ধ্বংসযজ্ঞ দেখে কাঁদলেন প্রধানমন্ত্রী পাশে দাঁড়ালেন নিহত ছাত্রদের

ড. মাহবুব মোমতাজ

প্রকাশ : ৩০ জুলাই ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

কোটা আন্দোলনে দেশের যেসব সোনার ছেলেরা প্রাণ হারিয়েছে তাদের বিদেহী আত্বার শান্তি কামনা করছি। যেসব বাবা মায়ের বুক খালি হয়েছে তাদের পরিবারের অপুরণীয় ক্ষতির জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি। শোকসন্তপ্ত পরিবারের শোক সহ্য করার ক্ষমতা দিক আল্লাহ। দেশ বিভাগের আগে মহাত্মা গান্ধী হিন্দু মুসলমানকে পৃথকভাবে বোঝাতে বলতেন আমাদের আর তাদের। তিনি অসাম্প্রদায়িক ছিলেন বটে কিন্তু ভারত হিন্দুর এটা বলতে ছাড়তেন না। রাম রাজ্য প্রতিষ্ঠাও করতে চেয়েছিলেন। আবার ভারত ভাগ হোক তা চান নি ভুলেও। বরঞ্চ বলেছেন ভারত ভাগ করতে হলে আমাকে কেটে অর্ধেক করতে হবে। অখণ্ড ভারত মাতাতে তার প্রীতি ছিল। কাজকর্মে ছিলেন হিন্দুপন্থি সাম্প্রদায়িক। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশে যা ঘটলো তাতে আমাদের আর তাদের বলে তো কিছু নেই। তাহলে কে কাকে আমরা হত্যা করছি, অফিস আদালত, মেট্রোরেল স্টেশন ভেঙে ল- ভণ্ড করছি, গাড়িতে আগুন দিয়ে দেশের সম্পদ পোড়াচ্ছি। যাদের হত্যা করছি তারা কারা? যেসব সম্পদ নষ্ট করছি এগুলো কাদের সম্পদ। তাহাদের? নাকি আমাদের।

কোটা আন্দোলন সমর্থনযোগ্য। সবাই তা মানছে। কিন্তু রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল আচরণ হয়নি। প্রথমেই বিষয়টি গুরুত্ব দিলে এতো জান মালের ক্ষতি হতো না। এখন আমরা বলছি ছাত্রদের আন্দোলন অন্যেরা ঢুকে পড়েছে। অন্যপক্ষ দেশের সম্পদ নষ্ট করেছে। হত্যা গুম যখম এসব বিএনপি জামাতের কাজ। তাহলে বিষয়টি বুঝে ওঠতে বিলম্ব হলো কেন। রাষ্ট্র তো একটি প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্র পরিচালনা যারা করেন তারা তো সরকার। সরকার আর একটু দায়িত্বশীল আচরণ করলে ছেলেরা এমন বেপরোয়া নাও হতে পারতো। ছাত্রদের সামষ্ঠিক উত্তেজনাকে অন্যরা নিজেদের মতো ব্যবহার করেছে। ছাত্রদের এতো ক্ষোভ ছিল না। তাদের যেটুকো ক্ষোভ ছিল তারা তা প্রকাশ করেছে নিজেদের ‘রাজাকার’ বলে। আসলেতো তারা রাজাকার না। এটা ছিল তাদের ক্ষোভ। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে ভুল ব্যাখ্যার নামান্তর। বিষয়টি খুব স্পষ্ট প্রধানমন্ত্রী বলেছেন ‘মুক্তিযোদ্ধার নাতিপুতিরা কোটা পাবে না তো রাজাকারের নাতি পুতিরা পাবে’ এ কথার দ্বারা ‘ছাত্ররা রাজাকার’ এটি বোঝায়? আমার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে। আপনি একটু ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখুন।

যে কোনো দেশের প্রধানমন্ত্রী সেদেশের একটি প্রতিষ্ঠান। রাজনৈতিক দল মতের ঊর্ধ্বে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা ১৭ কোটি মানুষের। শুধু আওয়ামী লীগের নয়। শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী দল মত নির্বিশেষে সবার। তাহলে ১৭ কোটি মানুষকে নিরাপত্তা দেয়া ও জান মাল রক্ষা করা উনার দায়িত্ব। উনি নিরপেক্ষভাবে সে কাজটি করেছেন। কারো পক্ষালম্বন করেন নি। তার দৃষ্টান্ত ২৮ জুলাই আবু সাঈদসহ ৩৪ জন নিহতের পরিবারকে নগদ অর্থ ও পারিবারিক সঞ্চয়পত্র ব্যবস্থা করেছেন এবং তাদের পরিবারের দায়িত্ব নিয়েছেন। অনুরাগ বিরাগের বশবর্তী হয়ে তিনি যদি একাজটি না করতেন তাহলে সমালোচনা হতে পারতো। কিন্তু তার মানবিকতার দৃষ্টান্ত এমন অনেক। তিনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা বলেই এমনটি করেন। কাউকে দেখানোর জন্য নয়। তুলনা করতে পারেন ১৯৭৫ সালের পর যতোগুলো সরকার প্রধান দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের সঙ্গে। জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধাদের ফাঁসি দিয়ে হত্যা করেছেন। এরশাদ ছাত্রদের মিছিলে ট্রাক তুলে দিয়ে হত্যা করেছে ছাত্র নেতা কাঞ্চন, দেলোয়ার, দিপালী সাহাসহ অসংখ্য নেতাকর্মীকে। খালেদা জিয়া ১৭ জন কৃষককে ক্ষেতের সার চাওয়ার অপরাধে গুলি করে হত্যা করেছে। ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বাংলা ভাই, আল কায়েদা, হরকাতুল জিহাদ, জেএমবি জঙ্গিরা হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছে। কেউ কারো পরিবারের দায়িত্ব নেয়নি। সে সময় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চলেছে দেশে।

একথা তো সত্যি একটি মিছিল অথবা একটি আন্দোলন অথবা কিছু মানুষ একত্রিত হয়ে রাষ্ট্রের কোনো সম্পদ নষ্ট করতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সে সম্পদ রক্ষা করবেন বলে তিনি সংবিধানের ১৪৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী শপথ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। এটি তার সাংবিধানিক দায়িত্ব। নিরাপত্তা বাহিনী দিয়ে তিনি যথাযথভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন এটাই তো জনগণের প্রত্যাশা। তাহলে উনার ওপর আপনার ক্ষোভ কেন। যারা এই আন্দোলনে নিহত হলো তারা তো আমাদের সন্তান ভাই আপনজন। তৃতীয় পক্ষ যারা এই ন্যায্য আন্দোলনকে সরকার পতনের আন্দোলন ভেবে এই হতাহতের সৃষ্টি করলো তাদের সনাক্ত করুন। সড়ক ভবনের গাড়িগুলোর ওপর আপনার ক্ষোভের কারণ কি? আমাদের জনগণের টাকায় কেনা গাড়ি ওগুলো। গাড়িগুলো কি আওয়ামী লীগের? আওয়ামী লীগের নেতাদের? মেট্রোরেল কার? প্রধানমন্ত্রী তো বলেছেন মেট্রোরেলে আমি ওঠি না আমার মন্ত্রিপরিষদ ওঠে না, আপনারা জনগণ আপনারা ওঠেন তাহলে যারা ভাঙলো তাদের বিচার আপনারা করবেন। জনগণের কাছে তিনি বিচার চেয়েছেন। যথার্থই।

আন্দোলন সংগ্রামে জীবন দিতে হয়েছে দৃষ্ঠান্ত অনেক। কিন্তু এভাবে জীবন দিতে হয়েছে নজিরবিহীন। এতো উত্তেজনা কোটা বিরোধী ছিল? না সরকার পতনের। আন্দোলন সহিংস হওয়ার পেছনে দাগী অপরাধী, সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও উদ্দেশ্য নির্ভর ছিল। যে কারণে এতা হতাহত। এতো রক্তপাত। আন্দোলন তো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছিল। রাজপথে আনলো কে? সাধারণ মানুষ যারা হতাহত হয়েছে তাদের কোটা ছিল? ভিডিও ফুটেজে তাদের হাতে লাঠি ইট কেন? বিষয়টি ভেবে দেখবেন। সরকার জনগণের। উন্নয়ন জনগণের জন্য। উন্নয়ন ধ্বংস করলে সরকার ধ্বংস হয় না জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জীবন যাত্রা ব্যহত হয়। একটি প্রবাদে পড়েছিলাম ‘এক জেলে বন্যার নতুন পানিতে হাতের কাছে মাছ দেখে খুব হা হুতাশ করছে আর মাছগুলো মাটির ঢিলা দিয়ে তাড়িযে দিচ্ছে একজন জিঙ্গেস করছে মাছগুলো তাড়িয়ে দিচ্ছ কেন তখন সে বলছে আমার যেহেতু জাল নেই তাই আর কেউ মাছ ধরুক আমি চাই না।’ কারো ভালো পছন্দ না হলে সম্পদ রাষ্ট্রীয় সম্পদ ক্ষতি করবেন এটাকে পরশ্রীকাতরতা বলে।

এই লেখা যখন লিখছি তখন গণমাধ্যমে দেখলাম ডিবি অফিসে আন্দোলনের সমন্বয়েকেরা বসে ডিবি প্রধানের সঙ্গে মধ্যাহ্ন ভোজ করছেন। প্রেস রিলিজ এ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। এটিই প্রত্যাশিত। কারণ সরকার তাদের দাবি মেনে নিয়েছে। সমন্বয়কদের ধন্যবাদ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিয়ে ছাত্রদের জীবন মানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন সরকারের দায়িত্ব। তবে যেসব তাজা প্রাণ ঝড়েগেছে তার সুষ্ঠু বিচার যেন হয়। আগামীর বাংলাদেশ তরুণদের হাতে। তাদের সর্বাঙ্গীন মঙ্গল হোক।

লেখক : শিক্ষক, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়