ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কোটাবিরোধী আন্দোলন

দল নয় শেখ হাসিনাই শেষ ভরসা

ড. মাহবুব মোমতাজ, কবি, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
দল নয় শেখ হাসিনাই শেষ ভরসা

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর বাংলাদেশের সংবিধান কেটেছেটে নতুন রূপ দেয়ার চেষ্টা হয়েছে। খোদ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতারা খোন্দকার মোস্তাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছে। রাতারাতি খোলনলচে পাল্টে নতুন রাজনৈতিক দল খাড়া করেছে। যারা মন্ত্রিসভায় যোগ দেয়নি, তারা নানাভাগে বিভক্ত হয়েছে।

অথচ বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া সংগঠন আওয়ামী লীগ তার হাতে তৈরি নেতারা জাতির পিতা হত্যার দুইদিনের মাথায় সব পাল্টে ফেললেন। ছাত্রলীগ যুবলীগ কৃষক লীগ সব দলই ছিল। নেতার জন্য কেউ মিছিল নিয়ে বের হয়ে গুলি খেয়ে মৃত্যুবরণ করেননি। ঢাকার রাজপথ থেকে আর্মিদের হাতে আটক হননি। বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা নিয়ে অনেক নেতাই রাতারাতি শিল্পপ্রতিষ্ঠান ব্যাংক বিমা কর্পোরেশন জাহাজের মালিক হয়েছিলেন। পত্রিকা অফিস পরিত্যক্ত বাড়ির মালিক হয়ে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান পরিবর্তন করেছিলেন। শান শওকতের জীবন আর সম্পদের প্রতি মোহ জলাঞ্জলি দিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চেয়ে রাজপথে নামতে চাননি। উপরন্ত আওয়ামী লীগ ছেড়ে দিয়েছিলেন। (দলের শীর্ষ নেতা হিসেবে জাতীয় চার নেতাসহ অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, হত্যার প্রতিবাদ করার জন্য নয়) বঙ্গবন্ধুর সামরিক অফিসার কর্নেল জামিল একমাত্র প্রতিবাদ করতে গিয়ে শহীদ হয়েছিলেন।

জাতীয় চার নেতা একসঙ্গে রাস্তায় নামতে পারতেন। তাদের দেখে নেতাকর্মীরা হয়তো সাহস সঞ্চার করে তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াত। কিন্তু সে মন-মানসিকতা নেতাদের ছিল না। তার কিছু কারণও হয়তো ছিল। তাজউদ্দিন আহমেদকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেয়া হয়েছিল। বাকশাল প্রতিষ্ঠার পেছনে তার সমর্থন ছিল না। বরঞ্চ বঙ্গবন্ধুকে তাজউদ্দিন আহমেদ নিষেধ করেছেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম নিজেও বাকশাল চাননি।

ক্যাপ্টেন মুনসুর আলী, কামরুজ্জামান, তাজদ্দিন, সৈয়দ নজরুলকে বাদ দিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তাজউদ্দিন আহমেদ যে সাহসিকতা দেখিয়েছিলেন, সেই মনোবল তার ভেঙে গিয়েছিল, ১৯৭৪ সালে যখন তাকে মন্ত্রপরিষদ থেকে বাদ দিয়ে দেয়া হয়েছিল। অন্য কোনো নেতার সেই গ্রহণযোগ্যতা ছিল না, যিনি জনগণকে সঙ্গে নিয়ে পথে নামবেন। ফলে জাতির পিতার লাশ ৩২ নম্বরে পড়ে ছিল দুইদিন।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন এক এবং অদ্বিতীয়। দলে তার সিদ্ধান্তের বাইরে কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না। ১৯৭৫ সালে বাকশাল প্রতিষ্ঠা করে বঙ্গবন্ধুর ক্ষমতা আরো বেড়ে গিয়েছিল। রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার।

বলা হয়ে থাকে বঙ্গবন্ধুর একক ইচ্ছায় বাকশাল করা হয়েছিল। যদিও দলে দলে রাজনীতিক, অরাজনৈতিক, সরকারি-বেসরকারি লোকজন বাকশালে নাম লিখাতে উৎসুক ছিলেন। বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব তিনি নিজেও বঙ্গবন্ধুকে বুঝাতে চেষ্টা করেছেন। বঙ্গবন্ধু কারো কথা শুনেননি।

অবশ্য না শোনার পেছনেও কারণ ছিল ১৯৭৩ এবং ১৯৭৪ সালে দেশে বাম রাজনৈতিক দলগুলোর বিশেষ করে জাসদ, পূর্ব বাংলা কমিউন্টি পার্টি (এমএল) শাহজাহান সিরাজের পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির দৌরাত্ম্য, গুপ্ত হত্যা, থানা থেকে অস্ত্র লুটপাট, কালোবাজারিসহ দেশে যে অরাজকতা সৃষ্টি করা হয়েছিল তা সামাল দেয়া বঙ্গবন্ধুর জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দেশের এ অবস্থা নিয়ন্ত্রণের জন্য বঙ্গবন্ধুকে এক দলীয় শাসনের বিকল্প ছিল না। বেগম মুজিব বাকশাল চাননি বলেই বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরেও বঙ্গভবনে না গিয়ে তার প্রিয় ধানমন্ডির বাড়িতেই থেকে গেছেন।

১৯৮১ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনা পিতাকে হারিয়ে স্বেচ্ছা নির্বাসন থেকে আওয়ামী লীগ নেতাদের অনুরোধে দেশে ফিরে আসেন। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে আওয়ামী লীগের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এদেশের জনগণের ভোটের ও ভাতের অধিকার নিশ্চিত করতে রাজপথে লড়াই করেন। আওয়ামী লীগকে ঢেলে সাজিয়ে একটি সুশৃঙ্খল দলে পরিণত করেন। ১৯৯৬ সালে প্রথম রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পেয়ে দেশের উন্নয়নের সূচনা করেন। অনেক সিনিয়র ও জুনিয়র নেতাদের মন্ত্রিপরিষদের সদস্য করেন। দলের সাধারণ নেতাকর্মীরা দীর্ঘসময় পরে স্বস্তি ফিরে পায়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সততা ও সব মোহের ঊর্ধ্বে ওঠে দেশ পরিচালনা করলেও দলের ভেতরে কিছু নেতাকর্মীর অসততা লোভ আর দলের বাইরে অপকর্মের কারণে দলের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে থাকলেও কিছু অসৎ নেতাদের কারণে ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসতে পারেনি।

বিএনপি-জামায়াত চারদলীয় জোটের ক্ষমতার অপব্যাবহারে অল্পদিনের মধ্যেই জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে। চারদিকে বিএনপির দুঃশাসন ছড়িয়ে পড়ে। হাওয়া ভবনের শাসন আর শোষণে জর্জরিত জনগণ মুক্তি চায়।

২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে। ২০০৮ থেকে ২০২৪ সাল নাগাদ দীর্ঘ ১৬ বছর আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আছে। গত ৪ বার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধারাবাহিকভাবে সরকার গঠন করে দেশকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। আজ বিশ্বদরবারে বাংলাদেশ স্বমহিমায় উজ্জ্বল। মন্ত্রিপরিষদে নানা সময় নানাজন মন্ত্রী হয়েছেন। দলের দায়িত্ব পেয়েছেন। আগের চেয়ে নেতারা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছে। অনেকে অনেক বেশি সমৃদ্ধ হয়েছে অর্থ সম্পদ যশ খ্যাতিতে। ফলে রাজপথের সেই আওয়ামী লীগ হারিয়ে গেছে সম্পদ আর ব্যবসা-বাণিজ্যের মোহে। অধিকাংশ নেতারা নিজেদের রক্ষা করা নিয়ে ব্যস্ত। দলের সংকটে চকচকে মুজিব কোট পরিহিত নেতারা ভিসা আর পাসপোর্ট গোছাতে তৎপর বেশি।

কোটা আন্দোলন নিয়ে ছাত্রদের সরব উপস্থিতিতে ঢাকাসহ সমগ্র বাংলাদেশ যখন উত্তাল, তখন ধানমন্ডির পার্টি অফিস ছাড়া কোনো আওয়ামী লীগ নেতাকে দেখা যায়নি, নিজের এলাকা তো দূরের কথা কোথাও কোনো ভূমিকা রাখতে। একমাত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভরসা। কারণ এইসব কেন্দ্রীয় নেতা, মন্ত্রী, সাবেক মন্ত্রীদের নিজেদের কোনো অবস্থান নেতাকর্মীদের মধ্যে যেমন নেই, তেমনি জনগণের আস্থাও হারিয়ে ফেলেছে। গত ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনেও অনেক নেতা নৌকা প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে পরাজিত হয়েছেন।

জনগণের আস্থা যদি শুধু প্রধানমন্ত্রীর ওপর থাকে তাহলে এইসব কেন্দ্রীয় নেতা এবং মন্ত্রীরা দলের সংকটে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরের নেতাদের মতোই যে ভূমিকা রাখবে, তার দৃষ্টান্ত কি এখন পাওয়া যাচ্ছে না? এতো ভীত-সন্ত্রস্ত কেন আওয়ামী লীগ নেতারা।

কেন বর্তমান সংকট মোকাবিলায় তারা শীতল সংযমে। ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা নিয়ে আমাদের মতো সাধারণ জনগণ সত্যি উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশের যা কিছু অর্জন তা একমাত্র শেখ হাসিনার জন্য। সংকট সংগ্রামে শেখ হাসিনার পাশেই থাকবে জনগণ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত