার সময় বেঁধে দিয়েছে। এই সময়সীমার মধ্যে দৃশ্যমান পদক্ষেপ না নেয়া হলে কঠোর কর্মসূচি দেয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে। কিন্তু বেঁধে দেয়া সময়সীমা অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই ওইদিন মধ্যরাতে আন্দোলনকারীরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদী শিক্ষার্থী জমায়েত অনুষ্ঠিত হয়েছে। কোটা আন্দোলন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন থেকে আসা বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রতিবাদণ্ডবিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়েছে। প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, রাত ১০টার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে শিক্ষার্থীরা বেরিয়ে এসে রাজু ভাস্কর্যে জড়ো হয়। সেখানে তারা বিভিন্ন স্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ করে। রাত দেড়টা নাগাদ তারা হলে ফিরে যায়। খবরে উল্লেখ করা হয়েছে, আন্দোলনকারীদের জমায়েতের খবরে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাদের রুখতে মাঠে নামে ও বাধা দেয়ার চেষ্টা করে। তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। পরে রাত ৩টার দিকে কয়েকশ’ নেতাকর্মী শাহবাগ থেকে রড, লাঠি, বাঁশ ও বিভিন্ন রকম দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে রাজু ভাস্কর্যে অবস্থান নেয়। ভাগ্যিস তখন সেখানে আন্দোলনকারীরা কেউ উপস্থিত ছিল না। থাকলে কী হতো, বলাই বাহুল্য। তবে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় ও সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার ঘটনা ঘটছে। কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়েছে ১ জুলাই। প্রথম দিকে আন্দোলনের ব্যাপারে সরকারি মহল থেকে খুব এটা উচ্চবাচ্য করা হয়নি। তবে দিন যত গেছে, মনোভাব তত কঠোর হয়েছে। এইসঙ্গে রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর দোষ চাপানোর প্রবণতাও লক্ষ্য করা গেছে। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা হুমকির ভাষা প্রয়োগ করেছেন।
পুলিশ আন্দোলন দমানোর চেষ্টা করেছে। শেষ পর্যন্ত ছাত্রলীগকেও হাজির করা হয়েছে। অতীতে বিভিন্ন আন্দোলন দমনে যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছে, চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলন দমনেও সেই একই প্রক্রিয়া অনুসৃত হচ্ছে। যে কোনো অধিকার ও আন্দোলন যদি ন্যায্য ও ন্যায়্যসঙ্গত হয়, সরকারের উচিত তা মেনে নেয়া।
কোটা ব্যবস্থা একেবারে বাতিল নয়, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা তার সংস্কার চায়। তারা সব গ্রেডে যৌক্তিক কোটা নির্ধারণের কথা বলছে। তাদের এ দাবিকে অনেকে কোটা বাতিলের আন্দোলন হিসাবে চিহ্নিত করছে। অনেকে একে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী বলে আখ্যায়িত করার চেষ্টা করছে। এটা মোটেই ঠিক নয়। আজকে যারা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থী, তাদের বয়স ২৪ বছরের কম। তাদের জন্মেরও ৩০-৩২ বছর আগে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপারে তাদের বিন্দুমাত্র বিরূপ মনোভাব থাকার কথা নয়, কারণও নেই। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত একটি দেশের গর্বিত নাগরিক তারা। আজকের শিক্ষার্থীরা সবাই নবপ্রজন্মের সন্তান। একটি প্রজন্মের সঙ্গে অন্য একটি প্রজন্মের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পার্থক্য থাকে। চিন্তা-চেতনা, আচার-ব্যবহার, ভাষা, পোশাক-আশাক ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিশেষভাবে এ পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। নবপ্রজন্মের যারা অভিভাবক, তাদের উচিত উত্তর-পুরুষদের চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে পরিচিত হওয়া, তাদের চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষার বিষয়ে সম্যক ধারণা লাভ করা। কোনো ক্ষেত্রে তাদের উগ্রতা ও অশিষ্টতা থাকলে তা সংশোধনে সহায়তা করা। ন্যায্যতা ও ন্যায়ের পথে তাদের অভিযাত্রাকে সমর্থন করা। নব প্রজন্ম আগামী দিনের দেশ ও সমাজের পরিচালক। তাদের সেভাবেই বেড়ে উঠতে দিতে হবে। সভ্য ও উন্নত দেশগুলোতে নবপ্রজন্ম কী চায়, তার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। এ নিয়ে গবেষণা হয়। তাদের শিক্ষিত ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সব রকম চেষ্টা করা হয়। আমাদের দেশে এরকম লক্ষ্যাভিসারি কোনো কাজ বা গবেষণা হয় না। এ কারণে আমরা অনেক সময় নবপ্রজন্মকে বুঝতে পারি না কিংবা ভুল বুঝি। যারা আজ কোটা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত, সেই প্রজন্মকেও আমরা তাহলে ভুল বুঝছি, তাদের নানাভাবে চিহ্নিত করছি, যা তারা নয়। তারা আজ স্লোগান দিচ্ছে, ‘চেয়ে ছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’, ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার, রাজাকার’ কেন দিচ্ছে তারা এ স্লোগান? আমরা কি তাদের চিনতে পেরেছি? আমাদের নবপ্রজন্ম, আন্তর্জাতিক প্রজন্মও বটে। বিভিন্ন দেশের নব প্রজন্মের সঙ্গে আমাদের নব প্রজন্মও নানাভাবে যুক্ত। এ বিষয়টিও আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। আমরা মনে করি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই শিক্ষার্থীদের হৃদয়ে সৃষ্ট ক্ষত দূর করতে পারেন, তাদের আশা-প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেন। শিক্ষার্থীরা প্রধানমন্ত্রীর সন্তানতুল্য। সন্তান ভুলভ্রান্তি করলেও মা অবলীলায় ক্ষমা করে দেন। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কারের দাবির যৌক্তিকতা বিবেচনায় নিয়ে যথাবিহিত পদক্ষেপ নেবেন তিনি। এ ব্যাপারে তার দূরদর্শিতাপূর্ণ সিদ্ধান্তই সবাই প্রত্যাশা করে।