ঢাকা ০১ অক্টোবর ২০২৪, ১৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

পিতা-মাতার সেবা : উত্তম ইবাদত

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
পিতা-মাতার সেবা : উত্তম ইবাদত

এই পৃথিবীর আলো-বাতাস আমরা যাদের মাধ্যমে উপভোগ করেছি, তারা হলেন- আমাদের পিতা-মাতা। তারা আমাদের রক্তের সম্পর্কের প্রথম সদস্য। জন্মের আগ থেকে পিতা-মাতার অনুগ্রহ শুরু। একজন শিশুকে পূর্ণ বয়সে পৌঁছাতে কী অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করতে হয় তা একমাত্র পিতা-মাতাই জানেন।

শীতের কনকনে রাতের মধ্যভাগে বিছানায় প্রশ্রাব; কতোটা অসহনীয় তা বর্ণনাতীত। এমনও সময় অতিক্রম হয় যে, পিতা-মাতা নিজে না খেয়ে সন্তানের মুখে খাবার তুলে দেন। কোলে-পিঠে করে একজন আদর্শ মানুষ গড়ার প্রাণপণ চেষ্টা করেন।

কোরআনের একস্থানে আল্লাহতায়ালা বলেন, তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, তারই ইবাদত করো এবং পিতা-মাতার সঙ্গে সদাচরণ করো। লক্ষণীয় বিষয় যে, আল্লাহতায়ালা নিজের ইবাদতের পাশাপাশি পিতা-মাতার সঙ্গে সদাচরণের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে, ইবাদতে পরপরই তার উল্লেখ। এর একটু পরে আল্লাহতায়ালা বলেন, তাদের (পিতা-মাতা) কেউ অথবা উভয়ে যদি তোমাদের জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়। তবে তাদের ‘উহ’ শব্দটি বলো না এবং তাদের ধমকও দিওনা এবং তাদের সঙ্গে ভালো ভালো কথা বলো’। (সূরা বনি ইসরাঈল আয়াত নম্বর : ২৩) আয়াতের বিষয়বস্তু ও বর্ণনা এতটাই সুস্পষ্ট যে, ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে না।

সূরা লোকমানেও আল্লাহতায়ালা নিজের শোকর আদায়ের সঙ্গে সঙ্গে পিতা-মাতার শোকর আদায়ের বিষয়টি এনেছেন। ঘোষণা হচ্ছে, আর আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহারের জোর নির্দেশ দিয়েছি। তার মাতা তাকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করেছে। তার দুধ ছাড়ানো দুই বছরে হয়। নির্দেশ দিয়েছি যে, আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। অবশেষে আমারই কাছে ফিরে আসতে হবে। পিতা-মাতা যদি তোমাকে আমার সঙ্গে এমন বিষয়ে শরীক স্তির করতে পীড়াপীড়ি করে, যার জ্ঞান তোমার নেই; তবে তুমি তাদের কথা মানবে না এবং দুনিয়াতে তাদের সঙ্গে সদ্ভাবে সহঅবস্থান করবে। যে আমার অভিমুখী হয়, তার পথ অনুসরণ করবে। অতপরঃ তোমাদের প্রত্যাবর্তন আমারই দিকে এবং তোমরা যা করতে, আমি সে বিষয়ে তোমাদের জ্ঞাত করব। (সূরা লোকমান : আয়াত নং ১৪-১৫)। এতে প্রমাণিত হয় ইবাদতের পর পিতা-মাতা সেবাযত্নে গুরুত্বের বিচারে অগ্রগামী। সহিহ বুখারির একটি রেওয়াতের পক্ষে প্রমাণ হতে পারে। বর্ণিত আছে, হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযিআল্লাহ আনহু বর্ণনা করেন- কোনো এক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রশ্ন করল, আল্লাহর কাছে সর্বাদিক প্রিয়বস্তু কোনটি? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, নামাজকে তার সময় (মুস্তাহাব ওয়াক্ত) মতো পড়া। সে আবার প্রশ্ন করল তারপর কোনটি? তিনি বললেন, পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা। সে আবার প্রশ্ন করল তারপর কোনটি? তিনি বললেন আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ (বুখারি ও মুসলিম)।

পিতা-মাতার সেবার ক্ষেত্রে পিতা-মাতা মুসলমান হওয়া জরুরি নয়। বুখারির একটি রেওয়াত আছে যে, হজরত আসমা বিনতে আবু বকর রাযিআল্লাহ আনহা বর্ণনা করেন, আমার মা আমার কাছে আসত, সেছিল মুশরিকা। এ ঘটনা ওই সময় যখন কুরাইশদের সঙ্গে হুদায়বিয়ার সন্ধি স্থাপিত হয়েছিল। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামণ্ডএর কাছে আরজ করলাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমার জননী আমার কাছে আসে, আমি তার সঙ্গে কিরূপ আচরণ করব? সে দ্বীন ইসলামের প্রতি অসন্তুষ্ট। আমি কী তার সঙ্গে সদাচরণ করব? রাসূলুল্লাহ বললেন, হ্যাঁ তার সঙ্গে উত্তম আচরণ করবে।

সূরা লোকমানের পনের নম্বর আয়াতে পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহারের বিষয়টি এভাবে এসেছে, পিতা-মাতা যদি আল্লাহর সঙ্গে শরিক করার আদেশ দেয় বা জবরদস্তি করে তাহলে এ আদেশ মানা যাবে না। তবে এ কারণে তাদের সঙ্গে অসাধু ব্যবহার করা যাবে না। ঘোষণা হচ্ছে, পিতা-মাতা তোমাকে আমার সঙ্গে এমন বিষয় শরিক করতে পীড়াপীড়ি করে যে সম্পর্কে তোমার জ্ঞান নেই, তবে তুমি তাদের কথা মানবে না। (সূরা লোকমান : আয়াত : ১৫)।

হাদিসের আলোকে পিতা-মাতার অবাধ্যতার পরিণতি: হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তার নাসিকা ধুলোয় মলিন হোক (এটি একটি আরবীয় প্রবাদবাক্য যার অর্থ হলো ধ্বংস হোক) এভাবে তিনবার বললেন। সাহাবায়ে কেরাম বললেন কার নাসিকা ধুলোয় মলিন হোক (কে ধ্বংস হোক) ইয়া রাসূলুল্লাহ? তিনি বললেন, যে ব্যক্তি নিজের পিতা-মাতা অথবা তাদের কোনো একজনকে পেল অথচ (তাদের খেদমত করে) সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারল না (মুসলিম)। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাযিআল্লাহ আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, নিজের পিতা-মাতাকে গালি দেয়া কবিরাহ গোনাহ। সাহাবারা আরজ করলেন হে আল্লাহর রাসূলুল্লাহ! মানুষ কি পিতা-মাতাকে গালি দেয়? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হ্যাঁ, যেকোনো ব্যক্তি কারো পিতা-মাতাকে গালি দিল। প্রতিউত্তরে সেও তার পিতা-মাতাকে গালি দিল (বুখারি)। আল্লাহর সন্তুষ্টি নির্ভর করে পিতা-মাতার সন্তুষ্টির ওপর। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাযিআল্লাহ আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, প্রতিপালক আল্লাহর সন্তুষ্টি পিতা-মাতার সন্তুষ্টির ওপর এবং আল্লাহর অসন্তুষ্টি পিতা-মাতার অসন্তুষ্টির ওপর। (তিমমিযী) উল্লেখ্য, হাদিসে শুধু পিতার কথা উল্লেখ ছিল। হাদিস বিশারদরা এর দ্বারা পিতা-মাতা উদ্দেশ্য নিয়েছেন।

পিতা-মাতার অবাধ্যকারী বেহেশতে প্রবেশ করবে না। যদিও নিম্নোক্ত হাদিস নিয়ে ওলামাদের মধ্যে মতানৈক্য আছে, তবে উপদেশ গ্রহণে বাধা নেই। ইবনে ওমর থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ বলেছেন, উপকার করে খোটাদানকারী, পিতা-মাতার অবাধ্যকারী, সদা মদ্যপ বেহেশতে যাবে না।

ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ বলেছেন, যে ব্যক্তি এমন অবস্থায় ভোর করল, যে সে তার পিতা-মাতার ব্যাপারে আল্লাহর আদেশের অনুগত রয়েছে। তখন তার ওই ভোর এমতাবস্থায় হলো যেন তার বেহেশতের দুটি দরজা খোলা থাকে। যদি একজন হয়, তাহলে বেহেশতের একটি দরজা খোলা থাকে। আর যে ব্যক্তি এমন অবস্থায় ভোর করল যে, সে তার পিতা-মাতার ব্যাপারে আল্লাহর কাছে অপরাধী। তবে সে যেন এমনভাবে ভোর করল, যে তার জন্য দোজখের দুটি দরজা খোলা থাকে। একজন হলো একটি দরজা খোলা থাকে। এমন সময় এক ব্যক্তি প্রশ্ন করল যদি পিতা-মাতা সন্তানের প্রতি অত্যাচার করে। জবাবে রাসূলুল্লাহ বলেন যদিও তারা সন্তানের প্রতি অত্যাচার করে। যদিও তারা সন্তানের প্রতি অত্যাচার। যদিও তারা সন্তানের প্রতি অত্যাচার করে।

হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি স্বীয় জীবনের প্রশস্ততা ও মরণের বিলম্ব কামনা করে, সে যেন আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করে (বুখারি ও মুসলিম)। হাদিসের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, বিশেষ করে পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহারে রিজিকের প্রশস্ততা ও মরণে বিলম্ব হয়। মুসনাদে আহমদ তিরমিজি ও ইবনে মাজায় বিশুদ্ধ সনদে হজরত আবু দারদা থেকে বর্ণিত; রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, পিতামাত জান্নাতের মধ্যবর্তী দরজা; এখন তোমাদের ইচ্ছা এর হেফাজত করো বা বিনষ্ট করো।

ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত; রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে সন্তান পিতা-মাতার দিকে রহমতের দৃষ্টিতে তাকাবে তার প্রত্যেক দৃষ্টির বিনিময়ে একটি মাকবুল হজের সওয়াব হবে। লোকেরা প্রশ্ন করলো ইয়া রাসূলুল্লাহ! যদি দিনে একশতবার দৃষ্টিপাত করে? জবাবে তিনি বললেন, দৈনিক ১০০ বার দৃষ্টি দিলেও প্রত্যেক দৃষ্টিতে একটি মাকবুল হজের সওয়াব পাবে। (তফসিরে মারেফুল কোরআন বাংলা)। পিতা-মাতার সেবাযত্ন করার ক্ষেত্রে বয়সের কোনো সীমারেখা নেই। সদা-সর্বদা তাদের সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করা, সেবাযত্ন করা, বিশেষ করে বৃদ্ধ বয়সে পিতা-মাতা সন্তানের সেবা যত্নের বেশি মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েন। তখন সন্তানের পক্ষ থেকে কোনো বিমুখতা প্রকাশ তাদের অন্তরে বড় ক্ষত পড়ে। এর সঙ্গে সঙ্গে বার্ধক্যের উপসর্গগুলো স্বভাবগতভাবে মানুষকে খিটখিট করে তোলে। বার্ধক্যের শেষ প্রান্তে যখন বুদ্ধি-বিবেক আকল লোপ পায় তখন পিতা-মাতার সেবাযত্ন সন্তানদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। কোরআন এসব অবস্থায় পিতা-মাতার খেদমত করার জোর তাগিদ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে শৈশবকালীন সময়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহতায়ালা আমাদের পিতা-মাতার খেদমত করার তৌফিক দান করুন, আল্লাহুম্মা আমিন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত