সম্মান, যশ, প্রতিপত্তি সব পেয়ে আমরা সুখী নই, সবাই অসুখী, অসুস্থ। আমাদের এ অসুস্থতা মনে। তাই সামাজিকভাবে আমরা যতটুকু এগোচ্ছি তার চেয়ে মনের দিক দিয়ে ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছি। মন-মানসিকতার এহেন পশ্চাদগামীতায় বর্তমান সময়ে মানবিক মূল্যবোধের অভাব প্রকটতর হয়ে উঠছে। সমাজবিজ্ঞানীদের মনস্তাত্ত্বিক গবেষণা এটা প্রমাণ করছে যে, আধুনিক শিক্ষাদীক্ষা মানুষের জ্ঞানবুদ্ধি বিকশিত করছে কিন্তু সামাজিক অবক্ষয়রোধে যে মূল্যবোধের প্রয়োজন তার অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে সর্বত্র। শিক্ষা মানুষকে প্রজ্ঞাবান করলে বিবেকবান করতে অনেকাংশে ব্যর্থ। ফলে কখনো কখনো আমরা এমন আচরণে অভ্যস্ত হয়ে উঠি যা আমাদের সমস্ত জ্ঞানগরিমাকে সমাজের চোখে বেমানান করে তোলে।
আধুনিক শিক্ষিত সমাজের অধিকাংশ লোক মা-বাবার প্রয়োজনীয়তা সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারি না। জীবনের পড়ন্ত বেলায় আপন সন্তানের চরম অবহেলা অনাদরে নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করছেন, এমন হতভাগ্য মা-বাবার সংখ্যা এ দেশে নেহায়েৎ কম নয়। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে সন্তানের কাছে বৃদ্ধ মা-বাবা বোঝাস্বরূপ, মন্তব্যটি শতকরা ১০০ ভাগ সত্য। যদি আমরা চক্ষু লজ্জায় এ ধরনের অপ্রিয় সত্যকে প্রকাশ্যে স্বীকার করতে পারি না। তবু বলতে বাঁধা নেই যে, সন্তানের দ্বারা বৃদ্ধ বাবা-মা আচরণে লাঞ্ছিত হচ্ছেন। আর শিক্ষিত সন্তানদের মধ্যে এ অসামাজিক প্রবণতা তুলনামূলকভাবে বেশি। কারণ মূল্যবোধহীন শিক্ষা এসব স্বশিক্ষিতদের নৈতিকতাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। ফলে অবচেতন মনে তারা মা-বাবার কথা ভাবতে পারে না। অথচ আত্মকেন্দ্রিক সন্তানের চরম অবহেলাকে নিত্যসঙ্গী করে বেঁচেও মা-বাবা একটি ক্ষণের জন্য সন্তানকে ভুলতে পারেন না। কারণ তাদের পক্ষে নাড়ির সম্পর্ক, রক্তের সম্পর্ককে কোনো অবস্থায় বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হয় না।
মা-বাবার অনাবিল স্নেহ মমতায় আমরা বড় হলাম, একটি সময়ে জীবনে প্রতিষ্ঠা পেলাম স্বমহিমায়, কিন্তু তারপর স্বার্থপরের মতো ভুলে গেলাম তাদের কথা যারা আমাদের পৃথিবীর আলো-বাতাস দেখালেন, নিজে না খেয়ে আমাদের খাওয়ালেন, আমাদের মানুষ করার জন্য যারা নিজেদের আরামণ্ডআয়েশকে পায়ে ঠেলে দিলেন, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমাদের শুভ চিন্তায় উদগ্রীব থাকলেন। এত কিছুর পর রিক্ত হাতে চলে যাওয়া মা-বাবাকে ন্যূনতম একটু প্রীতি ভালোবাসা তাদের শেষ জীবনে দিতে পারি না আমরা। এ থেকে বড় স্বার্থপরতা আর কি হতে পারে? পূর্বে উল্লেখ করেছি, তুলনামূলকভাবে শিক্ষিত সন্তানের দ্বারা মা-বাবারা বেশি অবহেলিত। ব্যক্তিগতভাবে আমি দেখেছি, বহু সন্তান রয়েছেন যারা জীবনে প্রতিষ্ঠা পেয়ে নিজের স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে বিদেশ-বিভুইয়ে বছরের পর বছর মা-বাবা ছেড়ে দিব্যি রয়েছেন। একবারো মা-বাবাকে দেখার বা খবর নেয়ার প্রয়োজন বোধ করেন না, তাগিদ অনুভব করেন না। অথচ একদিনের জন্য প্রিয়তমা স্ত্রী চোখের আড়াল হলে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। অসংখ্য অশীতিপর মা-বাবা রয়েছেন যারা নিজ সন্তানকে মানুষ করে শেষ জীবনে সন্তানের সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। গ্রামাঞ্চলে অনেক শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত এবং অশিক্ষিত মানুষ আছেন যারা মা-বাবাকে দেখবালের দায়িত্ব নিতে চান না। এমনকি স্ত্রীর প্ররোচনায় মা-বাবাকে মারধর করে ঘর থেকে তাড়িয়ে দেয় এমন মানবরূপী দানবদেরও দেখেছি। আশ্চর্যের বিষয় হাজারো নিপীড়ন-নির্যাতন সত্ত্বেও মা-বাবা বলেন, আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে। আমি বিভিন্ন স্থানে দেখেছি ছেলে নিজের আলাদা সংসারে চিত্তসুখে দিন কাটাচ্ছে অথচ প্রৌঢ়া মা অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে এক মুঠো ভাতের সন্ধান করছেন। এ ধরনের অসংখ্য উদাহরণ চোখের সামনে রয়েছে। এ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করলে দস্তুর মতো একটি বই লেখা যাবে। কিন্তু এসব চূড়ান্ত নিলর্জ্জতার কাহিনী লিখে ঘুনে ধরা সমাজকে বদলানো সম্ভব নয়। কারণ আমরা যারা শিক্ষার দম্ভে বড়াই করে মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাচ্ছি অথবা বিদেশ থেকে বছরে কিছু টাকা পাঠিয়ে মা-বাবার আকুল সান্নিধ্য থেকে দূরে থাকছি তাদের মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি। কারণ অসভ্যরা আজ সমাজকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। তাই মূল্যবোধের কথা বলে অযথা কালি, কাগজ এবং নিউজপ্রিন্ট নষ্ট করে লাভ নেই। নৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন ধর্মীয় শিক্ষা। কিন্তু দুঃখের বিষয় সে শিক্ষা আমাদের নতুন প্রজন্মকে দেয়া প্রায় হচ্ছেই না। আমাদের বুঝতে হবে ধর্মীয় শিক্ষা ছাড়া নৈতিক চরিত্রের উন্নয়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। ব্যক্তিগত উপলব্ধি থেকে বলছি, আমাদের সমাজে এমন অনেক সন্তান রয়েছেন যারা বিয়ের পূর্বে থাকেন মা-বাবার একান্ত অনুগত। কিন্তু বিয়ে-উত্তরকালে সবকিছু বেমালুম ভুলে যান। এ কথা আমি বলছি না যে, মা-বাবা থেকে সন্তানকে সরিয়ে দেবার মূলে স্ত্রীর ভূমিকা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ দায়ী আমরা ছেলেরা। কেননা, আমি যদি আমার বিবেক এবং দায়বদ্ধতার দরজায় তালা লাগিয়ে দেই তা হলে অন্যের দোষ কোথায়?
যাক সবকিছুর পর এ কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, চরম নির্যাতিত হয়েও সন্তানের বিরুদ্ধে মা-বাবারা মুখ খোলেন না অথবা আইন সচেতন নন। নাহলে আইন অনুসারে প্রতিটি পূর্ণবয়স্ক সন্তান মা-বাবাকে প্রতিপালন করতে বাধ্য। সন্তান প্রতিপালনে অবাধ্য হলে বিভিন্ন ফৌজদারি কার্যবিধির ধারায় আইনি পথে খোরপোস আদায় করতে পারেন অক্ষমণ্ডঅসহায় মা-বাবা। ‘প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে মা-বাবা সন্তানের কাছে বোঝা’-বিতর্কিত মন্তব্যটি বহুলাংশে সত্যি।