নৃশংসতা-ধ্বংসযজ্ঞ নয়, চাই স্বস্তি

মোস্তফা হোসেইন

প্রকাশ : ২৯ জুলাই ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সরকারি চাকরিতে সাত শতাংশ কোটা রেখে সর্বোচ্চ আদালতে নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ের ফয়সালা হলো। এর মাঝে অনাকাঙ্ক্ষিত প্রাণহানী ঘটে গেছে সারা দেশে। এই মৃত্যু কি এড়ানো যেতো না? অনেক আলোচনাই হতে পারে। কোটাবিরোধী কিংবা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের দাবি ও সরকারের অবস্থান ছিল একই। তারপরও এই মৃত্যু কেন? এই প্রশ্নটি সবার আগে আসতে পারে। এত ধ্বংসযজ্ঞই বা কেন হলো। শত শত কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় সম্পদ নষ্ট হওয়ার দায় নেবে কে? এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ভগ্নপ্রায় অর্থনীতিকে যে আঘাত করেছে, তার জন্যও বা কে দায়ী? এই যে বিশাল ক্ষতি তাও বা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হতো না? কিংবা কারা এসব ঘটনার প্রত্যক্ষ কিংবা নেপথ্য কারিগর? এই মুহূর্তে প্রশ্নগুলোর জবাব পাওয়া জরুরি। আন্দোলনকারীরা বলছে, তাদের কোনো রাজনৈতিক অভিলাষ ছিল না, তারা রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংসকে সমর্থন করেনি কিংবা করেও না। এদিকে সরকার রাষ্ট্রীয় সম্পদের রক্ষক। তাহলে কারা এই সম্পদ ধ্বংস করল। ধ্বংসযজ্ঞের দিকে খেয়াল করা যেতে পারে। প্রথমই ধরা যাক মেট্রোরেল স্টেশন গুঁড়িয়ে দেয়ার কথা। কাজীপাড়া ও মিরপুর ১০ নম্বর মেট্রোস্টেশন এতটাই ধ্বংস করে দিয়েছে, যা চালু হতে আরো ১ বছর সময় লাগবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। হানিফ ফ্লাইওভারের টোলপ্লাজা এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। পদ্মা সেতুর জন্মকেন্দ্র সেতুভবন শুধু পুড়িয়েই দেয়া হয়নি, সেখানে থাকা ৫৫টি গাড়ি আগুন ধরিয়ে শেষ করে দিয়ে সেতু বিভাগকে স্থবির করে দেওয়া হয়েছে, বিআরটিএ এবং বিটিআরসিকে পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে, রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন বিটিভিতে আগুন লাগিয়ে সম্প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল দীর্ঘ সময়ের জন্য, ন্যাশনাল ডাটা সেন্টারে আঘাত করার অর্থ কী? একইভাবে প্রশ্ন আসে, অপটিকেল ফাইবার বিচ্ছিন্ন করা, ডিএনসিসি হাসপাতাল, জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ইপিআই, বিসিপিএস, স্বাস্থ্যশিক্ষা বিভাগের সদর দপ্তর, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবন, জরুরি সাড়াদান সমন্বয় কেন্দ্র’র মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে মারাত্মক ক্ষতি করার উদ্দেশ্য কী? নরসিংদী কারাগার থেকে অস্ত্রসহ পালিয়েছে জঙ্গি এবং কয়েদিরা। পরে অবশ্য অনেকেই আত্মসমর্পণ করেছে। পুলিশ বক্স যে কতগুলো পোড়ানো হয়েছে, তার পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। দুর্বৃত্তদের হাত থেকে রেহাই পায়নি রাস্তার ডিভাইডার-গ্রিল এমনকি রাস্তার আইল্যান্ডের নির্বাক গাছগুলোও। আরো অসংখ্য ধ্বংস করা হয়েছে আন্দোলনের সূত্র ধরে। আন্দোলনকারীরা জরুরি পরিষেবাগুলোকে সচল রাখার ব্যবস্থার কথা আগেই ঘোষণা করেছিল। দুনিয়াজোরা সব আন্দোলন এমনকি কারফিউতেও জরুরি পরিষেবা চালু রাখার বিধান আছে। চলতি কারফিউ থেকেও এসবকে মুক্ত রাখা হয়েছিল। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে- স্বাস্থ্যসেবায় আঘাত করা। অ্যাম্বুলেন্স ভেঙেচুড়ে গুঁড়িয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়াকে মানবতাবিরোধী অপরাধ বললেও কম বলা হবে।

মেট্রোরেল জনপ্রিয়তা এবং জনসুবিধা দুটোই পেয়েছে। সরকারের অর্জনগুলোর মধ্যে এটি নিঃসন্দেহে প্রথম দুটির একটি হিসেবে স্বীকৃত। এতে নিশ্চয়ই কারো সন্দেহ থাকার কথা নয়। এরইমধ্যে ঢাকার ১২ শতাংশ মানুষের যাতায়াত সুবিধা সহজতর করতে সক্ষম হয়েছে এই মেট্রোরেল।

সরকারের যত সমালোচনাই মানুষ করুক না কেন এই প্রশ্নে কারো দ্বিমত নেই। মেট্রোরেলের সুবিধাভোগীদের ছাড়াও সবাই এর প্রশংসা করে থাকেন। তাই সহজেই অনুমান করা যায়, যারা মেট্রোরেল কিংবা সরকারি অন্য স্থাপনা ও সম্পদ ধ্বংস করেছে তাদের মূল লক্ষ্য ছিল জনদুর্ভোগ তৈরি এবং সরকারের কৃতিত্বকে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীরা বলেছে, তারা ধ্বংসযজ্ঞকে সমর্থন করে না। তাহলে নিশ্চিত এখানে তৃতীয় একটি পক্ষ যুক্ত হয়েছে, যারা এই অপকর্ম করে জনগণের দুর্ভোগকে টেনে এনেছে। তাহলে এরা কারা। সরকার এখন বলছে, এই কাজগুলো বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীরা করেনি। কিন্তু আন্দোলন হলে আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতেই থাকার কথা। যখন ধ্বংসযজ্ঞ চলছিল তখন তাদের আন্দোলনও চলছিল, তারা আন্দোলন স্থগিত কিংবা প্রত্যাহার করেনি। সেই অবস্থায়, তারা ধ্বংসযজ্ঞের দায় থেকে কি মুক্ত থাকতে পারে? সরকারি দল থেকে বলা হচ্ছে এ কাজের মূল হোতা জামায়াত-বিএনপি। বিএনপি বলছে, উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপাচ্ছে সরকার। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে ঠিক ওই সময় বিএনপি ঘোষণা দিয়ে মাঠে নেমেছে- তারা বলেছে, আন্দোলনকারীদের সমর্থন করে তারা। শুধু তাই নয়, তাদের ছাত্রসংগঠন ছাত্রদলের সদস্যরা আন্দোলনকারীদের সমর্থনে মিছিলও করেছে। বিএনপি কেন্দ্রীয়ভাবে সমাবেশও ডেকেছিল ঢাকায়। সেই সুবাদেই হয়তো সরকার ধ্বংসযজ্ঞের দায় চাপাতে পারছে বিএনপির ওপর। এক্ষেত্রে যুক্তি হিসেবে আসতে পারে বিএনপির দীর্ঘকালীন জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনের অভিজ্ঞতাও। আরো লক্ষ্যণীয় যে, যখনই বিএনপি আন্দোলনে সমর্থন জানিয়ে রাস্তায় নেমেছে, তখন থেকেই এই ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়। তারপরও ঢালাওভাবে বলা যাবে না, বিএনপিই এই ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। সরকার যেহেতু দাবি করছে, বিএনপি-জামায়াত ছাত্রদের দাবির ওপর ভর করে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করেছে, এখন সরকারকেই প্রমাণ করতে হবে এর সত্যতা। উন্নত প্রযুক্তিসুবিধা ব্যবহার করে এর আগে অনেক মোটা দাগের অপরাধীকে চিহ্নিত করায় আমাদের পুলিশ বাহিনী দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। থ্রিল কাহিনির চলচ্চিত্রের মতো অপরাধীকে ধরে আনার মতো অসংখ্য উদাহরণও তৈরি করেছে বাংলাদেশের পুলিশ। তা ছাড়া প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেও সিসিটিভি সংযোজিত আছে। তাই প্রযুক্তিসুবিধা ব্যবহার করে অপরাধীদের চিহ্নিত করা সম্ভব বলে সাধারণ মানুষ মনে করতেই পারে। দ্বিতীয় দিকটি আলোচনায় আসতে পারে, কোটা বিষয়ে। সরকার ও আন্দোলনকারীরা চেয়েছিল কোটা সংস্কার হোক। দুই পক্ষেরই একই চাওয়া হওয়ার পরও শিক্ষার্থীরা কেন আন্দোলনে গেল? মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের আদালতে যাওয়ার পর হাইকোর্ট কোটা প্রথা আবার চালু করে রায় দেন। সেই রায়ে সংক্ষুব্ধ হয় সরকার। তার প্রমাণ-রায় প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকার আপিল করার কথা ঘোষণা করে। এতে স্পষ্ট হয় যায়, সরকার আগের কোটা পদ্ধতিতে বিশ্বাসী নয়। ৫৬ শতাংশ কোটা নির্দিষ্ট করে দেয়াকে সরকার সমর্থনযোগ্য নয় বলে মনে করে। একইভাবে আন্দোলনকারীরাও একই দাবি করছিল।